যাহা ৫৭, তাহাই ৩২
৩০ জানুয়ারি ২০১৮ ১৯:৫৫
একটা মাছ ভাজা হচ্ছিল ফুটন্ত কড়াইয়ে। তীব্র উত্তাপে কষ্ট সইতে না পেরে মাছটি লাফ দিলো। কিন্তু লাফ দিয়ে পড়লো জ্বলন্ত উনুনে। আমাদের দশা হয়েছে তাই। অনেক মামলা, হয়রানি, আন্দোলন, সংগ্রাম করে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলো। কিন্তু একটি ধারা গেলেও আসছে আরো ৫টি ধারা।
সরকার খুব কৌশলী ভূমিকাই নিয়েছে। আগে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা একসঙ্গে সবগুলো বিষয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। এবার চালাকি করে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি ৩২ ধারা।
মন্ত্রিসভায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনুমোদনের পর ফেসবুকে এ নিয়ে দেয়া স্ট্যাটাসে অনেকেই লিখেছেন, নতুন বোতলে পুরোনো মদ। কিন্তু বোতলটা নতুন, তবে মদটা পুরোনো নয়। ৩২ ধারা আরো কড়া। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার বিষয়গুলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ এই ৪টি ধারায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। কৌশলটা ভালো। একসঙ্গে দেখতে যতটা ভয়ঙ্কর লাগে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেলে ততটা লাগবে না। কিন্তু নতুন আইনে যে ৩২ নম্বর ধারাটি এসেছে, তাতে ৫৭ ধারার পাপমোচন তো দূরের কথা নতুন করে যে তীব্র সমালোচনাতেই পড়তে হল সরকারকে।
ব্যক্তিগতভাবে আমি কিন্তু সবসময় ৫৭ ধারার পক্ষে ছিলাম। আমি বিশ্বাস করি, মানুষকে বিশেষ করে নারীদের হয়রানির হাত থেকে রক্ষা করতে এ ধরনের একটি রক্ষাকবচ অবশ্যই দরকার। কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো, আমরা স্বর্গ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে কোনো একটা কিছু করি; কিন্তু স্বর্গটা আর পাই না, পড়ে থাকে উপসর্গগুলো। যেটা হতে পারতো রক্ষাকবচ, সেটাই হয়ে গেল মতপ্রকাশের গলার ফাঁস।
সাম্প্রতিক সময়ে বহুল অপব্যবহারে এটা প্রমাণিত, ৫৭ ধারা আর মতপ্রতাশের স্বাধীনতা একসঙ্গে চলতে পারে না। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(২) অনুচ্ছেদে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিকসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল’। সংবিধানে এমন স্পষ্ট বিধান থাকার পরও ৫৭ ধারার মত একটি ঢালাও ধারা দিয়ে এতদিন মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে গলা চেপে ধরা হয়েছে। নতুন আইনে এই চাপ আরো প্রবল হবে শুধু। বলা হচ্ছিল ৫৭ ধারার প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে। কিন্তু সমস্যাটা হলো, প্রয়োগ হয়নি, অপপ্রয়োগ হয়েছে ঢালাও।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা নিয়ে সাংবাদিকদের শঙ্কার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম বলেছেন, এই ধারায় কোথাও সাংবাদিকদেও কথা বলা হয়নি। পরদিন আইনমন্ত্রীও বলেছেন, এই ধারার সঙ্গে সাংবাদিকতার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই শঙ্কা অহেতুক। কিন্তু চুন খেয়ে আমাদেও মুখ পুড়ে গেছে, এখন দই দেখলেও ভয় পাই। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায়ও কোথাও সাংবাদিকদের কথা বলা ছিল না। কিন্তু ৫৭ ধারার সবচেয়ে বেশি অপপ্রয়োগ হয়েছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেই।
তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা আপনাদের সবার মুখস্ত। সেটি আর পুনরাবৃত্তি করছি না। তবে সে ধারায় কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ হলে অপরাধ হতো। আর এখন আরো পিছিয়ে যাওয়া হয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের আয়কর বেতন থেকে কেটে নেয়া হয়। একে বলে উৎসে কর্তন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারায় সাংবাদিকতাও উৎসে কর্তনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিস্তারিত বলার আগে দেখে নিই ৩২ ধারা ভয়ঙ্করে কী আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শাস্তি অনধিক ১৪ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আর এই অপরাধ যদি একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার করেন বা বারবার করেন তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’
সরকারের মন্ত্রীরা যতই বলুন, এই ধারা সাংবাদিকদের জন্য নয়, কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এই ধারার সবচেয়ে বড় শিকার হবেন সাংবাদিকরাই। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বলে একটি বিষয় আছে। সেটি শুধু বালাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই প্রচলিত। গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ছবি দিয়ে অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারির খবর ফাঁস হয়েছে। এখন বাংলাদেশে সেটি করলে, সাংবাদিকরা গুপ্তচর হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এবং ১৪ বছরের জন্য জেলে যেতে হবে।
আমি বলবো এই ধারায় সাংবাদিকতার ধার কমানোর সব আয়োজন সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। সাংবাদিকতা এখন হবে ‘করে নাকো ফোঁসফাঁস, মাওে নাকো ঢুশঢাশ’ মার্কা। এখন সাংবাদিকতা হবে পিআরও নির্ভর। সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার জনসংযোগ কর্মকর্তা যে প্রেস রিলিজ পাঠাবেন; উন্নয়নের যে ফিরিস্তি পাঠাবেন, তাই হুবহু ছেপে দেবো। সাংবাদিকরা লিখবে, ‘তিনি এই বলেন, তিনি সেই বলেন, তিনি আরো বলেন।’ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মৃত্যু ঘটবে, ব্যাপক প্রসার হবে উন্নয়ন সাংবাদিকতার।
দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে ডিজিটালের রাজপথে, আইন তখন আমাদের টেনে নিতে চাচ্ছে অ্যানালগ আমলে। তবে আমার ধারণা, সরকার এই ধারাটির প্রয়োগ করতে পারবে না। এখন শুধু পেশাদার সাংবাদিকরাই সাংবাদিক নয়। এখন সবাই সাংবাদিক। উৎসাহী জনতার হাতে হাতে এখন ক্যামেরা নামের অস্ত্র। স্মার্টফোনে তো ক্যামেরা আছেই; এখন চশমায় ক্যামেরা, কলমে ক্যামেরা, বোতামে ক্যামেরা। সবাই সাংবাদিক, সবাই গুপ্তচর। সবার হাতে গণমাধ্যম না থাকলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আছে। যে কোনো ঘটনার ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া এবং লাইভ করার সুযোগও সবার হাতে হাতে। এই সিটিজেন জার্নালিস্টরা ইতিমধ্যেই অনেক বড় বড় ঘটনা ঘটিয়েছেন। সর্বত্র বিস্তৃত এই সাংবাদিকতার গলা টিপে ধরার সাধ্য সরকারের নেই।
স্পষ্টতই বলতে চাই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে গলা টিপে হত্যা করবে আর সুরক্ষা দেবে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার দুর্নীতিবাজ কর্মকতা-কর্মচারিদের।
সারাবাংলা/এমএম