করোনা সংকটে কেমন সাংবাদিকতা চাই?
৯ মার্চ ২০২০ ১৩:৩৫
বিশ্বের শতাধিক দেশে এখন করোনা ভাইরাস ছড়িয়েছে। এবং তা এখন ভয়াবহ রূপই নিয়েছে। বাংলাদেশে রোববার (৮ মার্চ) করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে জানান দেওয়া হয়েছে। এবং তিনজন এরই মধ্যে এই ঘাতক ভাইরাসে আক্রান্ত তা নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও কয়েকজনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। করোনা ভাইরাস এই মহামারি রূপটি যে নিয়েছে, তা এখন বিশ্বের কোনও মানুষ হয়তো নেই যার জানা নেই। আর নিশ্চিত করেই বলা যায়, এই জানা বা জানানো সম্ভব হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে। কল্যাণ শব্দটি ব্যবহার করলাম এই জন্য যে, মিডিয়া বার্তা পরিবেশন করে সমাজের কল্যাণের জন্যই। কিন্তু সত্যিই কী মিডিয়ার সব খবর কোনও না কোনওভাবে সমাজে কল্যাণ বয়ে আনে? নাকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা অকল্যাণের কারণও হয়ে দেখা দেয় সাধারণ মানুষের কাছে?
আমি বলবো দেয়। তার উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে। আর বিশেষ করে এই ভাইরালিটি ক্রেজড ও ক্লিকবেড জার্নালিজমের যুগে তো রয়েছেই। করোনা ছড়িয়ে পড়ার পর অনেক স্পর্শকাতর বিষয় সামনে আনা হয়েছে। ফেক নিউজ ফ্যাক্টরি থেকে খবর ছড়ানো হয়েছে নানাবিধ। কেউ এতে যুদ্ধাস্ত্র দেখতে পেয়েছেন এই ভাইরাসে, কেউ জীবানু যুদ্ধের পায়তারা দেখেছেন, কেউ ধর্মের বিচার দেখিয়েছেন আবার কেউ যড়যন্ত্র তত্ত্বও তুলে ধরেছেন। তারই মধ্যে এই সাংবাদিকতাও হয়েছে, যা কল্যাণকর। যে সাংবাদিকতা জনসচেতনতা বাড়িয়েছে। ফলে রোগ প্রতিরোধ করা না গেলেও রোগ থেকে প্রতিকারের পথ অনেকেরই এখন জানা। সুতরাং করোনা ভাইরাসের এই মহামারির সময়ে জনসেবার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করা সাংবাদিকতাকেই আমরা বেশি কল্যাণকর বলে বোধ করছি। আর আমরা সেটাই করবো যা এরই মধ্যে যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত তাদের নতুন করে কোনও বিপাকে না ফেলে।
করোনা ভাইরাসের এই সময়ে যে কোনও রিপোর্ট তৈরির সময় আমরা কতগুলো বিষয় মাথায় রাখতে পারি-
এক. যা লিখতে যাচ্ছি সেটি কি খবর হওয়ার মতো কিছু? কেনো?
করোনা ভাইরাস নিয়ে এখন আর রাখঢাক করার সুযোগ নেই। এর সরাসরি প্রভাব যেহেতু জনস্বাস্থ্যের ওপরই পড়ে সেহেতু এ নিয়ে রিপোর্টও পর্যাপ্তই থাকতে হবে। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু কিছু বিষয় রয়েছে যা আদৌ খবর হওয়ার মতো কিছু নয়। যেমন এই করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি কোথা থেকে সে নিয়ে কিছু অনুমাননির্ভর তথ্য ও তত্ত্ব রয়েছে। সেগুলো আমাদের জেনে বুঝে পরিহার করতে হবে।
দুই. আক্রান্তদের তথ্য দেওয়া কী খুব জরুরি?
করোনা ভাইরাসে অনেক মৃত্যু হয়েছে। অনেকে আক্রান্তও রয়েছেন। সার্বিকভাবে আমরা জানি ভাইরাসটি এখন মরণঘাতি। এবং মহমারি রূপও নিচ্ছে। এ অবস্থায় যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের নাম পরিচয় আর বড় কোনও বিষয় হয়ে দেখা দেবে না। যদি কি না, তারা এমন কেউ হয়ে বসেন যারা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। ফলে আমাদের জন্য সার্বিকভাবে এই ভাইরাসের ভয়াবহতার দিকগুলো তুলে ধরাই যথেষ্ট। যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের পরিবার পরিজন বন্ধু-বান্ধব রয়েছেন। পরিচয় তুলে ধরা হলে তারা সামাজিকভাবে হেনস্তার শিকার হতে পারেন। যা সংবাদকর্মীদের মনে রাখতে হবে।
তিন. কাকে উদ্ধৃত করবেন? কাকে করবেন না?
যখন কোনও বিষয়ের সঙ্গে গোটা জাতি, কিংবা গোটা বিশ্বই জড়িয়ে পড়ে তখন সাংবাদিকতায় সম্পূর্ণ নির্ভরতা থাকতে হবে কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের ওপর। কর্তৃপক্ষকে উদ্ধৃত করে খবর পরিবেশনাই সবচেয়ে সঠিক পথ। করোনা ক্রাইসিস শুরু হওয়ার পর থেকে আমরা দেশে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর পক্ষ থেকে নিয়মমাফিক ব্রিফিং পাচ্ছি। সুতরাং যখন যেটুকু আপডেট তা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের পক্ষ থেকেই। দেশের মানুষকে করোনার ভয়াবহতা নিয়ে সচেতন করতে সেটুকুই যথেষ্ট। হ্যাঁ কোনও সংবাদকর্মী যদি এই তথ্যের চেয়ে ভিন্ন কিছু জেনে থাকেন তাহলে তা নিউজ হবে না তা নয়, কিন্তু সঠিকভাবে যাচাই করে, চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হয়ে, তথ্যনির্ভর হয়েই তা করতে পারবেন। যাকে তাকে উদ্ধৃত করে খবর দিয়ে দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।
চার. খবরটি কোন কাঠামোয় হবে? খবরের সঠিক সংবাদমূল্য উপস্থাপনে আপনার কাঠামোটি কতটা সঠিক?
মিডিয়ার খবর পরিবেশনা যেনো কোনওভাবে আতঙ্ক সৃষ্টি না করে সেটি লক্ষ্য রাখতে হবে। সুতরাং বিষয়টিতে ভীত না হয়ে যাতে মানুষ সতর্ক হতে পারে সে দিকটি মাথায় রেখে দায়িত্বশীলতার সাথে মানবিক আবেদনকে সামনে এনে খবর পরিবেশনাই এমন সময়ে কাম্য। এরকম সময়ে ব্লেমগেম খুব চলে। যেমন ধরুন, গেলো কয়েকদিন খুব চাউর হয়েছে, কোনও কোনও মিডিয়া দায়িত্বহীনভাবেই খবর দিয়েছে, দেশে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু সরকার তা লুকিয়ে রাখছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে করতেই এটা করা হচ্ছে বলে মনগড়া তত্ত্ব ও তথ্যও দেওয়া হয়েছে সেসব খবরে। অথচ আমরা দেখতে পেলাম এখানে সরকারের কিছু করার নেই। আইইডিসিআর যে মূহূর্তে নিশ্চিতভাবে করোনা আক্রান্তদের বিষয়ে জানতে পেরেছে তারা খবরটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে। এই খবরের মূল দিকটি হচ্ছে- আমরা এই ভাইরাসে ঝুঁকি ও সংক্রমণের বাইরে নেই, সুতরাং জনগণকে সচেতন থাকতে হবে। আরও জানিয়ে দেওয়া যে, আক্রান্তদের এরই মধ্যে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তাদের নিঃসঙ্গ করা হয়েছে এবং কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এটিও এই জন্য যে, জনমনে যাতে একটি স্বস্তির জায়গা তৈরি হয় এই ভেবে যে, সরকার তার দায়িত্বশীলতা যথাযথভাবেই পালন করছে।
পাঁচ: গুজব যেনো না ছড়ায়, হুজুগ যেনো তৈরি না হয়
সকল দেশেই গুজবে কান দেওয়া মানুষ রয়েছে। আর মানুষ গুজবে কান দিতে পছন্দও করে। বাংলাদেশি বা বাঙালি তো আরেক কাঠি সরেশ। এই জাতিকে হুজুগে বাঙালি বলে ডাকা হয় বহুকাল ধরে। সেক্ষেত্রে এমন ধরনের জাতীয় সংকটে এই বাঙালিকে বশে রাখা যথেষ্টই কষ্টকর। এই আমাদেরই কেউ কেউ আকাশের চাঁদে সাঈদীকে দেখা গেছে এমনটা জেনে বিশ্বাস করে গ্রাম-শহর পুড়িয়ে দিয়েছে। রোববারই, করোনা ভাইরাসের খবরে ফার্মেসিগুলোতে মাস্ক, হেক্সিসলসহ আরও কিছু জীবানুনাশক ও জীবানু প্রতিরোধোক কেনার হিড়িক পড়ে যায়। মাত্র তিন ঘণ্টার মধ্যে ফার্মেসিগুলোতে এই পণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বাড়তি মুনাফার জন্য কৃত্রিম সংকটও তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বিক্রি শুরু করেছে, রাত না পোহাতেই কাঁচাবাজারে করোনার প্রভাবে দাম বাড়তি, শেয়ার বাজারে দেখা গেছে দরপতন। এসবই হুজুগের কারণে সৃষ্ট। সুতরাং হুজুগে বাঙালিকে বশে রাখতে, শান্ত রাখতে. ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করার মতো ঘোড়েল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করতেও শেষ পর্যন্ত মিডিয়াকেই ভূমিকা রাখতে হবে।
আর এ কাজে বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বুঝি একটু বেশিই সচেতন থাকতে হবে। সুতরাং আপনার দেওয়া খবরটি কতটা ভাইরাল হবে, সেটা না ভেবে খবরটি এমনভাবে লিখুন, এমন ঢঙে পরিবেশন করুন যাতে কেউ হুজুগে মেতে না ওঠে, কেউ আতঙ্কিত হয়ে না পড়ে এবং কেউ পরিস্থিতির ফায়দা তুলে নিতে না পারে। সার্বিকভাবে আপনার সংবাদটি যেনো কল্যাণকর কিছু হয়।
জানেনইতো শেষ পর্যন্ত কিন্তু সব কিছুর পেছনে মিডিয়াকেই বেশি দায়ী বলে চিহ্নিত করা হবে। অতএব আমরা সাবধান থাকলে, দেশের সাংবাদিকতা সুরক্ষা পাবে। করোনায় ভীতি না ছড়িয়ে জনসচেতনতার কল্যাণমুখী সংবাদচর্চাই হোক আমাদের এখনকার প্রত্যয়।
সারবাংলা/এমএম