বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনর্বাসনে বঙ্গবন্ধু
৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৭:০৮
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশি দালালদের হাতে কমপক্ষে পাঁচ লাখ নারী নির্যাতনের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধের পর সদ্য স্বাধীন দেশে নির্যাতিত নারীরা সামাজিক অস্বীকৃতির মুখে পড়েন, তাঁরা হয়ে পড়েন আশ্রয়হীন, নিন্দার পাত্র, হেয় হবার পাত্র। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রতিকূল অবস্থায় থাকা এবং অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক দিক হতে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পরা সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু স্বল্পসামর্থ্য দিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের পুনরবাসিত করার। মুক্তিযুদ্ধের নির্যাতিত নারীদের সামাজিক স্বীকৃতির জন্য ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিটিও বঙ্গবন্ধুই দিয়েছিলেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২; পাবনার নগরবাড়ী ঘাট হতে কাজীর হাট পর্যন্ত বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করতে বঙ্গবন্ধু পাবনার বেড়া উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে যান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কয়েকজন নারী বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধুর নজরে বিষয়টি আসলে তিনি ওই নারীদের আসতে দেয়ার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদের আদেশ দেন। অনুমতি পেয়ে ওই নারীরা বঙ্গবন্ধুর কাছে ছুটে আসেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে নির্যাতিত হবার ভয়ঙ্কর সব ঘটনার কথা বলেন। তাঁরা বঙ্গবন্ধুকে বলেন, কিভাবে তারা স্বাধীন দেশে নিগৃহীত হচ্ছেন, আত্মপরিচয়হীনতায় ভুগছেন, আশ্রয়হীন হয়ে দুর্দশায় দিন কাটাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধুর চোখ টলমল করে উঠে। তাঁদের পুর্নবাসনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন বঙ্গবন্ধু। পরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন-
“আজ থেকে পাকবাহিনীর দ্বারা নির্যাতিতা মহিলারা সাধারণ মহিলা নয়, তারা এখন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ খেতাবে ভূষিত। কেননা দেশের জন্যই তাঁরা ইজ্জত দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চেয়ে তাদের অবদান কম নয় বরং কয়েক ধাপ উপরে, যা আপনারা সবাই জানেন, বুঝিয়ে বলতে হবে না। তাই তাদের বীরাঙ্গনার মর্যাদা দিতে হবে এবং যথারীতি সম্মান দেখাতে হবে। আর সেই সব স্বামী বা পিতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলছি যে, আপনারাও ধন্য। কেননা এ ধরনের ত্যাগী ও মহত স্ত্রীর স্বামী বা পিতা হয়েছেন। তোমরা বীরাঙ্গনা, তোমরা আমাদের মা।”
মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীরা সেদিন থেকে ‘বীরাঙ্গনা’ উপাধিতে ভূষিত হন।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ও তাদের দোসরদের নির্যাতনের ফলে গর্ভধারণ করা মায়েদের অনেকে গর্ভপাতের আশ্রয় নেন। তারপরও ১৯৭২ জুড়ে দেশে অনেক যুদ্ধশিশুর জন্ম হয়। বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুদের গ্রহণে প্রস্তুত ছিল না সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের মানুষ। হাজার বছরের প্রিজুডিসের কারণে সম্মান ও সহানুভূতি পাবার বদলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বীরাঙ্গনারা সামাজিকভাবে নিগৃহীত হতে থাকেন। এছাড়া ভয়ংকর নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গর্ভধারণ করার ফলে জন্ম নেয়া এই শিশুদের গ্রহণের মানসিকতা ও লালন-পালনের উপায় অনেক নির্যাতিত মায়ের ছিল