Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মন্ত্রিত্ব ক্ষণস্থায়ী, জলাবদ্ধতা চিরস্থায়ী


২৩ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:১৫

ঢাকার দুই মেয়র আর ওয়াসার এমডি নিশ্চয়ই এখন প্রকৃতিকে অভিশাপ দিচ্ছেন। এবারের বর্ষাটা যেমন-তেমন পার করা গেছে; কিন্তু হেমন্তের বর্ষণে ডুবে যাচ্ছে তাদের সব স্বস্তি। এবারের বর্ষায় টানা বৃষ্টি খুব একটা হয়নি, তাই জলাবদ্ধতা তেমন ভোগায়নি তাদের। কিন্তু শরতে আর হেমন্তের অসময়ের বৃষ্টি তাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিচ্ছে।

গত কয়েকবছর ধরে বর্ষাকালে ঢাকার সবচেয়ে ভোগান্তির নাম জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি এখন আর ঢাকার মানুষের ভেজার রোমান্টিকতা নয়, ডুবে যাওয়ার আতঙ্কের নাম। এক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই ঢাকা অচল, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডুবে থাকে ঢাকার রাস্তা। কয়েকবছর ধরে চললেও ২০১৭ সালে জলাবদ্ধতার সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করে। যতটুকু বৃষ্টি হয়, ঠিক ততটুকুই যেন আটকে থাকে। বৃষ্টি একটু বেশি হলেই ঢাকা জল থই থই। অনেকেই মজা করে ঢাকাকে নদীর সাথে তুলনা করেছেন। বড় নদী ঢাকার আবার অনেকগুলো শাখা নদী আছে- ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার নদী, রোকেয়া সরণি
নদী, শান্তিনগর নদী, কারওয়ানবাজার নদী ইত্যাদি ইত্যাদি।

বিজ্ঞাপন

এবার যেমন বর্ষায় তেমন বৃষ্টি হয়নি; ২০১৭ সালে ছিল তার উল্টো। বারবার টানা বর্ষণে জলাবদ্ধতার এক পর্যায়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘আগামী বছর জলাবদ্ধতা থাকবে না’। স্থানীয় সরকার মন্ত্রী হিসেবে মানুষকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখা তার দায়িত্ব। সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবেই হয়তো তিনি আশাবাদী মানুষ হিসেবে জনগণকে আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু আমি তার মত অত আশাবাদী হতে পারিনি। কারণ আমি জানি, মন্ত্রী যতই আন্তরিক হন, ঢাকাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। একমাত্র প্রকৃতিই পারে, ঢাকাকে বাঁচাতে। যদি টানা বৃষ্টি না হয়, থেমে থেমে অল্প বৃষ্টি হয়; তাহলেই কেবল মন্ত্রীর আশ্বাস পূরণ হওয়া সম্ভব।

বিজ্ঞাপন

বর্ষা-বৃষ্টি-পানি হলো অপার আনন্দের উৎস। লিখে শেষ করা যাবে না। সত্যি সত্যি বৃষ্টি আমার খুবই প্রিয়। ঝুম বৃষ্টি হলে আমার কাছে সব অচেনা লাগে। ঝুম বৃষ্টিতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে আমার দারুণ লাগে। বুধবার অফিসে আসার সময় টানা বৃষ্টির কবলে পড়েছিলাম। গাড়িতে বসে বসে আমি বৃষ্টির রূপ দেখছিলাম। কিন্তু বৃষ্টি যতই বাড়ছিল, আমার শঙ্কাও তত বাড়ছিল। আজও নিশ্চয়ই ঢাকার রাস্তা ডুবে যাবে, অচল হয়ে যাবে পথ। আশঙ্কা সত্যি হতে দেরি হয়নি। মোহাম্মদপুর থেকে কারওয়ানবাজারের ১৫ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে আমার দেড়ঘণ্টা লেগেছে।

