আমারির অফার ও আমাদের অভ্যাসের নাচানাচি!
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১০:২৮
গত কয়েকদিন ধরে ফেসবুকে ঝড় তুলেছে ভ্যালেন্টাইন দিবস উপলক্ষে ‘আমারি ঢাকা’ হোটেলের একটি বিজ্ঞাপন। মূলত বিজ্ঞাপনটির চোখ কপালে উঠানোর মত অর্থমূল্যকে সবাই সমালোচনার বাক্যবাণে বিদ্ধ করছেন। ফেসবুকজুড়ে হচ্ছে নানা ধরনের ট্রল ও স্যাটায়ার। প্রতিদ্বন্দ্বী নানা প্রতিষ্ঠান সেই বিজ্ঞাপনের প্রতি বিজ্ঞাপন হিসেবে আপাত কম মূল্যে নানা অফার দিচ্ছেন। চলুন জেনে নেয়া যাক কি ছিলো সেই বিজ্ঞাপনে?
গুলশান-২ এর ৪১ নম্বর রোডে অবস্থিত আমারি ঢাকা একটি চার তারকা মানের হোটেল। আসন্ন ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে তারা একটি বিশেষ ভ্যালেন্টাইন প্যাকেজ অফার করেছে যার মূল্যমান ধরা হয়েছে নয় লক্ষ টাকা, ভ্যাটসহ সর্বমোট খরচ হবে এগারো লক্ষ আটত্রিশ হাজার পাঁচশত টাকা। ‘অন ক্লাউড নাইন’ নামের এই প্যাকেজ গ্রহীতা কাপল পাবেন লিমুজিন কারে পিক এন্ড ড্রপ, হেলিকপ্টারে করে ঢাকা সিটি স্কাই ট্যুর, হোটেলটির ১৮ তলার রুফটপে ৯ কোর্সের বিশেষ ডিনার যাতে রয়েছে নানান দেশের বিখ্যাত সব খাবার, ব্যাক্তিগত বাটলার, স্পা সুবিধা এবং রয়েল হানিমুন স্যুটে একরাত থাকার সুযোগ।
বাংলাদেশের সমসাময়িক আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে আক্ষরিক অর্থেই চোখ কপালে উঠার মতো খরুচে অফার এটি। কিন্তু তবুও একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিনা কেন আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়লাম এই অফারের সমালোচনা করার জন্য? আমাদের বক্তব্যটা আসলে কি? কিংবা আমাদের সমালোচনার ন্যারেটিভটাই কি? আমারি হোটেল কর্তৃপক্ষ স্পষ্টতই বলছে তারা সমাজের উচ্চবিত্ত একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে টার্গেট করে এই প্যাকেজটি সাজিয়েছে এবং কেবলমাত্র একটি কাপল এই বিশেষ অফার গ্রহন করতে পারবে। অর্থাৎ তাদের টার্গেট পিপল আমি বা আপনি না। এটা আমজনতার জন্য দেয়া অফার না। তাহলে আমাদের কেন এতো মাথাব্যথা? নাকি আমরা আমাদের সমাজের সেই উচ্চবিত্ত শ্রেণির অবস্থানকে স্বীকার করতে পারছিনা কিংবা স্বীকার করতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে? আঙ্গুর ফলটা কি আমাদের একটু বেশিই টক মনে হচ্ছে?
