শাজাহান তুনে কামাল কিয়া ভাই!
২৯ ডিসেম্বর ২০১৯ ২০:০৭
আওয়ামী লীগের সম্মেলনের আগে সাংবাদিকরা সম্ভাব্য নেতা হিসেবে অনেকের নাম লিখেছেন। এক সাধারণ সম্পাদক পদেই বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গোটা দশেক নাম। এছাড়া ‘দলে আসছেন, তরুণ নেতৃত্ব’ এমন শিরোনামে সাবেক ছাত্রনেতাদের সারি সারি ছবি ছাপা হয়েছে অনলাইনে, পত্রিকায়। কিন্তু এইসব সংবাদই ছিল কল্পনাপ্রসূত। সাংবাদিকরা নিজেদের পছন্দের নেতাকেই প্রচারের আলোয় রাখার জন্য তাদের নাম দিয়েছেন। নেতারাও অনেকসময় অনুরোধ করে নিজের নামটি ঢুকিয়ে দিয়েছেন কাল্পনিক সংবাদে। পুরোটাই কল্পনাপ্রসূত, কারণ কমিটির বিষয়টি একজনই জানতেন, তিনি শেখ হাসিনা। আর তার সাথে কথা বলে রিপোর্ট করেননি কেউ। পত্রিকায়-অনলাইনে অনেক কাল্পনিক চমকের খবরও ছাপা হয়েছে। কিন্তু আসল চমকটা দিয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেই। ২১তম সম্মেলন এবং এখন পর্যন্ত দুই দফায় ঘোষিত আওয়ামী লীগের আংশিক কমিটির একমাত্র চমক শাজাহান খান। কারণ এই নামটি কোনো পত্রিকায় ছাপা হয়নি। কারো দুঃস্বপ্নের কল্পনাতেও ঠাই পায়নি শাজাহান খান আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হবেন। শাজাহান খান আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ৬ বার এবং স্বতন্ত্র হিসেবে একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তারপরও তার গা থেকে জাসদের গন্ধ যায়নি। কারণ তিনি আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতেই ঠাঁই পাননি এতদিন। আওয়ামী লীগে তার প্রথম পদ-সভাপতিমন্ডলীর সদস্য! দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সত্যিই জাতিকে চমকে দিলেন।
যেহেতু ৭ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তাই ধরেই নিতে হবে তিনি তার নির্বাচিত এলাকায় জনপ্রিয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমি কখনোই মাদারীপুর যাইনি। তাই তার জনপ্রিয়তা সচক্ষে দেখার সৌভাগ্যও হয়নি। শাজাহান খানকে পছন্দ করেন, এমন কাউকে আমি এখনও সরাসরি দেখিনি, এমনকি ফেসবুকেও দেখিনি। দেশজুড়ে ঘৃণিত মানুষ নির্বাচনে গণভোট হলে নিঃসন্দেহে বিপুল ভোটে প্রথম হবেন শাজাহান খান। সেই ঘৃণিত শাজাহজান খানই এখন আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য। শাজাহান এক সময় জাসদ নেতা ছিলেন, ছিলেন গণবাহিনীর সদস্য। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে ভোগাতে যা যা করা দরকার, তার সবই করেছেন এই শাজাহান খানরা। তবে এখন তার একমাত্র যোগ্যতা, চাইলেই তিনি সারাদেশ অচল করে দিতে পারেন। এমনকি যখন নৌপরিবহন মন্ত্রী ছিলেন, তখন তার বাসা থেকে ফোন করে দেশ অচল করে দেয়া হয়েছে। তার বড় পরিচয় তিনি শ্রমিক নেতা। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। শ্রমিক নেতা বাংলাদেশে আরো অনেকে আছেন, কিন্তু তার মত বিপজ্জনক আর কেউ নেই। ইশারায় দেশ অচল করে দেয়ার ক্ষমতা যে তার আছে, সেটা তিনি জাতিকে অনেকবার দেখিয়েছেন, ভুগিয়েছেন। গত ১১ বছরে আওয়ামী লীগ যে কবার রাজপথে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তার বেশিরভাগই ফেলেছেন এই শাজাহান খান। তৃতীয় দফায় মন্ত্রিসভায় শাজাহান খান বাদ পড়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন অনেকেই। কিন্তু তিনি আওয়ামী লগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য হওয়ায় অনেকেই আবার শঙ্কিত।
শাজাহান খান ছিলেন সরকারের নৌপরিবহন মন্ত্রী। তবে নৌপরিবহনে তার কোনো অবদানের কথা কেউ জানে না। তার সব অবদান সড়কে এবং সবই নেতিবাচক। মন্ত্রী হওয়ার পর স্বার্থের সংঘাত সত্ত্বেও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতির পদটি ছাড়েননি। কারণ তিনি জানেন, এটাই তার ক্ষমতার আসল উৎস। পরিবহন খাতের মাস্তানি ছেড়ে দিলে তিনি নোবডি হয়ে যাবেন। তাই নৌপরিহন মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বারবার সড়ক পরিবহনে নাক গলিয়েছেন। সড়কে বসিয়েছেন মৃত্যুর উৎসব। তিনি পরিচিত পরিবহণ শ্রমিক ও চালকদের দালাল হিসেবে। পরিবহন শ্রমিক ও চালকরাও আমাদের দেশেরই সন্তান। তারাও পরিশ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করেন। আমি নিজেও তাদের পক্ষে। কিন্তু তাদেরকে দেশের প্রচলিত আইন মানতে হবে। নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে হবে। কিন্তু শাজাহান খান বারবার ধর্মঘট করে অন্যায় দাবি আদায় করে নিয়েছেন। তার দাবি গরু-ছাগলের ছবি চিনলেই চালকদের লাইসেন্স দিতে হবে। তার দাবি, অপরাধ করলেও পরিবহন শ্রমিকদের কোনো সাজা দেয়া যাবে না। তার দাবি মানুষ মেরে ফেললেও পরিহন শ্রমিকদের জামিন দিতে হবে। যাদের হাতে মানুষের জীবনমরণ নির্ভর করে, তাদের এমন আইনের উর্ধ্বে থাকার প্রবণতা খুবই বিপজ্জনক। শাজাহান খান সেই বিপজ্জনক প্রবণতার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন বারবার।
সড়ক দুর্ঘটনায় সাংবাদিক মিশুক মুনীর ও চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের মৃত্যুর পর দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার সময়ও শাজাহান খান জনআবেগের বিপরীতে গিয়ে অভিযুক্ত খুনীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় রমিজউদ্দিন স্কুলের শিক্ষার্থী রাজিব-মিমের নিহত হওয়ার পর শাজহান খানের নির্মম হাসি মাঠে নামিয়েছিল লাখো শিক্ষার্থীকে। তাদের দাবির মুখে সরকার সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু শাজাহান খানের আপত্তির মুখে আইনটি এখনও কার্যকর করা যায়নি, কখনো যাবে বলেও মনে হয় না। শ্রমিক রাজনীতিরও কিছু নিয়মকানুন আছে। ধাপে ধাপে কর্মসূচি পালন করে, আলটিমেটাম দিয়ে ধর্মঘট ডাকতে হয়। চতুর শাজাহান খান এখানে একটি কৌশল আবিস্কার করেছেন। তিনি বিনা নোটিশে গাড়ি বন্ধ করে সারাদেশ অচল করে দিতে পারেন। তখন তিনি বলেন, এটা কোনো ধর্মঘট নয়; ক্ষুব্ধ চালকরা গাড়ি চালাতে বিরত আছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীর মৃত্যুর পর গত ২৪ বছর ধরে নিরলসভাবে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন করে আসছেন জনপ্রিয় চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তার সাথে বিভিন্ন সময়ে আমার লম্বা আলাপ হয়েছে। তিনি সড়কে শৃঙ্খলা চান, সড়ককে নিরাপদ করতে চান। চালক-শ্রমিকদকের বিরুদ্ধে তার কোনো ক্ষোভ নেই। কিন্তু শাজাহান খান অশ্লীলভাবে ইলিয়াস কাঞ্চনকে আক্রমণ করে তাকে চালকদের প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছেন। কারণ শাজাহান সড়কে শৃঙ্খলা চান না, তিনি চান স্বেচ্ছাচারিতা।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দুর্নীতিবিরোধী এক শুদ্ধি অভিযান শুরু হয়েছে। এই অভিযানে ক্যাসিনোর সাথে
জড়িত থাকার অভিযোগে দলের অনেক নেতাই গ্রেপ্তার হয়েছেন, অনেকে পদ হারিয়েছেন। এই অভিযান যদি সড়ক পরিবহন খাতে যায়, তাহলে অভিযোগের তালিকায় এক নাম্বারে থাকবেন শাজাহান খান। কারণ পরিবহণ খাত হলো কাচা টাকার জায়গা। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয় এই খাতে। এই পরিবহন মাফিয়া এখন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য!
শাজাহান খানের ব্যাপারে সরকার দুটি ব্যবস্থা নিতে পারতো। তাকে দল থেকে বহিস্কার করে, তার ক্ষমতার উৎসগুলো নিষ্ক্রিয় করে দেয়া। কিন্তু সে
ক্ষেত্রে ঝুঁকি ছিল, তার জায়গাটি তো খালি থাকবে না, কেউ না কেউ শূন্যস্থান পূরণ করে ফেলবেন। তার চেয়ে ভালো বিপজ্জনক মানুষটিকে চোখের সামনে রেখে নিয়ন্ত্রণ করা। শেখ হাসিনা দ্বিতীয় উপায়টিই বেছে নিয়েছেন। এখন শাজাহান খান যদি পরিবহন মাফিয়া থেকে রাজনীতিবিদ বনে যেতে পারেন, তাহলেই জাতির জন্য মঙ্গল। তবে শাজাহান খানের অতীত কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো ইঙ্গিত মেলে না।