বই প্রকাশনার প্রাতিষ্ঠানিকতা
২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১০:৩০
আজ থেকে শুরু হলো অমর একুশে গ্রন্থমেলা। মেট্রোরেলের কাজ চলছে, তাই বইমেলায় যাওয়া আসা এক বড় ঝক্কির ব্যাপার হবে। বায়ু বিষে আক্রান্ত এই শহরে বইমেলার চৌহদ্দিতে ধুলায় নাকাল হতে হবে আরও বেশি। কিন্তু তবুও বইকে ভালবেসে মানুষ যাবে মেলায়।
প্রতি বছর প্রচুর বই, বলতে গেলে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়। লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখি প্রতি বছরই। অনেকেই বলেন, এত বই নয়, চাই মানসম্পন্ন বই। আবার কেউবা বলেন আসুক না বই বাজারে যত ইচ্ছে তত, পাঠকরাই ঠিক করে নেবে তারা কেমন বই চায়। বই বেশি প্রকাশিত হচ্ছে মানে বই পড়ার অভ্যাস বাড়ছে, এটা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছেনা। একটা অনন্ত হুজুগ থেকে বিপুল সংখ্যক বই আসছে মেলায়। অনেকে প্রকাশককে টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করছেন, চাচ্ছেন লেখক নামে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে।
বইমেলার ইতিহাসের সাথে যে নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তিনি হলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউজ প্রাঙ্গনে বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর কলকতা থেকে আনা ৩২ টি বই দিয়ে বইমেলার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। যে বইগুলি ছিল বাংলাদেশী শরণার্থীদের লেখা। এ বইগুলি প্রকাশিত হয়েছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে যার বর্তমান নাম ‘মুক্তধারা প্রকাশনী’।১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বইমেলা চলে এভাবেই। ১৯৭৬ সালে বইমেলার প্রতি উৎসাহিত হন অন্য প্রকাশকরাও। আস্তে আস্তে বইমেলার পরিধি বাড়তে থাকে।
ধীরে ধীরে গোটা ব্যাপারটি চিত্তরঞ্জন সাহার সেই উদ্যোগের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক সামাজিক অনুভবে পরিণত হয়। এখন বলা হয় বইমেলা প্রাণের মেলা। এমন আত্মশক্তিই এই মেলার চালক। প্রকাশকদের উদ্যোগের সাথে রাষ্ট্র এখন যুক্ত এই মেলায়। আয়োজক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি। উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৫২-এ ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণ করে যার আয়োজন, সেই মেলা এখন উৎসব প্রিয় বাঙালির কাছে এক বড় পার্বণ।
১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০, ১৯৭১ এবং ১৯৯০ – আমাদের ইতিহাসের প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনায় আমাদের চাওয়া ছিল দেশ চলবে উদার-অসাম্প্রদায়িক পথে। একুশের বইমেলা সেই পথকে বেশি আলোকিত করবে। তবে সাম্প্রতিক কালে মৌলবাদি সহিংস শক্তির দাপটের কাছে মন খুলে মুক্তমনা বই এই মেলায় আনা আর সম্ভব হচ্ছেনা। এই মেলা থেকেই ফেরার পথে আক্রমণের শিকার হয়ে মারা গেছেন সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ, খুন হয়েছেন বিজ্ঞানমনষ্ক মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়, খুন হয়েছেন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন এবং আক্রমণের শিকার হয়েও কোনরকমে বেঁচেছেন আরেক প্রকাশক।
এই বাস্তবতায় স্ব-ঘোষিত বাঙালি বুদ্ধিজীবী গর্ব করে আর দাবি করতে পারবে না যে, এই উৎসবটি এখন ধর্মীয় সংকীর্ণতা মুক্ত। বাঙালি মানসের বুদ্ধির চর্চার আপসকামিতাকে লালন করেই এগিয়ে চলেছেন বইমেলা।
বাঙালির উৎসব চাই। এটি বই উৎসব। তবে শেষ পর্যন্ত সব উৎসবই হুজুগে গিয়ে দাঁড়ায়। আগেই বলেছি বইমেলাও সেই ললাটলিখন এড়াতে পারেনি। আমাদের প্রকাশকরাও বই প্রকাশকে বানিজ্য ছাড়া খুব বেশি দূর ভাবতে শেখেননি। তবে যতটুকু তারা পেরেছেন সেটাও কম নয়। তাদের কারণেই প্রকাশনা জগত বিস্তৃত হয়েছে, তাদের দৌলতেই বইমেলার অঙ্গ হিসেবে কিছু সাহিত্যসভা বা চর্চা হচ্ছে। মেলাকে উপলক্ষ করে কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে কাটানো, মেলায় জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতার ব্যবস্থা, কিছু চেনা লেখকের পাওয়া না পাওয়ার বিষয় নিয়ে আলোচনার আয়োজন সবই করেন প্রকাশকরা।
প্রকাশক তথা পুস্তকবিক্রেতারা এই মেলায় ভাল ব্যবসা করেন। মেলা শেষে বড় অংকের হিসেব পাই আমরা। কিন্তু লেখকরা রয়্যালটি কতটা পান সেই হিসেবের দেখা মিলেনা। বইমেলা বড় হোক, আরও বিস্তৃত হোক। কিন্তু প্রকাশকদের ভাবনায় প্রাতিষ্ঠানিকতা আসুক। বাজারে বই আসুক ভালভাবে সম্পাদিত হয়ে। আবার বইয়ের লেখক-সম্পাদকরা যেন ভাল পারিশ্রমিক পান সে ব্যাপারে প্রকাশকরা উদ্যোগী হলে, এটি হয়ে উঠতে পারে অনেকের ক্যারিয়ার। সমস্যাটা হল বাংলা বইয়ের জগতে সম্পাদক বলতে ঠিক কী বোঝায় সে ধারণাটাই তৈরি হয়নি। সম্পাদকের এই অভাবের ফলেই অধিকাংশ বাংলা বইয়ের মান ঠিক থাকছেনা, যেনতেনভাবে বাজারজাত হচ্ছে।
গ্রন্থ-সম্পাদক বিষয়টি সব প্রকাশকের কাছে গুরুত্ব পূর্ণ হয়ে উঠুক। আগামীর সব বইমেলায় এটি বেশি করে উপলব্ধি হোক। বইমেলা অবশ্যই বাংলা বইয়ের ব্যবসার জন্য দরকার। বই বিক্রির পাশাপাশি পাঠককে ভাল বইয়ের সাথে পরিচিত করানোরও একটা বড় আকাঙ্খা সৃষ্টি হোক। অসম্পাদিত বা দুর্বলভাবে সম্পাদিত বই মানেই দুর্বল পণ্য। দুর্বল পণ্যের বিপণন বেশিদিন টেকেনা। প্রত্যাশা থাকবে বই-পণ্যের মান উন্নত হোক।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: এডিটর ইন চিফ, সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও জিটিভি।