গণমাধ্যমের ডিজিটাল রূপান্তর, চাকরি ছাঁটাই ও কিছু প্রশ্ন
১৫ মে ২০১৯ ১০:২২
মার্কিন ব্যবস্থাপনা পরামর্শক কোম্পানি Mckinsey & Co. ধারণা করছে, ২০৩০ সাল নাগাদ প্রায় ৮০ কোটি চাকরি মানুষের বদলে রোবটের হাতে চলে যাবে। খবরটা আশা করি আমাদের গণমাধ্যমের কর্মী বন্ধুরা অনেকেই শুনেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির বাজারের বিস্তার ও রূপান্তরের নতুন ঢেউকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে— এটাও নিশ্চয়ই সচেতন পাঠকরা সবাই জানেন। Mckinsey & Co.-এর এই ভবিষ্যদ্বাণী আমাদের পত্র-পত্রিকার ‘অমুক নায়িকা হয়ে উঠেছেন ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার’ জাতীয় রিপোর্ট নয়, ৪৬টি দেশের আটশ ধরনের পেশার ওপর গবেষণা ও পর্যবেক্ষণলব্ধ ফলাফল।
কেন বলছি চাকরি হারানোর কথা? তার সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদেরই বা কী সম্পর্ক? কারণ বাংলাদেশের বাজারে সাংবাদিকরা চাকরি হারাচ্ছেন, কিংবা বছর পেরোলেও বেতন পাচ্ছেন না। এবং একবার চাকরি হারালে আবার চাকরি পাওয়াও দিন দিন দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। টিভি চ্যানেল কিংবা পত্রিকাগুলোতে বড় ছাঁটাই চলছে। এ কারণে সাংবাদিক নেতারা সমাবেশ প্রতিবাদ করে বলছেন—
‘সাংবাদিকরা বিক্রয়কর্মী নয়, গণমাধ্যমে লাভ-লোকসানের হিসাব করে তাদেরকে কেন ছাঁটাই করা হবে? মালিকপক্ষ এখানে একধরনের দুরভিসন্ধি করছে। তারা চায় না দেশে গণমাধ্যমে বিকশিত হোক। এটা একধরনের রাষ্ট্রবিরোধী আচরণ। অবিলম্বে এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।’ (সূত্র: সারাবাংলা ডটনেট, ৫ মে ২০১৯)
এখন প্রশ্ন হলো— কনটেন্টের বাজারে গণমাধ্যমকর্মীরা উৎপাদক কিংবা বিক্রয়কর্মী না হয়ে কেন এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময় ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষাকারী প্রতিনিধি’ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুর মত ভর্তুকিতে সংরক্ষিত হবেন, যেখানে ডিজিটাল কনটেন্টের চ্যানেল ও বাজারে দ্রুত রূপান্তর ঘটছে? তাও আবার যেখানে আমাদের গণমাধ্যমের মূল বিনিয়োগকারী ও চাকরিদাতা হচ্ছে বেসরকারি খাত এবং বেসরকারি খাত বেশিদিন ভর্তুকি দিয়ে কোনো ব্যবসা চালায় না, এমনকি ১৯৯০-এর পর বৈশ্বিক বাস্তবতায় সরকারও সেটা আর পারে না। যেখানে অটোমেশনের কারণে ২০৩০-এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গার্মেন্টস শ্রমিকদের চাকরি না থাকার আশঙ্কা দেখা দিচ্ছে, সেখানে বছর বছর ক্ষতির বোঝা টেনে বেসরকারি টিভি চ্যানেল অথবা পত্রিকায় কারা গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য চাকরি বাঁচিয়ে রাখবে? সরকারই বা কেন এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে, এমন দাবি বোধগম্য নয়।
এ প্রেক্ষাপটে আমাদের গণমাধ্যমের কিছু বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত ভাবা দরকার:
– টিভি চ্যানেল, পত্রিকা ইত্যাদিতে বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী গত দুই দশকে বিনিয়োগ করেছে মূলত মুনাফার আশায় নয়, বরং গণমাধ্যমকে নিজেদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে। আর যাদের রাজনৈতিক অভিলাষ ছিল, তারা নিজ নিজ গণমাধ্যম ব্যবহার করেছেন আত্মপ্রচারের সুযোগ ও প্রতিপক্ষের অপপ্রচারের জবাব দেওয়ার পাল্টা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে। এখানে টেকসই ব্যবসার মুনাফার মডেলের চেয়ে মুখ্য ছিল গণমাধ্যমে নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক বলয়ের দখল কায়েম রাখা।
– এর ফলে দেশের বাজারের সাপেক্ষে গত দুই দশকে চ্যানেল ও পত্রিকার অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি হয়েছে। যেকোনো ঘটনাস্থলে যখন একসঙ্গে প্রায় ৪০-৫০ জন সাংবাদিক বুম/কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, আর একই সময়ে সব চ্যানেলে কিংবা অনলাইনে একই একঘেয়ে তথ্য প্রচারিত হতে থাকে, তখনই তা দর্শক ও গণমাধ্যমকর্মী— উভয়ের কাছেই স্পষ্ট হয়। এখন বাজার তার সূত্র অনুযায়ী চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে একটা পর্যায়ে জোগান সংশোধন করে, যখন ভর্তুকি ফুরায়। আমাদের গণমাধ্যমের বাজারেও তাই ঘটছে।
– গণমাধ্যমের বিনিয়োগকারীরা যে দর্শকের কাছে প্রচার ও আনুকূল্য পাওয়ার জন্য চ্যানেল বা পত্রিকা দিয়েছিলেন, সেই দর্শক গত চার-পাঁচ বছরে টিভি থেকে চলে যাচ্ছে ফেসবুকে, ইউটিউবে, নেটফ্লিক্সে অথবা ওপারের জি বাংলায়। আমরা আজকাল আর ঘড়ি ধরে টিভিতে খবর দেখতে বসি না, কোনো টকশো সমাদৃত হলে পরদিন দেখে নিচ্ছি ইউটিউবে। টিভি চ্যানেলে যদি দর্শক না থাকে তাহলে যারা পয়সা দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়, তারা কেন এসব চ্যানেলকে পয়সা জোগাবে? আর রাজনৈতিক প্রচারের লক্ষ্য যে দর্শক, তাদের ঝোঁক অন্য কোথাও থাকলে মালিকই বা আর কেন বছর বছর পুরনো চ্যানেলে ভর্তুকি চালিয়ে যাবে?
বাজারের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাই গণমাধ্যমকর্মীদের যোগ্যতা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টিকে থাকা ও গণমাধ্যমের ব্যবসায়িক কৌশল নিয়ে কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করা জরুরি, যেগুলোর উত্তর পেশাগত রুটি-রুজির খাতিরেই দ্রুত খুঁজে নিতে হবে:
১। আমাদের গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ সম্পাদক বা ব্যবস্থাপকরা এবং সাম্প্রতিককালে মানববন্ধনরত সাংবাদিক নেতারা কনটেন্ট মিডিয়ার ডিজিটাল রূপান্তরের বাজারে টিকে থাকা নিয়ে কী ভাবছেন? নিউইয়র্ক টাইমস অথবা দ্য গার্ডিয়ানের মতো প্রতিষ্ঠানের উত্থান-পতন, পরিবর্তিত ব্যবসায়িক কৌশল নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে তারা কিছু পড়ালেখা করেছেন? ভেবেছেন? নাকি তারা আর কিছুদিন পর সুখী অবসরে যাবেন বলে নিশ্চিন্তেই আছেন? গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে যাদের বয়স পঁচিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে এবং যাদের এই রূপান্তরিত বাজারে ক্যারিয়ার বাঁচিয়ে রাখতে হবে তারা কিভাবে টিকে থাকবেন, সে বিষয়ে তাদের কোনো দিকনির্দেশনা আছে?
২। গণমাধ্যমকর্মীরা নিশ্চয়ই জানেন, দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার কাগজ থেকে সম্পূর্ণ অনলাইনে যাওয়ার লাভ-ক্ষতি ও সম্ভাব্য কৌশল নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। শীর্ষস্থানীয় বাংলা দৈনিক প্রথম আলো ফেসবুক লাইভের জন্য বিপুল ব্যয়ে স্টুডিও বানিয়েছে। বাজারের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাবনা ও কৌশল থেকে আমাদের কিছু শেখার আছে?
৩। ডিজিটাল যুগে গণমাধ্যমে চাকরি বাঁচিয়ে রাখার মতো যোগ্যতা অর্জনে কোনো অনলাইন বা অফলাইন কোর্স/পড়ালেখার চেষ্টা/উদ্যোগ কতজন কর্মী নিয়েছেন? একটা ফিচারের যথার্থ টুইট ক্যাপশন আর ফেসবুক ক্যাপশনের পার্থক্য করতে পারেন শতকরা কতজন সাংবাদিক? প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের ডিজিটাল মাধ্যমে দক্ষতা তৈরিতে কোনো বিনিয়োগ বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করছে?
৪। কয়েক দিন আগেই ঢাকায় বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের উদ্যোগে ডিজিটাল যুগের ব্র্যান্ড কৌশল নিয়ে অসাধারণ আলাপ-আলোচনা, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিনিময় হলো। অভিজ্ঞ কিংবা নবীন— সব মার্কেটিয়াররাই শিখতে গেছেন সেখানে। মিডিয়া থেকে শিখতে-জানতে-ভাবতে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্য থেকে কতজন এমন ফোরামে নিয়মিত যান? বিজ্ঞাপন জোগানো ইন্ডাস্ট্রিগুলোর রূপান্তর নিয়ে গণমাধ্যম কর্মীরা কী ভাবছেন? তাদের খবর প্রচারের বাইরে এসব খাতের রূপান্তরের প্রভাব গণমাধ্যমের ওপর কিভাবে পড়বে, তা নিয়ে কি আলাপ হচ্ছে? দর্শকের স্রোতের দিক পরিবর্তন নিয়ে গণমাধ্যমকর্মী বা মালিকরা কী পর্যবেক্ষণ করছেন? কৌশল বদলাচ্ছেন?
৫। গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্য থেকে কেউ ডিজিটাল উদ্ভাবনী কোনো মিডিয়ার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা ভাবছেন, বাজারের বাঁক বদলের মধ্যে যারা নতুন ধারার ব্যবসা চালু করতে পারবেন? দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা খুব কঠিন হবে না, যদি টেকসই ব্যবসার মডেল প্রমাণ করা যায়। এমন উদ্ভাবন অন্য গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নতুন চাকরির সুযোগও নিয়ে আসতে পারে বড় সংখ্যায়।
তরুণ গণমাধ্যমকর্মী বন্ধুদের বোধহয় এসব প্রশ্ন নিয়ে ভাবনা জরুরি। বাজারের বাঁক বদলে আমাদের পুরনো ধাঁচের গণমাধ্যমের সামনে কঠিন দিন অবশ্যম্ভাবী। তাই দ্রুত ভেবে বের করতে হবে আপনাদের প্রস্তুতি ও কৌশল কেমন হওয়া উচিত। নইলে প্রতিবাদ সমাবেশ কিংবা ওয়েজ বোর্ড বেশিদিন এই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কনটেন্ট মিডিয়ায় আপনাদের চাকরি বাঁচাতে পারবে না।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/টিআর
গণমাধ্যম চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ছাঁটাই ডিজিটাল কনটেন্ট ডিজিটাল রূপান্তর