খালেদার জেল ও নির্বাচনী বছরের রাজনীতি
১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ১৩:০৬
নিন্ম আদালতের রায়ে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজার পর প্রায় জমে থাকা রাজনীতির মাঠ আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। সাবেক সরকার প্রধানদের দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়ে জেলে যাওয়ার ঘটনা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ইতিহাসে বিরল না হলেও আমাদের দেশে শুধুমাত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটেছে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে এরশাদ জেলে গিয়েছেন একজন স্বৈরশাসকের তকমা নিয়ে। একজন সাবেক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়া নিন্ম আদালতের রায়ে সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় বলা যায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন মোড়ের সৃষ্টি হলো। এই নতুন মোড়ের রাজনীতির জন্য আওয়ামীলীগ এবং বিএনপি কতটা প্রস্তুত আছে তা দেখার সময় বোধহয় এসেছে!
বিএনপির নড়াচড়া দেখে বুঝাই যাচ্ছিলো রায়ের আগেই তারা ধরে নিয়েছিলেন খালেদা জিয়া সাজাপ্রাপ্ত হতে পারেন। রায়কে কেন্দ্র করে রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে দলটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা কয়েক দফা বৈঠক করেন। বৈঠকে দলের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সে যোগ দেন। লন্ডনে ফেরারী দিন অতিবাহিত করার সময়ে তারেক রহমানকে এভাবে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে স্থায়ী কমিটিতে যোগ দিতে এর আগে কখনো দেখা যায়নি। বৈঠকে বিএনপির নেতারা খালেদা জিয়া কারা অন্তরীণ হলে দল কিভাবে পরিচালিত হবে এ বিষয়েও নানা পরামর্শ করে রাখেন। রায়ের পরে তারই সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতা দেখা যায়। পরপরই আনুষ্ঠানিকভাবে সেই ফেরারী আসামি তারেককেই দলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান ঘোষণা করা হলো। আর শনিবার দলের উর্ধবতনরা আবারও মিটিং করলেন যাতে, তারেক রহমান ভিডিও কনফারেন্সিংয়ে যোগ দিলেন আর পরামর্শ দিলেন।
এদিকে আগে থেকেই বিএনপির শীর্ষনেতাদের বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ প্রকাশ্য হচ্ছিলো। রায়ের আগে খালেদা জিয়ার মামলার শুনানিতে শেষ হাজিরার দিন হাইকোর্টের সামনের আসামি ছিনতাই এর ঘটনায় দলের দফতর সম্পাদক রিজভী এবং মির্জা ফখরুলের পরস্পর বিরোধী বক্তব্য দলের সিনিওর নেতাদের পাশাপাশি সমর্থকদেরও বিভক্ত করেছে। দলের হয়ে যারা সামান্য হলেও শক্তি প্রদর্শন করে দেখালেন তাদের একজন ওন করলেন, একজন নিজের বলে স্বীকারই করলেন না। পরস্পর সমন্নয়হীন এই বক্তব্য দলের সমর্থকদের উপর প্রভাব ফেলছে নিশ্চিত।
মাঠের রাজনীতিও ভাবাচ্ছে বিএনপিকে। গত নির্বাচনের সময় স্থানীয় নেতারা মাঠ গরম রাখলেও ঢাকার নেতাদের আত্মগোপনে থাকতে দেখা গিয়েছে। এবারও এটির সম্ভাবনা দেখা গিয়েছে। গুলশানে খালেদা জিয়ার ছয় দফা ঘোষণার মাত্র দুদিন পর দলের দফতর সম্পাদক রিজভীর পাশে কেন্দ্রীয় নেতাদের ভীর আকস্মিকভাবে কমে গিয়েছে। গুলশান বৈঠকে দলের আঞ্চলিক নেতারাও বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের এভাবে গা বাঁচানো নীতির সমালোচনা করেন।
গত নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সহিংসতা, হত্যা, পেট্রোল বোমা, ভাঙচুর, লুণ্ঠনের অভিযোগের কারণে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিএনপি ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে বিএনপির নেতৃস্থানীয় মহল এবার আগে থেকেই সতর্ক। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের সুদৃষ্টি অর্জনের জন্য দল হিসেবে বিএনপির পরিচ্ছন্ন রাজনীতির ভাবমূর্তি ধরে রাখা জরুরি। এ কারণে হাইকোর্টের সামনে আসামী ছিনতাইয়ের মত ঘটনা পুলিশকে বিএনপির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, হয়রানির বৈধতা দিক এটা নিশ্চিতভাবে বিএনপির নেতারা চাইবেনা। এর ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি খালেদা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যাওয়ার সময়টিতেও। সেদিন খালেদা তার বাড়ি থেকে আদালতে যাওয়ার পথে কিছু ঝামেলা হয়েছে বটে। মগবাজার এলাকায় কিছুটা শক্তি দেখাতে তারা পেরেছিলো, কিন্তু সেটাও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার সময়ও দলের নেতা-কর্মীদের শান্ত থাকতে বলেছেন। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে বলেছেন।