না। তাই, বিদেশে যুদ্ধশিশুদের দত্তকের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এ জন্য ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার Bangladesh Abandoned Children (Special Provisions) Order, 1972 (P.O. No. 124 of 1972) জারি করেন। বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা সমিতি, বাংলাদেশ সেন্ট্রাল অর্গানাইজেশন ফর রিহ্যাবিলিটেশন, মাদার তেরেসা’র মিশনারিজ অব চ্যারিটির মাধ্যমে বহু যুদ্ধশিশুকে বিদেশে দত্তক দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানগুলো দত্তক হয়নি এমন শিশুদের বিভিন্ন শিশুসদনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বীরাঙ্গনাদের অবস্থা ছিল নাজুক। সামাজিক ও পারিবারিক অস্বীকৃতির মুখে বীরাঙ্গনারা ঠাঁইহীন হয়ে পড়েন। বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনের জন্য তখন বঙ্গবন্ধু সরকার নানান উদ্যোগ নেয়। ১৯৭২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নির্যাতিত নারীদের জন্য মহিলা পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। গঠন করা হয়- নারী পূনর্বাসন বোর্ড; এই বোর্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারী ও শিশুর তথ্য সংগ্রহ, তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, নারীদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেয়া, বীরাঙ্গনা নারীসহ যেসব পরিবারের উপার্জনক্ষম পুরুষ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এমন পরিবারের নারীদের চাকুরী ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। ঢাকার বেইলি রোডে চালু করা হয় সেক্রেটারিয়াল কোর্স, মোহাম্মদপুরে সেলাই ও কারুশিল্প প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, সাভারে খোলা হয় পোলট্রি ফার্ম – এভাবে সারাদেশ বীরাঙ্গনাদের পুর্নবাসনের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও আবাসন সুবিধা সৃষ্টি করা হয়। সরকারি উদ্যোগকে বেগবান করতে বেসরকারি ও নাগরিক উদ্যোগও যোগ হয়- কারিতাস, কারিকা, নিরাশ্রয় মহিলা পুনর্বাসন সমিতি এসব বেসরকারি সংস্থাগুলো এগিয়ে আসে।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে শতকরা ১০% শূণ্য পদে নির্যাতিত মহিলা অথবা মুক্তিযুদ্ধে যাদের আত্মীয়স্বজন মারা গেছেন, এমন সব মহিলার জন্য সংরক্ষিত রাখার আদেশ দেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী (১৯৭৩-৭৮) পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ নারীদের জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, সমাজকল্যাণ, পুনর্বাসন ও আশ্রয়কেন্দ্রমূলক বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়। নারী পুনর্বাসন বোর্ডের দায়িত্ব ও কার্যপরিধি বেড়ে যাওয়ায় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার ‘নারী পুনর্বাসন ও কল্যাণ ফাউন্ডেশনে’ উন্নীত করেন।
বাংলাদেশের জন্মটা রক্তাক্ত, কষ্টে ভরা। বীরাঙ্গনারা নয় মাসের ভয়ংকর নির্যাতন সহ্য করার পর সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পড়েছিলেন চরম সামাজিক প্রতিকূলতায়। বঙ্গবন্ধু বীরাঙ্গনা নারীদের পুনর্বাসনের জন্য তাঁর সামর্থ্যের সর্বোচ্চটুকু করার চেষ্টা করেছিলেন। স্বল্প সামর্থ্যের কারণে বিপুল সংখ্যাক নিপীড়িত নারী রয়ে গিয়েছিলেন সহযোগিতার বাইরে। নিপীড়িত নারীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও সামাজিক অগ্রহণযোগ্যতার কারণে এই নারীরা চরম নিগ্রহের শিকার হয়েছিলেন। যাঁদের রাখা উচিত ছিল মাথার উপরে, তাঁদের এই সমাজ দিয়েছিল অসম্মান। বাংলাদেশের জন্মইতিহাসটা তাই রক্ত, অশ্রু দিয়ে লিপিবদ্ধ করা।
সাব্বির হোসাইন
প্রতিষ্ঠাতা, মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
নিউইর্য়ক, ফেব্রুয়ারি ০৬, ২০১৮
[email protected]