পেঁয়াজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হোক
১৬ নভেম্বর ২০১৯ ০০:৪৩
বাংলাদেশকে অভিবাদন। বাংলাদেশ বিশ্বরেকর্ড করেছে। এই মুহুর্তে বিশ্বে সবচেয়ে দামী পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশে। এক কেজি পেঁয়াজের দাম ২০০ টাকার বেশি, টাকার মূল্য বিবেচনায় ভবিষ্যতেও কখনো এ ঘটনা ঘটবে না। বাংলাদেশের এ রেকর্ড অক্ষুন্ন থাকবে।
বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন পেঁয়াজময়। পেঁয়াজের দাম নিয়ে জ্বালাময়ী স্ট্যাটাস, বিদ্রুপাত্মক ট্রল, রসাত্মক টিকটক- সৃষ্টিশীলতার শেষ নেই। পেঁয়াজ ছাড়া রান্নার রেসিপি সবার মুখস্ত, পেঁয়াজ নিয়ে গান হচ্ছে, পেঁয়াজ নিয়ে গান হচ্ছে, যৌতুক হিসেবেও পেঁয়াজের চাহিদা বাড়ছে। পেঁয়াজ অপরিহার্য সবজি নয়। অনেকেই পেঁয়াজ খান না। পেঁয়াজ ছাড়াও দিব্যি রান্না চালিয়ে নেয়া সম্ভব। সে কারণেই পেঁয়াজ নিয়ে মজা করা যাচ্ছে। পেঁয়াজ না হয়ে যদি ব্যাপারটা চাল বা আটা হতো; তাহলে এতক্ষণে হাহাকার শুরু হয়ে যেতো। পেঁয়াজ সমস্যার আমার একটা সমাধান আছে। সর্বাত্মক পেঁয়াজ বয়কট চালানো গেলেই কেবল মজুতদারদের উচিত শিক্ষা হবে। আড়তে পেঁয়াজে গাছ গজাক, পচুক, গলুক; তবেই এই লোভী ব্যবসায়ীদের শিক্ষা হবে। পেঁয়াজ না খেলে তো আর মানুষ মরে যায় না।
আমি পেঁয়াজ কিনি না কিনি; খাই না খাই; সেটা আমার ব্যাপার। দাম যতই হোক; মানুষ তার চাহিদা দিয়ে, সামর্থ্য বিবেচনায় পেঁয়াজ কিনবে। কিন্তু সরকারের দায়িত্ব হলো পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু সেটা করতে সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতাটা খুব অ্যালার্মিং। কারণ আগেই বলেছি, এটা যদি পেঁয়াজ না হয়ে চাল হতো, তাহলে পরিস্থিতিটা কী দাড়াতো? ভাবা যায়। যারা পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে, তারা তো চাইলে চালের বাজারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তাই সতর্কতাটা অতি জরুরি। একটি মহল শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণ করে, আরেক মহল করে পেঁয়াজের বাজার। যতই আমরা মুক্তবাজার অর্থনীতির কথা বলি না কেন, বাজারে সব জিনিসের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। বাজারের ওপর কোনো মহল, সিন্ডিকেট, আড়তদার, মজুতদারের নিয়ন্ত্রণ নয়; সরকারের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।
পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাটা স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট। কারণ পেঁয়াজের সমস্যাটা এক দুদিনের নয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভারত রপ্তানির ক্ষেত্রে পেঁয়াজের দাম টনপ্রতি কমপক্ষে ৮৫০ ডলার করার পর বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা শুরু হয়। আর ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি একেবারে বন্ধ করে দিলে পেঁয়াজের বাজার পাগলা ঘোড়ায় চড়ে বসে। সেই থেকে গতি কম বেশি হয়েছে, কিন্তু এই পাগলা ঘোড়া আর থামেনি। কিন্তু গত এক সপ্তাহে যা হলো, তা পাগলামিকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বাণিজ্যমন্ত্রীর পক্ষে শিল্পমন্ত্রী যেদিন ঘোষণা দিলেন, পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে; তার চারদিনের মধ্যে পেঁয়াজের দাম বিশ্বরেকর্ড সৃষ্টি করলো। তার মানে একটি মহল সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে- দেখো পেঁয়াজের বাজারে তোমাদের কচু নিয়ন্ত্রণ আছে। আসল নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে।
পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাটা সুস্পষ্ট। কারণ দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিরতা। আমদানি করতে হয় বটে, তবে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার আমদানি নির্ভর নয়। চাহিদার বেশিরভাগ পেঁয়াজ দেশেই উৎপাদিত হয়। যেটুকু আমদানি হয়, তাতে অল্প সময়েই বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকার চাইলে এতদিনে মঙ্গলগ্রহ থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে পারতো। এখন পেঁয়াজ যখন সবার চোখের পানি, নাকের পানি এক করেছে তখন শুনছি বিমানে পেঁয়াজ আনার কথাও ভাবা হচ্ছে। অথচ দুই মাস আগে থেকে ভাবলে গরুর গাড়ি দিয়ে এনেও সমস্যার সমাধান করা যেতো। বাংলাদেশে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার জন্য পদত্যাগের নজির নেই। তাই পেঁয়াজের বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার জন্য বাণিজ্যমন্ত্রী বা সংশ্লিষ্ট কারো পদত্যাগ চেয়ে সময় নষ্ট করছি না। আমি বরং পেঁয়াজের দায়িত্বটা আপাতত বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দেয়া হোক।
পেঁয়াজের ঝাঁঝ সংসদেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। সরকারি, বিরোধী দল সবাই অভিন্ন কণ্ঠে উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ দায়ীদের ক্রসফায়ার চেয়েছেন, কেউ পেঁয়াজের বাজারে শুদ্ধি অভিযান চেয়েছেন। আমি সবসময় সব ধরনের বিচার বহির্ভূত কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে। তাই আইন প্রণেতাদের ক্রসফায়ারের দাবির সঙ্গে একমত নই। তবে পেঁয়াজের বাজারে একটা শুদ্ধি অভিযান জরুরি।
ফেসবুকে আমার বন্ধু এস এম নাহিদ রহমান আমার স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেছেন, ‘জাস্ট ঘোষণা দিয়ে দিলে হয়, কেউ ৬০ টাকার বেশি পেয়াজ বেঁচতে পারবে না। বেচলেই জেল। ১ দিনে দাম নেমে যাবে।’ আমি তার সাথে অনেকটাই একমত। পেঁয়াজের বাজার এখন সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধির বাইরে চলে গেছে। সাধারন ব্যবসায়ীরা নয়, দুর্বৃত্তরা এখন নিয়ন্ত্রণ করছে বাজার। নইলে এক কেজি পেঁয়াজের দাম কোনোভাবেই ২৪০ টাকা হতে পারে না। তাই এখন এখানে পুলিশী হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।
বিষয়টা খুব জটিল নয়, খুচরা বাজার থেকে পাইকারি বাজার, পাইকারি বাজার থেকে আড়ত, আড়ত থেকে আড়তদার, আড়তদার থেকে আমদানিকারক- কে কত টাকায় কিনছে, কত টাকায় বিক্রি করছে; এটা বের করতে শার্লক হোমস হওয়া লাগবে না; আমাদের বনজ কুমার মজুমদারই যথেষ্ট। চারদিনের মধ্যে ৮০ টাকার পেঁয়াজ ২৪০ টাকা হতে পারে না। তাই সরকার যদি এই দুর্বৃত্তদের খুজে বের করে ব্যবস্থা নেয় ব্যবসায়ীরা নিশ্চয়ই মাইন্ড করবেন না।
এই ব্যবস্থা নেয়াটা জরুরি। কারণ সরকারকে প্রমাণ করতে হবে, বাজারের মূল নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতেই। আসলে আমি পেঁয়াজের দাম নিয়ে শঙ্কিত নই। দুর্বৃত্তরা যদি বুঝে যায়, এভাবে নির্বিঘ্নে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাপ মরেছে, তারচেয়ে ভয় হলো, যম বাড়ি চিনেছে। দুর্বৃত্তরা পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সফল হয়েছে। এখন তারা যদি চিনি, আটা, ডাল বা চালের বাজারের দিকে যায়! তার আগেই এদের খুজে বের করে শাস্তি দিতে হবে।
প্রভাষ আমিন : বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ।