কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার কাঠামোগত যত সমস্যা
২১ মে ২০১৯ ১২:১০
মণপ্রতি ধান ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করে কৃষকের খরচ উঠে আসছে না। পথে বসছে কৃষক। এর পরিপ্রেক্ষিতে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মহোদয়দের পক্ষ থেকে। আপাতদৃষ্টিতে উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। তবে বাস্তবতা একটু কঠিন এবং অজনপ্রিয়। তা বোধকরি রাজনীতিবিদদের অনেকেই জানেন।
বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে চাল বিতরণ ও বাজার-ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার কাজটি করে থাকে খাদ্য বিভাগ। তবে তারা তা কিনে থাকে বিভিন্ন মিল মালিকদের কাছ থেকে। কিন্তু এক ঘোষণায় ঢালাওভাবে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনার সক্ষমতা বর্তমানে (এই মুহূর্তের কথা বলছি) আমাদের খাদ্য বিভাগের নেই। এর একটি কারণ কাঠামোগত, আরেকটি রাজনৈতিক ও বাজার ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট।
সরকারের ইচ্ছায় খাদ্য বিভাগ কিছু ক্ষেত্রে কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনছে বটে, কিন্তু সেটা পরিমাণে একেবারেই সামান্য। এভাবে ভুক্তভোগী সব কৃষকের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে তাই কাঠামোগত সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করা যাক।
আরও পড়ুন- ধানের রাজ্যে দামের নৈরাজ্য
প্রথমত, বেশিরভাগ উপজেলা খাদ্য অফিসে ইউনিয়ন পর্যায়ের কৃষকদের কোনো আনুষ্ঠানিক শুমারি করা তালিকা স্থায়ীভাবে থাকে না। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর এই তালিকা যথাসময়ে হালনাগাদ না করার কারণে এখন হুড়োহুড়ি করে কিছু জায়গায় তালিকা তৈরি করা হচ্ছে, যা ত্রুটিপূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ৩৫ মিলিয়ন টনের বেশি খাদ্যশস্য এ বছর উৎপাদিত হতে যাচ্ছে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই অবগত ছিল মাসখানেক আগেই। তবু বাজারমূল্যে এই উৎপাদনের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি এবং কৃষকের পূর্ণ তালিকা তৈরির জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কার কাছ থেকে ধান কিনতে হবে, তালিকা যথাযথ না হওয়া বা না থাকার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেনার পদ্ধতি সুনির্দিষ্ট নয়।
দ্বিতীয়ত, জরিপের অভাবের কারণে ইউনিয়ন পর্যায়ে কোন কৃষকের কাছে কত ধান আছে, সেটি জানা নেই। শুমারি ও জরিপ হালনাগাদ করা থাকলে কোন কৃষকের কাছ থেকে কত ধান কিনতে হবে, সেটি জানা সম্ভব হতো। জরিপ থেকে বেরিয়ে আসত, প্রতি কৃষক তার জমিতে কী পরিমাণ ফসল উৎপাদন করছেন। ডিজিটাল সার্ভারে সেই তথ্য সংরক্ষণ করে রাখলে নির্ধারিত সময়ে হালনাগাদ করতেও সুবিধা হতো।
এ পর্যন্ত জেনে মনে হতে পারে, এসব তথ্য সংগ্রহ অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও প্রায় অসম্ভব। জেনে রাখা ভালো, ইউনিয়ন পর্যায়ে থাকা প্রতিটি আড়তদার ও ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কাছে এই তথ্যগুলো আছে বলেই তারা সময়মতো নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী ধানের দাম নির্ধারণ করে কৃষকের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে। ফলে কৃষক এদের কাছে অল্প দামে ধান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়, যা দিয়ে তার খরচও উঠে আসে না— লাভ হওয়া তো দূরের কথা।
আরও পড়ুন- হাতে আসেনি নামের তালিকা, ধান যেন কৃষকের গলার কাঁটা
স্থানীয় আড়তদার আর ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের পক্ষে সময়মতো তৈরি থাকা সম্ভব হলে খাদ্য বিভাগের পক্ষে কেন সম্ভব হবে না? পুরো তথ্য একত্রীকরণ থানা পর্যায়ের খাদ্য কর্তৃপক্ষের জন্য অনেক সহজ না হলেও বিষম কঠিন কিছু নয়। কৃষককে উপযুক্ত দাম দিতে হলে এই তালিকা তৈরি করতেই হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী এই তালিকা হালনাগাদও করতে হবে।
তৃতীয়ত, প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু কৃষক ধান পরিবহনে খুব একটা সমর্থ নন। উপজেলা খাদ্য অফিস/গুদাম পর্যন্ত এসে যে একজন কৃষক চাল বিক্রি করবেন, সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। উপরন্তু, উপজেলা খাদ্য অফিসও এই পরিবহন ব্যবস্থার দায়িত্ব নেওয়ার অবস্থায় নেই। সাধারণত, এই পরিবহনে উপজেলা খাদ্য অফিসের আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকে না এবং লোকবলও নেই। কারণ, উপজেলা খাদ্য অফিসের বেশ কয়েক বছরের সাধারণ চর্চা হলো মিল মালিকদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কেনা। তবে এই অবস্থাকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর সুযোগ নেই। চাইলে পদ্ধতিগত সমাধান সম্ভব, যার একটি হলো কৃষকদের ধান একত্রীকরণ।
একত্রীকরণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করা জরুরি। ধরা যাক, একজন কৃষকের কাছে আছে ১০০ মণ বা ৪০০ কেজি ধান। উপজেলা পর্যায়ে কেনার মোট পরিমাণের তুলনায় যা খুবই সামান্য। কাজেই উপজেলা খাদ্য অফিসের জন্য এরকম স্বল্প পরিমাণে ধান সংগ্রহ করা খুবই অদক্ষ ও ব্যয়বহুল হয়ে যায়। এই সমস্যা নিরসনে সম্মিলিতভাবে কয়েকজন কৃষকের কাছ থেকে উৎপন্ন ধান একত্র করা প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়— ৩০-৪০ জন কৃষক নির্দিষ্ট দিনে ইউনিয়নের এক স্থানে নিজের ধান জড়ো করবেন। সেখান থেকে সম্মিলিত ব্যয়ে খাদ্য বিভাগের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত ধান পরিবহন করা হবে। এই কাজ অল্প দিনের নোটিশে সম্ভব নয়। প্রয়োজন ছিল, উদ্বৃত্ত উৎপাদনের কথা বুঝে আগে থেকেই কৃষকদের কাছ থেকে এই একত্রীকরণের কাজটি করা।
আরও পড়ুন- রাস্তায় ধান ছিটিয়ে কৃষকের প্রতিবাদ
চতুর্থত, একজন কৃষক সামর্থ্যবান না হলে ধান শুকানোর যন্ত্র কেনা তার পক্ষে ব্যয়বহুল। দরিদ্র ও মধ্যম আয়ের কৃষকদের কাছে এই যন্ত্র থাকে না। ফলে তাদের উৎপাদিত ধান থাকে ভেজা, যা অত্যন্ত দ্রুত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সরকার ১৪ শতাংশ আর্দ্রতায় ধান কিনছে। কিন্তু বেশিরভাগ কৃষকের ধানে আর্দ্রতার মাত্রা এর থেকে বেশি। যে ধান সংক্ষিপ্ত নোটিশে সংগ্রহ করা হচ্ছে, তার মান ঠিক রাখার কোনো পূর্বপ্রস্তুতিও নেওয়া হয়নি। এটা নিকট ভবিষ্যতে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি করবে খাদ্য বিভাগকে।
কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনতে হলে সরকারের উপজেলা পর্যায়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ধান শুকানোর কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি এমন একটি সুপারিশও করেছেন, যেখানে পাঁচ হাজার মেট্রিক টন ক্ষমতার দুইটি সাইলো (সংরক্ষণাগার) তৈরি হবে এবং সেখানেই ধান শুকানোর ব্যবস্থা থাকবে। উদ্যোগটি প্রশংসনীয়, তবে এত বড় প্রকল্পের পুরোটিই প্রয়োজনীয় কি না, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন।
খাদ্য বিভাগ ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের সমন্বয়ের মাধ্যমে এসব কাঠামোগত সমস্যার আশু সমাধান করা জরুরি। বলে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষকের এই স্বল্প দাম পাওয়ার বড় কারণ সিন্ডিকেটের দুরভিসন্ধি। মিল মালিক থেকে শুরু করে বড় ব্যবসায়ী, আড়তদার, ফড়িয়া ব্যবসায়ী মিলে তৈরি হয় সিন্ডিকেট। পুরো ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের প্রতাপ আর কিছু দায়িত্বশীল পদে থাকা মানুষের নেতিবাচক ভূমিকা। এই বিপুল বাজার-ক্ষমতার ভারসাম্য এনে দুর্নীতি কমিয়ে আনা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে মতামত দেওয়া কঠিন। তবে ওপরে বর্ণিত কাঠামোগত সমস্যাগুলো সমাধান করা অপেক্ষাকৃত সহজ, এটি নির্দ্বিধায় বলা যায়। তাতে অন্তত কৃষকের দুর্দশার কারণ হিসেবে একটি অজুহাত কমবে!
লেখক: গবেষণা বিশ্লেষক, আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ইফপ্রি)
সারাবাংলা/টিআর