বাঁচাও মানুষ
৫ আগস্ট ২০১৯ ১৭:৪৬
১৯৯৮ সালের ভয়াল বন্যার কথা মনে আছে অনেকের। সে সময় কিংবদন্তি শিল্পী প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুর একটা অ্যালবামের কথা মনে আছে এখনও। ‘বাঁচাও বিধাতা’ শিরোনামের সেই অ্যালবাম সাড়া ফেলেছিল খুব। সাউন্ডটেকের ব্যানারে সেই অ্যালবামের বিক্রয়ের পুরো টাকা বন্যার্তদের জন্যে দান করার কথা জানানো হয়েছিল সেসময়।
আইয়ুব বাচ্চুর সেই মানবিক উদ্যোগ উল্লেখের কারণ দেশের দুর্দিনে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের একাত্ম হয়ে যাওয়ার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা। মানুষের কষ্টে কেঁদেছিল তার শিল্পীমন, সিগনেচার কণ্ঠে জানিয়েছিলেন মানুষকে বাঁচাতে মানুষের এগিয়ে আসার আহ্বান-অনুরোধ। সেই আহ্বানে মানুষ সাড়া দিয়েছিল নিশ্চয়ই। শিল্পীর শৈল্পিক দরদভরা কণ্ঠ আর আহ্বানে সে সময় আমিও কিনেছিলাম একটা অ্যালবাম, উদ্দেশ্য বন্যার্তদের সাহায্যে সামান্য হলেও সহায়তা। ওই সহায়তার পরিমাণ অল্প হলেও এতে করে দেশের সকল জায়গার মানুষের একটা উদ্দেশ্যে অবদান রাখার সুযোগের পথ প্রশস্ত করেছিল।
সেই বন্যাসহ প্রতিবারই দেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে বন্যা হয়। জলে ভাসে মানুষ, গবাদিপশু, ডুবে যায় খেতের ধান, ভেসে যায় মাছ, বিবর্ণ হয়ে যায় মানুষের স্বপ্ন, অসহায় হয়ে পড়ে অগণন মানুষ। পানিবন্দি সে মানুষগুলোর অন্যের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকার উপায় থাকেনা। তারা তাকিয়ে থাকে। কখনও সাহায্য আসে, তবে সে সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক। খেয়ে, না খেয়ে থাকা সেই মানুষগুলোর এই সীমাহীন দুর্দশার ব্যাপ্তি বাড়ে। পানি বাড়ে, সঙ্গে বাড়ে কষ্টও। এরপর একটা সময়ে পানি কমে গেলেও আরেক বিপত্তি হয়ে দেখা দেয় রোগবালাই। সে আরেক কষ্টের উপাখ্যান।
দেশে এবারও এসেছে বন্যা। উত্তরের জেলা কুড়িগ্রাম এবার সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। কষ্টের দিন যাপনে লক্ষাধিক লোক। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে ঠিক, তবে সেটা বরাবরের মতই প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপনের একটা প্রতিযোগিতা আছে ওখানে। প্রচারের আলোর পিঠে আঁধারে ঢাকা পড়ে বুভুক্ষু মুখ। সেই মুখে কতখানি আহার ওঠে সে হিসাব ক’জনের!
