একুশে ফেব্রুয়ারি, পোশাকে মোড়া একটি দিন!
২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ২২:৪২
জিমি আমির, জয়েন্ট নিউজ এডিটর
২০১০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। কাজ করি বেসরকারি টিভি চ্যানেল, চ্যানেল ওয়ানে। টেলিভিশন বা সাংবাদিকতা দুটোতেই শিশু বয়স। অফিসের সিনিয়রদের ভিড়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির মতো একটি বিশেষ দিনে আমার কপালে অ্যাসাইনমেন্ট জোটেনি।
কিন্তু অফিস ডিউটি ছিল। অফিসে বসে না থেকে হঠাৎ মনে হলো ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পরি, দেখি কিছু করা যায় কি-না।
সোজা চলে এলাম টিএসসিতে। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম। চারিদিকে দেখছিলাম। আমার অন্য সহকর্মীরা তাদের নিজেদের অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করছিলেন। কিন্তু আমি কী করব?
টিএসসিতে সাদা কালো পোশাক পরা ছেলেমেয়েদের আনাগোনো। স্বাভাবিক শোকের মাস হিসেবে তারা তো তাই পরবেন। অনেক বাবা-মা বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন এমন পোশাক পরে।
সাদা কালো শাড়ি পরা মেয়েদের কাছে এগিয়ে গেলাম। মাইক্রোফোন হাতেই ছিল। ধরলাম সামনে, জিজ্ঞেস করলাম, কেন সাদা কালো শাড়ি পড়েছেন? কয়েক সেকেন্ড হাসির পর উত্তর এলো, আজতো একুশে ফেব্রুয়ারি, সাদা বা কালো পোশাক তো পরতেই হবে!
আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন? এবার মুখে হাসি নেই, কিন্তু আমতা আমতা করার পর উত্তর এলো সবাই তো পড়ছে! আমার আর জিজ্ঞেস করার কিছু নেই। আমি আমার উত্তর পেয়ে গেছি!
এবার গেলাম বাচ্চাদের কাছে। তাদের পরনে পতাকা ডিজাইন টি শার্ট। দেখেই বোঝা যায় বিশেষ দিনকে স্মরণ করার আনুষ্ঠানিকতা ভালোই হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের বাচ্চা তাই, বাংলা বলতে গিয়ে ৫০ শতাংশই ইংরেজি চলে আসছে। জানতে চাইলাম, ২১ ফেব্রুয়ারি কেন পালন করা হয়? চারজন বাচ্চা এলোমেলো কথা বলতে গিয়ে মোদ্দা কথা দাঁড়াল যে, আজকের দিনে চারজন লোক মারা গিয়েছিল। তবে, আমার প্রশ্ন এবং বাচ্চাদের উত্তরে বাবা-মারা বিব্রত হয়েছেন তা বোঝাই যায়। তারা শিখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে আমার রেকর্ডিং শেষ। বাবা মাকে বলেছিলাম, বাচ্চাদের কেন ঠিকমতো শেখাননি? সন্তোষজনক জবাব আসেনি।
অফিসে ফিরে নিউজের ইন্ট্রো লিখেছিলাম, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সাদা কালো পোশাকে শোক পালন হলেও অন্তরে নেই শোকের মর্মার্থ। ইংরেজি মাধ্যমের ক্লাস ফাইভের বাচ্চার কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি মানে চারজন লোকের মৃত্যু।
পরদিন অফিসে গিয়ে হেড অব নিউজ রাশিদ উন নবী বাবু ভাইয়ের তোপের মুখে পড়লাম। তার রাগ, কেন এই রিপোর্টটি নিয়ে অফিসে কথা বলে যাইনি। তাহলে আরও ভালো করে করা যেত, ভালো ট্রিটমেন্ট দেয়া যেত। কারণ, সন্ধ্যার বুলেটিনে একুশে ফেব্রুয়ারির ইভেন্ট নিউজের পর আমার রিপোটর্টা ভালো ট্রিটমেন্ট দেয়া যায়নি। তাছাড়া, প্রচার হবার পর রিপোর্টটি তাদের ভালো লেগেছে। তোপের মুখে পড়েও মন ভালো হয়ে গেল।
সমালোচনা হতে পারে এই ভেবে যে, মাত্র অল্প কয়েকজন মানুষের সাথে কথা বলে আমি কীভাবে বিচার করতে পারি, এতবড় বিষয়ের মর্মার্থ। কিন্তু আমার যুক্তি হচ্ছে, আমি একেবারে কোনো সাধারণ মানুষের কাছে যাইনি। গিয়েছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে, জিজ্ঞেস করেছি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রীদের। জানতে চেয়েছি ইংরজি মাধ্যমে পড়া বাচ্চাদের কাছে। এই সাধারণ কয়েকজন মানুষ ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে না। তবে, সমাজের চিত্র কিছুটা হলেও আন্দাজ করাই যায়।
তাহলে, পাঠ্যবইয়ে কী শেখানো হয়? ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে পুলিশের গুলির মুখে মারা যান নাম না জানা এক রিকশাচালক। মায়ের পেট থেকে পড়েই যে ভাষায় মাকে ডেকেছি সেই ভাষাকে বাঁচাতে আমাকেই যুদ্ধ করতে হয়। ভাষার জন্য মৃত্যু কোথায় হয়েছে? তাই, এর প্রতিবাদ আমার রক্তে। রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এর মুত্যু আমার কাছে নিরব রক্তক্ষরণ। যে রক্তক্ষরণ দেখানো যায় না। সাদা-কালো পোশাক পরলেই আমার রক্তক্ষরণ বন্ধ হবে?? সম্মান জানানো হবে রফিকদের?
এরপর আর ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন দেখতে যাইনি। ভয় হয়, যদি আবার সেই পুরনো দৃশ্য সামনে আসে! তবে, এত বছরে এসব দৃশ্যের পরিবর্তন নিশ্চয়ই হয়েছে, চোখ বন্ধ করে, সে আশা করতেই পারি।
পৃথিবীতে প্রায় ৭ হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার অবস্থান ৭ম। ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পায়। এর পরের বছর, ২০০০ সাল থেকে জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্র দিনটি পালন করে আসছে।
বাংলাকে আন্তর্জাতিক ভাষার স্বীকৃতি দিতে, ঢাকায় তৈরি করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট। যার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ২০১০ সাল থেকে। কিন্তু তাদের ওয়েবসাইটে দিনটি সম্পর্কে তেমন কিছু নেই। আর জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোও দিনটি পালন করছে কিছু না জেনেই।
অথচ শুরুতে মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের উদ্দেশ্যে ছিল, বাংলা ভাষার যাবতীয় ইতিহাস, তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করা। যাতে গোটা বিশ্ব জানতে পারবে এই ভাষা সম্পর্কে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র কী বলছে আমাদের? এত অবহেলার দায় কার?
সারাবাংলা/এমএম