তবে তারেক জিয়ার মূল নেতৃত্বে আসা নিয়ে রয়েছে নানা মত। নিশ্চিতভাবেই বিএনপির নেতাকর্মীদের একটি অংশ আছেন যারা চান না এসব সিনিওর নেতাদের বাইরে খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতে তারেক জিয়া যেনো সরাসরি বিএনপির নেতৃত্ব দেন। ওদিকে ছাত্রদল এবং বিএনপির জুনিওর নেতাদের মাঝে তারেক জিয়া নিজের ব্যাক্তিগত যে বলয় সৃষ্টি করে রেখেছেন, সেটি যদি বিএনপির সিনিওর নেতাদের সাথে অসহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে, তাহলে নিশ্চিত ভাবেই মাঠের রাজনীতিতে বড় ধরণের বিপদে পড়তে যাচ্ছে বিএনপি।
তুলনামূলক স্বস্তিতে আছে আওামীলীগ। এই স্বস্তি খালেদা জিয়ার জেলে যাওয়া কেন্দ্রিক যতটা তার চেয়েও বেশী বিএনপির হঠাৎ নির্বাচন নিয়ে নতুন স্ট্যান্ডের কারণে। গত বছর প্রায় পুরো সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু কৌশলে এড়িয়ে গেছে বিএনপি। দলের ভিতর থেকেও নির্বাচনের প্রস্তুতির নির্দেশনা ছিলো। সাধারণ মানুষ সহ সবাই ধরেই নিয়েছিলো আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে যাচ্ছে বিএনপি। বিএনপির এই নিরপেক্ষ সরকারের দাবি নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগকে কিছুটা স্বস্তিতে রাখবে। তবে বিএনপির এই সব স্ট্যান্ডই যে শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার রায়কেন্দ্রিক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
এসব ঘটনার মাঝেই আগামী নির্বাচন উপলক্ষ্যে প্রায় এক বছর আগে থেকেই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছে আওয়ামীলীগ। দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে আগে থেকেই সতর্ক আচরণ করছেন। গত নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রায়ই বলতে শোনা গিয়েছিলো দলটির উন্নয়ন কার্যক্রমের তুলনায় মাঠ পর্যায়ে প্রচার কম। দলটি এবার আগে থেকে আটঘাট বেঁধে নির্বাচনের প্রচারে আগের তুলনায় বেশি সময় ব্যয় করতে চায়। এই উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যে দলটির সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন বিষয়ে দিক নির্দেশনা দেওয়া শুরু হয়েছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংসদ সদস্যদের আচরণের দিক নির্দেশনাও দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় ভাবে।
বিএনপির মতো অবস্থায় না থাকলেও স্থানীয় রাজনীতিতে আওামিলীগ একেবারে মধুচন্দ্রিমা পার করছে এমনটা বলা যাবেনা। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনে হারের ব্যর্থতা এখনো অতীত হয়নি। দলটি ৯ বছর টানা ক্ষমতায় থাকায় বিভিন্ন এলাকায় আওামীলীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে এই উপদলে বিভক্ত হওয়ার প্রবণতা কমেনি বরং বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দলটির কেন্দ্রীয় উপ-কমিটি ঘোষণা নিয়েও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে দলটি। তরুণ নেতাকর্মীদের একাংশের বিদ্রোহে পরবর্তীতে কমিটি স্থগিত করতে বাধ্য হন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা। আগামী নির্বাচনের আগে কর্মীদের ক্ষোভ কিংবা নেতাদের বিদ্রোহ শক্তভাবে দমন করা আওামীলীগের জন্য নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামীলীগ আট তারিখের রায়ের দিনে প্রকাশ্যে কোন কর্মসূচী না দিলেও সব ধরণের সহযোগী সংগঠন সহ নিজেদের দলের কর্মীদের মাঠে থাকার নির্দেশ দেয়। রায়ের পর শনিবার বিক্ষোভও করে। তবে আওামীলীগের জন্যও চালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। গত নির্বাচনের আগে আওয়ামীলীগের কর্মীর সংখ্যার চেয়ে বর্তমানে দলটির কর্মীসংখ্যা দ্বিগুণ। তবে এই বিপুল সংখ্যাক নেতাকর্মীদের আন্দোলনের রাজনীতিতে কোন পরীক্ষা দিতে হয়নি। গত নির্বাচনের পর সাতক্ষীরা, গাইবান্ধা, চট্টগ্রামে আওামীলীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা প্রবলভাবে চোখে ধরা পড়ে। এবার তারা নিশ্চয় এরকম কোন কিছুর সম্মুখীন হতে চাইবেনা। এছাড়া খালেদা জিয়া সাজা প্রাপ্ত হলে বিএনপি নিশ্চিতভাবেই আওয়ামীলীগ নিয়ন্ত্রিত আদালতের রায় বলে প্রচারণা চালাবে। দল হিসেবে এটির বিরুদ্ধ যুক্তি প্রতিষ্ঠা করার দায় আওামীলীগের উপরই বর্তায়।
খালেদা জিয়ার রায়ের কারণে দেশের রাজনীতিতে সাময়িক অস্থিরতা বিরাজ করলেও, দেশের রাজনীতি যেদিকেই যাক না কেন পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায় রাজনৈতিক সহিংসতা, গুম, খুন, পেট্রোল বোমা, ভাংচুর, অবরোধ, হরতাল ইত্যাদির রাজনীতি সাধারণ মানুষকে এখন আর সম্পৃক্ত করতে পারছেনা!
সারাবাংলা/এমএম
[এই কলামে তুলে ধরা মতামত লেখকের নিজস্ব]