বলছিলাম মন্ত্রীর আশ্বাসের কথা। আগেই বলেছি, তার কথায় আমি আশ্বস্ত হইনি। কারণ আমি জানি ঢাকাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং আইনের কঠোর প্রয়োগই কেবল ঢাকাকে জলাবদ্ধতা মুক্ত রাখতে পারে। কিন্তু বছরের কয়েকদিনের জলাবদ্ধাতার ভোগান্তি দূর করতে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, যত কঠোর ও অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে; তা কোনো জনপ্রিয়তাকামী রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে নেয়া কঠিন। আমি নিশ্চিত এটা মন্ত্রীও জানতেন। তারপরও সাধারণ মানুষের তাৎক্ষণিক ক্ষোভ প্রশমিত করতে মন্ত্রীদের সম্ভব-অসম্ভব অনেক আশ্বাস দিতে হয়। মন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেই আশ্বাস বাস্তবায়নে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেননি। অবশ্য উদ্যোগ নিলেও এক/দুই বছরের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব ছিল না। সেই মন্ত্রী বা সরকার একেবারে কোনো উদ্যোগ নেয়নি, তা বলাটা ভুল হবে। সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে সরকার। ওয়াসার জন্য বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ওয়াসাও খাল খনন, পরিষ্কার, নালা পরিষ্কারের কাজ করছে। কিন্তু রোগটা ক্যান্সার, তাই টোটকায় কাজ হবে না। হয়ওনি। ১৫ মাসে ওয়াসা জলাবদ্ধতা নিরসনে ৫০ কোটি টাকা খরচ করেছে। এখন বলাই যায় পুরো টাকাটাই জলে গেছে।

যদি ঢাকার সবগুলো খাল উদ্ধার করে একদম আগের মত করা যেতো, আমি নিশ্চিত জলাবদ্ধতা থাকতো না। কিন্তু জালের মত বিছিয়ে থাকা ঢাকার খালগুলো বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে। কিছু বিভিন্ন সময়ে সরকারের অদূরদর্শিতায় বক্স কালভার্ট হয়ে গেছে। একসময় কারওয়ানবাজার পর্যন্ত নৌকা চলতো, এ কথা এখন রূপকথা মনে হয়। কিন্তু বেশি পুরোনো রূপকথা নয় কিন্তু। খাল সব মেরে, ভরাট করে, দখল করে, বক্স কালভার্ট করে; পানি সরার সব জায়গা বন্ধ করে দিয়ে এখন জলাবদ্ধতা নিয়ে কান্নাকাটি করে তো লাভ নেই। গাছের গোড়া কেটে আগায় যতই পানি ঢালুন, কাজ হবে না। একসময় শ্যামলী রিং রোডে দাড়ালে পশ্চিমে পুরো সাগর মনে হতো। এখনও সাগর, মানুষের আর কংক্রিটের। তো রাজধানীর সব জলাধার, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে উঁচু উঁচু বিল্ডিং বানাবেন। আবার আশা করবেন, বৃষ্টির পানি আপনার ভয়ে সুরসুর করে চলে যাবে; অতটা আশা আলাউদ্দিনের প্রদীপের দৈত্যও করে না।

চারপাশের নদীগুলোতে দখল আর দূষণে প্রায় মেরে ফেলে, জালের মত বিছিয়ে থাকা খালগুলোকে ভরাট করে, বক্স কালভার্ট বানিয়ে, নিম্নাঞ্চল ভরাট করে প্লট-ফ্ল্যাট বানিয়ে ঢাকাকে অনেক আগেই আমরা বালতি বানিয়ে ফেলেছি। তাই যতটুকু বৃষ্টি হয়, ততটুকু পানিই আটকে থাকে। নিচে যাওয়ারও উপায় নেই। পদে পদে কংক্রিটের বাধা। এখন জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির একটাই তাৎক্ষণিক উপায়, হাতে-কলমে মানে পাম্প করে পানি বাইরে ফেলা অথবা হেলিকপ্টার দিয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া। কোনোটাই সম্ভব নয়। তাই বৃষ্টি হলেই জলঅবদ্ধতার ভোগান্তি অনিবার্য।

যেই মন্ত্রী ২০১৭ সালে একবছরের মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস দিয়েছিলেন, একবছরের মধ্যে তার চাকরি চলে গেছে। কিন্তু জলাবদ্ধতা যায়নি। একটা বিষয় পরিস্কার- মন্ত্রিত্ব ক্ষণস্থায়ী, জলাবদ্ধতা চিরস্থায়ী।

প্রভাষ আমিন, বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।

জলাবদ্ধতা ঢাকা প্রভাষ আমিন মন্ত্রিত্ব রাজধানী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর