Sunday 13 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্বান্দ্বিক স্বার্থবাদ ও ‘যদি থাকে নসীবে’ প্রসঙ্গ


৩ আগস্ট ২০১৯ ০৯:১২ | আপডেট: ৩ আগস্ট ২০১৯ ১৫:২৮
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক’দিন বাদে ঈদ। এমনই এক ঈদে বাড়ি গেলাম, পুকুর পাড়ে বসে রাজা-ঊজির মারার হাজারো কল্পনা যখন ভনভন করছে ঠিক সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে পড়ুয়া এক স্কুলবন্ধু মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পাশে এসে বসে কানে একটা কালো ভ্রমরা গুঁজে দিয়ে বললো ’এই নাও ডুড একটা জবরদস্ত গান শুনে ফেলো’। অমনি শুনি গগনবিদারী চিৎকার- যদি থাকে নসীবে…। ওর আচমকা এমন টেনে টেনে কথা বলা আর সব বাদ দিয়ে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর বুঝলাম ও নিজেই হাঁক ছেড়ে বলছে ওটা। খানিকপর খেয়াল করলাম মাথার ভেতরে ভনভন করা কল্পনারা এবার যেন পাকা কাঁঠাল পেয়ে জেঁকে বসেছে; তারা সুরে সুরে বলছে মফস্বলে শৈশব পার করা এই বর্তমান শহুরে ছেলেরা মনে মনে ভাবে গতির বিজ্ঞান আর কানে শুনে নসীবের গান। ফিজিক্স আর মেটাফিজিক্স এর এই দ্বন্দ্ব শুধু একজন বা দুজনের মাঝে নয়। দ্বন্দ্ব সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

বিজ্ঞাপন

বিখ্যাত দার্শনিক হেগেলের মতে, এ দ্বন্দ্ব খারাপ কিছু নয়। বরং তিনি বলেন, জীবন বিকাশ লাভ করে দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায়। সে প্রক্রিয়া বিশ্লেষণে হেগেল দেখান যে মানুষের জীবনে প্রতিনিয়ত তিনটি ধাপ পার করতে হচ্ছে -প্রস্তাব(Thesis),প্রতিপ্রস্তাব(Anti-thesis),সংশ্লেষণ (synthesis)। ব্যাপারটি এমন যে প্রথমত কেউ একজন বাসা থেকে বের না হওয়ার কথা ভাবলো (Thesis), কিন্তু পরিবারের চাপে বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে বাসা থেকে বের হলো (Anti-thesis)। বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে সিদ্ধান্ত নিল পরেরবার বের হলে অবশ্যই হেলমেট ছাড়া বাইরে যাবে না (synthesis)। সিনথিসিসের মাধ্যমে প্রাপ্ত নতুন চিন্তাটি আবার নতুন প্রস্তাব(থিসিস) হিসাবে পরিগণিত হয়, আবার একটা পর্যায়ে এর প্রতিপ্রস্তাব (এ্যান্টিথিসিস) আসবে। একইভাবে “থিসিস” ও “এ্যান্টিথিসিসে”র সংশ্লেষণে নতুন থিসিস তৈরি হবে এবং এভাবে সভ্যতার বিকাশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়া চলতে থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। চিরন্তন এই প্রক্রিয়ায় পুরাতন সমাজ ভেঙে নতুন সমাজের জন্ম হবে। সভ্যতা বিভিন্ন স্তরে উন্নীত হবে। প্রশ্ন হল,এই প্রস্তাব-প্রতিপ্রস্তাবের ভীড়ে বাঙালিদের জীবনে যে নতুন আঙ্গিক আসে তা সত্যি অভিনব।

কেউ কেউ এই দ্বান্দ্বিকতার সাথে বস্তুবাদকে মিলেয়ে দেখতে চেয়েছেন। পৃথিবীর তাবৎ মানুষের কাছে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ বা Dialectical Materialism পরিচিত হলেও বাঙালি এক নতুন স্বরূপ উন্মোচন করেছে। আমার কাছে মনে হয় এর নাম দেয়া যেতে পারে দ্বান্দ্বিক স্বার্থবাদ। এই বদ্বীপে বিচার মানি তালগাছ আমার নামের যে প্রবাদ আছে তাতে খুব সহজে অনুমেয় যে এ অঞ্চলে তর্ক-বিতর্ক’র পর সম্মিলন নয় বরং স্বার্থলেহনে সমাপ্তি ঘটে। আর এ অভ্যেস শুধু ব্যক্তিবিশেষে নয়। হাতের রেখা কম বেশি হলেও সবারই যেমন থাকে ঠিক তেমনি আমদের জীবনে স্বার্থলেহনের দাগ এঁকেবেঁকে গেছে বহুদূর। আমরা এতটাই স্বার্থমগ্ন থাকি যে জীবনের ঘাতপ্রতিঘাতে আপন ভালো পাগলেও বোঝার মত অবস্থা। নিজের ভালো লাগা, ভালো থাকাটাই মুখ্য হয়ে উঠে। সত্য বা বাস্তবতার ‘থোরাই কেয়ার’ করি।

দুর্ণিতির টাকায় চোরাই পথে হজ্বে যাওয়া, ভারতকে গালি দিয়েই হিন্দি গানে মজে যাওয়া, জানালা দিয়ে ময়লা ফেলে সিটি কর্পোরেশনকে গালি দেওয়ার মতো ঘটনা হরহামেশাই চলে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই এখানে স্বার্থ দেখার তালে। যেন কেউ নেই স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ন্যূনতম দায়িত্বটুকু পালন না করে ছাত্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে কেন তাকে সুবিধা দেয়া হবে না। ক্লাস, গবেষণা কিংবা সামজিক কাজে শতভাগ না দিয়ে শিক্ষক লেজুড়বৃত্তি ছাড়ছে না। জনগণের টাকায় জনগণের কর্মকর্তা নয় সরকারি কর্মকর্তা হয়ে হুমকি দিচ্ছে জনগণকে। সেবার শপথ নেয়া সাদা এ্যাপ্রোনের নিচে কিলবিল করে ভিজিট বেশি নেয়ার নষ্ট কীট। সমস্ত কিছুতে আজ দ্বান্দ্বিক অবস্থা, বিশেষ ধরনের এক বিপরীত সত্তা উপস্থিত। প্রতিটি দ্বন্দ্বের আলাদা আলাদা রূপ রয়েছে। প্রতিনিয়ত এ দ্বন্দ্বে আমরা স্বার্থবাদী হয়ে উঠছি। যখন রাস্তায় বের হই গণপরিবহনে থাকলে বলি -কেন একজন মানুষ একা একটি প্রাইভেট কার নিয়ে বের হবে? প্রাইভেট কারে থাকলে বলি- দেশটাকে রিকশাওয়ালারা শেষ করে দিল। রিকশায় থাকলে উত্তেজনায় বারবার দাঁড়িয়ে গালি দেই বাসচালককে। মটরবাইকে বসে বলি- মাঝখান দিয়ে চলে যান। সামাজিক দ্বান্দ্বিক বাস্তবতায় আমরাই বরং এমন এক মাঝপথ বের করেছি যেখানে শুধু স্বার্থ।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ‘ভিআিইপি’ বিতর্ক নিয়েই ভাবুন একবার। আমি বিশ্বাস করি একজন ইউএনও, সচিব জীবেনে বহুবার বহু অনুষ্ঠানে ভিআইপি গেস্ট হয়েছেন। আর সেসব অনুষ্ঠানে নিয়মানুবর্তীতা, জনমানুষের পাশে দাঁড়ানো, গরীব দুখীকে সাহায্য করা ইত্যাদী বিষয়ে কথার ফুলঝুরি দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন অনেককে। অথচ কী আশ্চর্য দেখুন নিজের বেলায় হয়ে উঠছেন চরম স্বার্থবাদী। এই মনিুষটিই তাঁর আশেপাশের মানুষকে শেখান-সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। একজন মানুষ রাতদিন সিস্টেমকে গালি দিয়ে ক্লান্ত সে মুহূর্তে যখন টিকিট কাটতে যায় তখন নিজেই ‘সিস্টেমে’ (লাইনে দাঁড়ানো অন্যের হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে) টিকিট কেটে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে। এই বিষয়ে আপনি যদি তাঁকে কোন প্রশ্ন করেন তবে উল্টো আপনি প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন-কীয়েক্টাবস্থা দেখেছেন?

কীয়েক্টাবস্থার এই যুগে যতজন মানুষ বাবা-মাকে ফেসবুকে ভালবাসেন তার সিকিভাগ ভালবাসা থাকলে হয়তো অনেক বৃদ্ধাশ্রম নির্বাসনে যেত। যে সমাজে শিশু অধিকারের কথা চলে নিজের শিশুর দেখাশুনার ভার অন্য এক শিশুর হাতে তুলে দিয়ে, কিংবা সারাক্ষণ ধর্মের বাণী বিলিয়ে বেড়ান যিনি তিনিই যখন লোলুপ দৃষ্টি মেলেন বুঝতে বাকি থাকে না সে সমাজে কীয়েক্টাবস্থার যুগ চলছে। আমরা ইতিহাসে নানান যুগের কথা শুনেছি কিন্তু সম্ভবত এমন যুগ এ বঙ্গদেশ ছাড়া আর কোথাও মেলা ভার। সত্যি এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেন না যেখানে নিজেদের স্বার্থে নারী ফুটবলারদের জয়কে কাজে লাগাতে পারি কিন্তু নিরাপদ বাড়ি ফেরার নিশ্চয়তা দিতে পারি না; যে দেশের মেধাবীদের অলিম্পয়াড জয়কে নিজের বিদেশ ভ্রমণের কারণ বানাতে পারি তাদের ছাড়াই।

একবার ভাবুনতো একদল মানুষ দিনরাত চিন্তা করে যাচ্ছেন, যাদের আমি-আপনি চিন্তাবিদ, বুদ্ধিজীবি বলি কিছু একটা পরিবর্তনের জন্য। অথচ দিনশেষে দেখি অবস্থা যে তিমিরে ছিলো সে তিমিরে আছে, শুধু তাদের কপাল তিমি’র আকার ধারণ করেছে। প্রতিনিয়ত নীতিকে দূরে ঠেলে নয় বিক্রি করে খাওয়া এরা নীতিবাজ। এই নীতিবাজেরা অনুষ্ঠান শেষে খামভর্তি স্বার্থ পেলেই হল। শুরুতে যে দ্বন্দ্ব তত্ত্বের নাম নিয়েছিলাম তার শেষ অংশের নাম ‘নেতির নেতিকরণ’। কিন্ত আমার দেশের এ মহান দার্শনিকেরা নীতির নেতিকরণ করেছেন। আর তাই এখানে জন্ম নিয়েছে দ্বান্দ্বিক স্বার্থবাদ। এতে অবশ্য তাদের কোন খেদ নেই। বরং রাত্তিরে খাস বাগানে বসে গরম জল, নরম কোল আর তার সাথে বগল বাজিয়ে গান ধরেছেন- যদি থাক নসীবে, আপনি আপনি আসিবে। সে জানে তার খামভর্তি স্বার্থ ঘরে এসে পৌঁছে যাবে। কারণ একটু আগে সে যে দ্বন্দ্ব তত্ত্ব শিখেয়েছে মানুষকে সেখানে-(১)গুনগত পরিবর্তনে রুপান্তর নয় আছে মনমত উন্নয়নের রুপান্তর; (২)বিপরীতের ঐক্য নয় আছে পীরিতের ঐক্য; (৩)নেতির নেতিকরন নয় রয়েছে নীতির নেতিকরণ ।

মাহমুদুল হক : সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]

দ্বান্দ্বিক স্বার্থবাদ মাহমুদুল হক যদি থাক নসিবে

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর