ধারা ৩২,অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা? ভুলে যান!
৩১ জানুয়ারি ২০১৮ ২০:১৩
অনেকেরই প্রশ্ন, কেন সাংবাদিকরা নিজেকে গুপ্তচর হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে? সহজ উত্তর, সরকার, রাষ্ট্র এখন আইনের মাধ্যমে আমাদের গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত করার পায়তারা করছে। যে কালো আইন সরকার করতে যাচ্ছে তাতে আমি শংকিত, ভীত এবং অন্য আরো অনেক চাকরির হাতছানি বাদ দিয়ে কেন এই পেশায় এসেছিলাম তা নিয়ে লজ্জিত। কারণ এই রাষ্ট্র এবং সরকার এখন মনে হয় সাংবাদিক ও সাংবাদিকতাকে তাদের পোষ্য করতে চায়। আর যদি তা না করা যায় তাহলে আইন এমনভাবে করা হচ্ছে যাতে করে আপনি নথদন্তহীন বাঘ হয়ে থাকবেন।
অনেকেই বলছেন, এখনে গুপ্তচর বৃত্তি করলে তাদের শাস্তি হবে। সাংবাদিকতা আর গুপ্তচরবৃত্তি তো এক নয়, সে কথাও বলছেন। তাদের যুক্তি এতে স্বাভাবিক সাংবাদিকতার কোন ব্যতয় হবে না। তাদের জন্য বলা, একবারের জন্যও কি পড়েছেন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাটি। যদি পড়ে থাকেন ভাল, না হয় আর একবার দয়া করে পড়ুন।
“কোন ব্যাক্তি বেআইনী প্রবেশের মাধ্যমে কোন সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত বা বিধিবদ্ধ কোন সংস্থার অতিগোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল যন্ত্র, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারন, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা করতে সহায়তা করেন তাহলে সেই কাজ হবে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচর বৃত্তির অপরাধ। আর এই অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। কেউ যদি এই অপরাধ দ্বিতীয়বার বা বারবার করেন, তাহলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।”
এটি পড়ে আমি যা বুঝেছি, আপনি যদি সরকার সংশ্লিষ্ট কোন অফিসে বেআইনীভাবে গিয়ে তাদের কোন গোপন নথিপত্রের ছবি তোলেন বা অন্য কোন ডিজিটাল যন্ত্রের মাধ্যমে সংগ্রহ করেন তাহলেই আপনি গুপ্তচরের অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।
যদি তাই হয় তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার সেরা অনুসন্ধানি রিপোর্ট হিসেবে থমসন ফাউন্ডেশনের পুরস্কার পাওয়া আমার ‘প্রকল্পঃ হাটি হাটি খাই” প্রতিবেদনটি বেআইনী কার্যকলাপের মধ্যে পড়ে। সেই সাথে গুপ্তচর বৃত্তির মতো গুরুতর অভিযোগ আমার বিরুদ্ধে আনা যায়। কারণ আমি মসজিদ, মন্দির, এতিমখানার নামে ২২ কোটি টাকা লোপাট প্রমাণ করার জন্য ঢাকা জেলা পরিষদ অফিসের চেক লেনদেনের রেজিস্টার, প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণসহ অনেক সরকারি কাগজ ভুয়া পরিচয়ে সংগ্রহ করেছি এবং গোপন ক্যামেরা নিয়ে গিয়ে দুর্নীতিবাজদের সাথে কথা বলেছি ও প্রচার করেছি। এখন যদি এই্ কাজ করি তাহলে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে মামলা কি আমার নামে করা হবে না?
মাত্র ছয় মাস আগে রংপুরে সাড়ে চারশত অস্ত্রের ভুয়া লাইসেন্স দেয়ার প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ঢুকে তাদের গোপন শাখা জুডিশিয়াল মুন্সিখানায় গিয়েছিলাম । অস্ত্রের লাইসেন্স দেয়ার মুল রেজিস্টারের ছবি তুলেছি গোপন ক্যামেরায়। ওই শাখায় সব ভুয়া লাইসেন্সের কাগজপত্র রাখা আছে, এটা জেলা প্রশাসককে জানানো পর তিনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছেন আমি সেখানে ঢুকলাম কিভাবে, আমার কাছে সব কিছুর ছবি আছে কিনা। আমি বলেছি সব প্রমান আমার কাছে আছে। তারপর তিনি নিজে সব কিছুর প্রমাণ পেয়েছেন। কিন্তু এখন কি এমনটা করলে আমার পার পাবার নিশ্চয়তা আছে? মিথ্যা পরিচয় দিয়ে সরকারি অফিসের গোপন শাখায় যাওয়া কি বেআইনী প্রবেশের অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে না? আর তাদের ভাষায় গোপন নথির ছবির তুলে কি আমি গুপ্তচরের অপরাধ করছি না ? এখন তো দুর্নীতির কোন খবর সংগ্রহ করতে সরকারি অফিসে গেলেই দুর্নীতিবাজরা এক জোট হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনবেন।
আইনমন্ত্রী বলছেন, ” গুপ্তচরবৃত্তি আর সাংবাদিকতা এক নয়, দুর্নীতির খবর করলে এই আইন প্রযোজ্য হবে না।” আপনি কিভাবে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন মন্ত্রী বাহাদুর? আইনের প্রতিটা প্রয়োগ কি আপনাকে জিজ্ঞেস করে হবে? ৫৭ ধারা অপপ্রয়োগের শিকার কিন্তু সাংবাদিকরাই বেশি হয়েছেন।
বানিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ তো বলেই দিয়েছেন এমপিদের বিরুদ্ধে খবর বন্ধ করার জন্য এই আইন করা হয়েছে। বলার কি আর কিছু বাকি আছে? এই আইন যারা তৈরি করেছেন, তাদের উদ্দেশ্য তো পরিস্কার। অকাট্য তথ্য উপাত্ত দিয়ে যাতে কেউ কোন দুর্নীতির খবর করতে না পারেন সেই ব্যবস্থা করা। আর যদি যথাযথ কাগজপত্র আপনার হাতে না নিয়ে রিপোর্ট করেন তো আপনি মিথ্যা খবর পরিবেশনের দায়ে মানহানির মামলা খাবেন। আর যদি কাগজপত্র হাতে নিয়ে তা আপনার কাছে আছে বলে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন তৈরি করেন, তাহলে তো দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচর বৃত্তির অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। তাই অনুসন্ধানি সাংবাদিকতা এখন অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাই আসুন এই পেশায় থাকতে চাইলে ফুল, ফল, লতা পাতা, বাম্পার ফলন, দেশে আজ শান্তির সুবাতাস, “দুর্নীতি শব্দটি সবাই ভুলে গেছে”, এসব নিয়ে রিপোর্ট করি। আর যদি এখনো আশা থাকে সাংবাদিকতা বাঁচিয়ে রাখব, তাহলে প্রতিবাদ করি।
পারভেজ রেজা, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ৭১ টিভি
সারাবাংলা/এমএম
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই কলামে তুলে ধরা সকল মতামত লেখকের নিজস্ব।