সময়টা যখন প্রচারের তখন অনেকের কাছে এই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম স্রেফ লোক দেখানো। এটা বেসরকারি পর্যায়ের কিছু লোকজনের কেবল নয়, সরকারি পর্যায়ের অনেকের ক্ষেত্রেও। ফলে বাইরের ঠাটে সমূহ আলো রেখে ত্রাণের যা কিছু কাজ তার অনেকটাই লোক দেখানো। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের লাভ হয়না কোনো, তারা প্রচারের প্রপঞ্চ হয়ে ওঠে আসে অনলাইন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, গণমাধ্যম ও টেলিভিশনে। অমানবিক মানুষগুলো অসহায়দের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে নিজেদের মূলধনে যোগ করে আরও কিছু উপাদান। বাজারে বিক্রি করে বুভুক্ষু মুখ! এরা দুর্ভোগ ব্যবসায়ী। মানুষের দুর্ভোগ, দুর্বিপাকেও নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত।
এ বন্যার কালেও এমন হয়েছে, হচ্ছে এবং হবেও হয়ত। হবে বলতে হচ্ছে কারণ মানবিক শিক্ষা আর স্বার্থপরতা- এ দুইয়ের মধ্যিখানের ভেদ বুঝার সামর্থ্য অর্জন করেনি অনেকেই। মানবিক সীমাবদ্ধতা আষ্ট্রপৃষ্টে ধরেছে তাদের ব্যক্তিগত লাভালাভের নিকাশে। অজ্ঞানে নয়, সজ্ঞানে চালিত এই কার্যধারায় কতখানি লাভবান হয় অসহায়েরা সে হিসাবের চাইতে দিনশেষে নিজেদের কতখানি লাভ এ হিসাবটাই মুখ্য তাদের।
মানবিকতা নিয়ে ব্যবসায় নেমে যাওয়া মানুষদের এই সংখ্যাটা বেশি হলেও এখনও মানুষের দুঃখে মানুষ কাঁদতে জানে, এগিয়ে আসতে জানে; এগিয়ে আসেও। এই বন্যায়ও মানুষ বাঁচাতে মানুষ এগিয়ে এসেছে, আসছে আরও, হয়ত আগামিতে এই সংখ্যা বাড়বেও। মানবিক মানুষ জানে স্রেফ সরকারি উদ্যোগ মানুষকে পুরোপুরি সহায়তা দিতে পারেনা। মানবিক মানুষ জানে সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে বেসরকারি পর্যায়ের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উদ্যোগগুলো পালন করতে পারে বিশাল ভূমিকা। ঠিক এই কারণে এবারও বন্যা কবলিত মানুষের পাশে অন্য মানুষেরাও এসে দাঁড়িয়েছে। বন্যা এবার প্রচারের দিক থেকে পিছিয়ে, কারণ মূলত দেশের কেন্দ্র অর্থাৎ রাজধানীতে মহামারি আকার ধারণ করতে যাওয়া ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ। রাজধানীতে এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরে একের পর এক আক্রান্ত হওয়া, সিভিল সার্জন, ডাক্তার, পুলিশ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমলার স্ত্রীসহ অনেকের মৃত্যু এবং দায়িত্বশীল স্বাস্থ্যমন্ত্রী, ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রদের দায়িত্বহীনতা, প্রকৃত চিত্র অস্বীকারের প্রাণান্ত অপচেষ্টা, সারাদেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে এবার বন্যা খুব বেশি আলোচনায় নেই।
গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মন্ত্রী-এমপিদের বন্যা নিয়ে আলোচনা না করার পরেও বন্যার কবলে অনেকটা নিরবেই পড়েছে অনেকেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ি বন্যায় মৃতের সংখ্যা শতাধিক, সরকারি এই সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার চাইতে কম বলেই ধারণা করা যায়। কারণ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে মানুষের মৃত্যুর খবর কম করে দেখানোর একটা রাষ্ট্রীয় প্রবণতা দৃশ্যমান। চলমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সেই বিষয়টা আবারও সামনে এসেছে। দেশের সবগুলো গণমাধ্যম যেখানে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে মৃতের সংখ্যা অর্ধশতাধিক (দিন-দিন বাড়ছে) জানিয়েছে সেখানে সরকারি হিসাবে সেটা এখনও এক অঙ্কের সংখ্যায়। ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যার মত বন্যায়ও মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকারের পরিসংখ্যানগত লুকোচুরিকে তাই ধর্তব্য ও সন্দেহের মধ্যেই রাখতে হয়।
শুরু করেছিলাম কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর দুই দশক আগের এক উদ্যোগ প্রসঙ্গের উল্লেখে। লেখক-শিল্পী সমাজের এই সামাজিক দায়বদ্ধতা আশাবাদী হওয়ার মত খবর। এই সময়ে শিল্পী সমাজের পক্ষ থেকে সেইধরনের কোন উদ্যোগ লক্ষণীয় না হলেও গত দুর্যোগের ধারাবাহিকতায় এবারও বন্যাকবলিত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে লেখক সমাজ। ‘বন্যাকবলিত মানুষের পাশে লেখক সমাজ’ শিরোনামে এবারও এক উদ্যোগে শামিল হয়েছেন অনেকেই। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেনসহ আরও কয়েকজন। আছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, ইমদাদুল হক মিলন, জাকির তালুকদার, নাসরীন জাহান, এনামুল করিম নির্ঝর, পাপড়ি রহমান এবং আহমাদ মোস্তফা কামাল। এই উদ্যোগের সমন্বয়ক হিসেবে আছেন চঞ্চল আশরাফ, শাহেদ কায়েস, স্বকৃত নোমান, অরবিন্দ চক্রবর্তী, মোজাফফর হোসেন, হামিম কামাল, জাহরা জাহান পার্লিয়া, অপর্ণা হালদার এবং খন্দকার আরিফ। বন্যার্তদের কষ্টে তাদের প্রাণ কেঁদেছে বলে রাজধানীতে বসে উদ্যোগ নিয়ে ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত এলাকা কুড়িগ্রামে, মানুষের কাছ থেকে সহায়তা নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন।
মানবিক মানুষ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ। সৎ লেখকদের সমাজ-দেশ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশিত হয় লেখনিসহ সার্বিক আচরণে। লেখকদের এই সামাজিক দায়বদ্ধতায় গতবারের মত এবারও উপকৃত হচ্ছে আলোচনার বাইরে থাকা, প্রশাসনিক গুরুত্বের তলানিতে থাকা বন্যায় আক্রান্ত উত্তরের প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষেরা। এই সহায়তা প্রচেষ্টা কোনধরনের প্রাপ্তিযোগের আকাঙ্ক্ষাবিহীন, নিঃস্বার্থ, এবং ব্যক্তি ও লেখকসমাজের সামাজিক দায়বোধ থেকে।
দুর্যোগ-দুর্বিপাকে প্রতিনিধিত্বশীল মানুষদের এগিয়ে আসা উচিত। লেখক সমাজের একটা অংশ এগিয়ে এসেছে। অন্যেরাও আস্তে আস্তে এগিয়ে আসবে আশা করা যায়। এভাবে সমাজের অন্যান্য পেশাজীবীসহ প্রতিনিধিত্বশীল মানুষেরা এগিয়ে আসলে দেশের যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলা আমাদের জন্যে সহজ হবে।
বন্যা, খরা, ডেঙ্গুসহ নানাবিধ দুর্যোগে যারা আক্রান্ত হয় তাদের জন্যে সরকার আছে, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা আছে- প্রচলিত এই ধারণাকে দূরে সরিয়ে রেখে অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো মানুষের অভ্যাসের অংশ হিসেবে পরিণত করা যায়। এতে করে অসহায়রা যে পরিস্থিতিতে পড়ুক না কেন দুর্যোগেও অন্তত ভাবতে পারবে তাদের সমব্যথী হওয়ার মত মানুষ আছে, তাদের সহায়তা দিতে হাজার-হাজার লোক আছে।
কেবল পেট পুরে খাওয়ার জন্যেই মানুষ বাঁচে না, মন ভরে রাখার জন্যেও মানুষ বাঁচে। মানুষের বেঁচে থাকার এই প্রচেষ্টা নিরন্তর, আর ওখানে জ্বালানি যোগায় মানবিক মানুষেরা। মানুষকে বাঁচাতে, দুর্দিনে কাছে দাঁড়াতে যত বেশি মানুষ থাকবে ভেঙে পড়ার দিনগুলোতেও মানুষ খুঁজবে ঘুরে দাঁড়ানোর রসদ।
লেখক: সাংবাদিক