আমার লিখার উদ্দেশ্য মোটেও আমারি হোটেলের বিজ্ঞাপনের প্রশংসা করা না কিংবা তাদের প্যাকেজের প্রমোশন করা না। আদার ব্যাপারী হয়ে জাহাজের খবর নিয়ে তো লাভ নেই। বরং আমার লিখার উদ্দেশ্য হলো সব বিষয়ে আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন আসলে কতটা যৌক্তিক কিংবা সেই প্রতিক্রিয়া প্রদর্শনের উপায়টা আসলে কি হওয়া উচিত সেই ব্যাপারে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করা।
একথা স্বীকার করতেই হবে মার্কেটিং পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বিবেচনা করলে আমারি হোটেল কর্তৃপক্ষের আলোচ্য বিজ্ঞাপন শতভাগ সফল। এতো বড় পরিসরে তাদের হোটেলের মার্কেটিং হবে এটা হয়তো তারা নিজেরাও ভাবতে পারেনি। একটি অফারের কল্যাণে আমারি হোটেলের নাম আজ মানুষের মুখে মুখে না হলেও ফেসবুকের স্ট্যাটাসের স্ট্যাটাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিংবা এমনও হতে পারে আমাদের ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মানসিকতা বিশ্লেষণ করেই তাদের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট এই প্যাকেজ অফার করেছে। যাই হোক না কেন আমারি হোটেল কর্তৃপক্ষ তাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পেরেছে। এই অফারটি এখন আর শুধু নিছক একটি অফারে সীমাবদ্ধ নেই। বরং আমারি হোটেল কর্তৃপক্ষ সমাজের যে অংশকে টার্গেট করেছে তাদের কাছে এটা এখন একটি ‘শো অফ’ এলিমেন্ট হিসেবে বিবেচিত হবে, তাদের প্রেস্টিজ ইস্যুতে পরিণত হবে। আমাদের নেগেটিভ প্রচারনা বরং এই অফারে প্রতিনিয়ত ভ্যালু অ্যাড করেছে অর্থাৎ অফারটির ব্র্যান্ডভ্যালু বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই প্যাকেজটির জন্য আমারি হোটেল কর্তৃপক্ষের ক্লায়েন্ট পেতে এখন কোন সমস্যা হবে না বলেই আমার ধারনা।
বেশিরভাগ মানুষের সমালোচনা দেখে মনে হচ্ছে তারা আসলে নয়লাখ টাকার বিষয়টিকে মানতে পারছেন না। অর্থাৎ প্যাকেজটি এতো বেশি খরুচে হওয়াটাই মূল সমস্যা। কিন্তু খরচ ব্যাপারটিকে কি আসলে সুর্নিদিষ্ট কোন মাপকাঠিতে ফেলা যায়? এটা তো পুরোপুরি সামর্থ্যের উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ফুটপাত থেকে কেনা পাঁচশো টাকার ব্লেজার যেমন অনেকের চাহিদা মেটায় তেমনি অনেকে আবার তার ডিজাইনার চয়েজ স্যুটের সেলাইয়ের মজুরি বাবদও পঞ্চাশহাজার টাকা খরচ করতে পারেন। অনেকে টং দোকানে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই তাদের নিত্য আড্ডা সেরে নেয়, কারও আবার গ্লোরিয়া জিন্সের কফি ছাড়া অন্য কিছু মুখে রুচে না। ঢাকা শহরের সিংহভাগ মানুষ যেমন এখনো পাবলিক বাসে চলাচল করে ঠিক তেমনি এই ঢাকার রাস্তাতেও অহরহ মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউ কিংবা অডি গাড়ির দেখা মিলে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেমন বিনাবেতনে আমাদের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করছে ঠিক তেমনি ঢাকার আইএসডি স্কুলে সন্তানের প্রি স্কুলিং শেষ করার জন্য অনেক অভিভাবক একচল্লিশ হাজার ডলার (প্রায় তেত্রিশ লাখ টাকা) ব্যয় করছে। এই বৈপরীত্য তো আমাদের সমাজের নির্মম বাস্তবতা। তাহলে আমরা কেন এটা মানতে পারছি না? আমাদের না মানাতে কি পরিস্থিতির আদৌ পরিবর্তন হচ্ছে?
আমারি হোটেলের অফারকে ট্রল করে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রতি বিজ্ঞাপনী অফার তৈরি করেছে। এর মাঝে লেকশোর হোটেল এবং ট্যুর ম্যানেজমেন্ট সাইট ট্রিপিং এর বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা যে দোষের জন্য আমারি হোটেলের বিজ্ঞাপনের সমালোচনা করেছে ঠিক একই দোষে তাদের বিজ্ঞাপনগুলোও দুষ্ট। লেকশোর হোটেল ভ্যালেন্টাইনডেতে চারহাজার টাকায় কাপলদের জন্য ডিনার অফার করেছে। আর ট্রিপিং সাইট ভ্যালেন্টাইন উপলক্ষ্যে নয় লাখ টাকায় ইউরোপ বিভিন্ন দেশের ট্যুর প্যাকেজ অফার করেছে। কিন্তু তারা কি এটা ভেবে দেখেছে যে আমাদের সমাজে আসলে কতজন এই চারহাজার টাকার ডিনার অ্যাফোর্ড করার সামর্থ্য রাখে কিংবা কতজন ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষ্যে ইউরোপ ট্যুরে যাবার সামর্থ্য রাখে। লেকশোর কিংবা ট্রিপিং কর্তৃপক্ষ যেমন তাদের টার্গেট পিপলের বাউন্ডারি ফিক্সড করেছে ঠিক তেমন আমারি হোটেলও করেছে। কিডনি বিক্রি করে যাদের নয়লাখ টাকা জোগাড় করতে হবে তাদের জন্য তো এই অফারগুলো না। এই সহজ ব্যাপারটা কেমন আমরা মানতে পারছি না?
মজার ব্যাপার হলো, এই ধরনের যেকোন ইস্যুতে আমরা আমজনতা হুজুগে নাচি। কর্পোরেট কোম্পানিগুলো ঠিকই তাদের টার্গেট ফিক্সড করতে পারে। সেই অনুযায়ী তাদের প্রফিটও বের করে নিতে পারে। আমরাই বরং আমাদের টার্গেট ঠিক করতে পারি না। যা বলা উচিত না কিংবা যে বিষয়ে বলে কোন লাভ নেই, সেই বিষয়ে অনেক কিছু বলি। অন্যদিকে যে বিষয়ে বলা উচিত সেটাকে বরং অনেকক্ষেত্রে পাশ কাটিয়ে যাই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতার কারণে আজ আমরা সবাই বিশেষজ্ঞ। যেকোন বিষয়েই নিজের মতামত, পাল্টা মতামত দিয়ে ফেসবুক গরম করে ফেলি। কিন্তু আসলেই তাতে সমাজের কি উপকার হয় সেটা ভাবি না। আপাত অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে হাইপ সৃষ্টি করে আমরা বরং জরুরি অনেক বিষয়ে কথা বলতে ভুলে যাই, ভয়েস রেইস করতে ভুলে যাই। আমাদের এই অভ্যাসের পরিবর্তন করা জরুরী। তা না হলে আমরা নিজেরা বারবার অন্যের মার্কেটিং ইলিমেন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হব, ক্ষেত্রবিশেষে হবো গিনিপিগ।
জীবনমুখী গানের শিল্পী নচিকেতা তার লাইভ পারফরমেন্সে গানের পাশাপাশি সমাজের অসংগতিকে কটাক্ষ করে অনেক কথা বলেন। শাসনব্যবস্থাকে বিদ্রুপ করে গাওয়া একটি গানের মাঝেখানের কথাগুলো ছিলো এরকম। কর্পোরেশন নির্বাচনে একটি দল জয়ী হয়েছে। তাদের সমর্থকরা মিছিল নিয়ে হোলি খেলায় মেতে উঠেছে। তো পাড়ার এক পরিচিত ছেলেও সেই মিছিলে সামিল হয়েছ। নচিকেতা তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
কিরে তুই নাচছিস কেন? সেই ছেলের উত্তর, দাদা লাল্টু দা জিতে গেছে।
লাল্টু দা জেতায় তোর কি হয়েছে? সেই ছেলের উত্তর, আরে দাদা বল্টুদা হেরে গেছে।
তাতেই বা তোর কি লাভ হয়েছে? তুই নাচছিস কেন?
এবার অনেকক্ষন মাথা চুলকিয়ে ছেলেটি উত্তর দিল, আমি দাদা অভ্যাসে নাচি মাইরি!
অনলাইনে আমাদের অবস্থা হয়েছে এরকম। বেশিরভাগ ইস্যুতেই এখন আমরা শুধু অভ্যাসেই নাচি।
আমিনুল হক পলাশ, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা
সারাবাংলা/এমএম