বসন্ত থেমে গেছে, বাউরি বাতাসে জেগে করোনাকাল
১০ এপ্রিল ২০২০ ১৯:৪৫
‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে, ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে
এখন যে প্রয়োজন তোমাকে, নিঃসঙ্গ এই হৃদয়ে’
— গীতিকার আশরাফ বাবুর লেখা, পার্থ বড়ুয়ার সুরে কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া এই গানটি নব্বুয়ের দশকে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তখন অনেকের মুখে মুখে ফিরতো এই গান। তবে ওই সময় বসন্ত নিয়ে মানুষের এমন ব্যস্ততা ছিল না। আবহ উপলব্দি করেই রোমান্টিকতায় বিভোর থাকতো মানুষ। কিন্তু এখন মানুষ বসন্তকে উৎসবের রঙে সাজায়। এখনকার বসন্ত কথা-কবিতায়-গানে মানুষ ও প্রকৃতির নবপ্রাণে অন্যরকম দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়। ‘বসন্ত এসে গেছে’ বলে আমরা প্রকৃতির প্রাণচাঞ্চল্যে বিভোর হই; পাশাপাশি উৎসবে মাতি। বসন্তের প্রসূণ ছোঁয়ায় মনে জাগে উৎসবের রঙ। তবে এককালে বসন্ত ছিল আতঙ্কের নাম। এই নামে একটি রোগও ছিল।
একসময় এই বসন্ত রোগকে বলা হতো ‘গুটিবসন্ত’ বা ‘ওলা ওঠা’। আর এই ‘ওলা ওঠা’ নাম শুনলেই মানুষের পিলে চমকে উঠতো। তখনকার দিনে ওলা ওঠা রোগে হাজার হাজার মানুষ মারা যেত। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যেত গুটিবসন্ত বা ওলা ওঠা রোগে। ভারতবর্ষে একবার বসন্ত রোগের মারাত্মক প্রকোপ দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন—
‘কোথা ব্রজবালা, কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি!
কোথা ছা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।’’
তবে সময় এখন পাল্টেছে। পৃথিবী থেকে নির্মূল হয়েছে গুটিবসন্ত। কিন্তু আমরা বসন্ত রোগ থেকে নিস্তার পাইনি। আমাদের মাঝে এসে হাজির হয়েছে জলবসন্ত বা চিকেন পক্স। এই চিকেন পক্স হয় ভ্যারসিলো জস্টার নামক ভাইরাসের কারণে। এই রোগে শরীর ম্যাজম্যাজ করে, প্রচণ্ড মাথাব্যথা থাকে, থাকে গা-হাত-পা ব্যথাও। সেইসঙ্গে থাকে জ্বর ও সর্দি-কাশি। এরপর শরীরে ঘামাচির মতো কিছু একটা উঠতে দেখা যায়। তারপর সেগুলো বড় হতে শুরু করে ও ভেতরে পানি জমতে থাকে। এভাবে সেগুলো পুরো শরীরে বিশেষ করে বুকে–পিঠে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে পানি শুকিয়ে ঝরে যায়। তবে এই রোগে এখন মানুষের মৃত্যু নেই বললেই চলে।
‘ওলা ওঠা’ নামের সঙ্গে মিল রয়েছে এমন আরেকটি রোগের নাম হলো ‘চোখ ওঠা’। ছোটবেলায় দেখতাম আমিসহ সমবয়সী অনেকেরই ‘চোখ ওঠা’ ছিল বছরের একটা সময়ের জন্য নিত্য ব্যাপার। প্রতিবছরই শীতের শেষ দিকে এবং বসন্তের শুরুতে চোখ উঠতো। এটিও মূলত ভাইরাসজনিত রোগ। কিন্তু প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে রোগটি ‘চোখ ওঠা’ নামেই পরিচিত। আগে এক ধরনের অয়েন্টমেন্টে মুক্তি পাওয়া যেত এই ভাইরাস থেকে। তবে এখন অনেক ধরনের ওষুধ বের হয়েছে। যদিও ‘চোখ ওঠা’ রোগে কাউকে মারা যেতে দেখিনি অথবা কারও চোখ অন্ধ হয়ে যেতে দেখিনি। এই রোগের প্রাদুর্ভাব এখন খুব একটা নেই বললেই চলে।
শীত ও গ্রীষ্মের মাঝের ঋতু বসন্ত। এই বসন্তই আবহাওয়াকে ঠাণ্ডা থেকে গরমে নিয়ে যেতে সাঁকো হিসেবে কাজ করে। সারাদিনে ঠাণ্ডা-গরমের তারতম্যের ফলে এই নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় বাতাসে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু জন্ম নেয়। কারণ শীতকালে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ থাকায় বিভিন্ন ভাইরাসের জন্ম হয়। সেই ভাইরাস একটু গরমের ছোঁয়ায় বের হয়ে বাতাসে মেশে। ফলে এই সময় বাড়ে রোগের প্রকোপ।
অনেকেই হয়তো বসন্তের বাউরি বাতাসের সঙ্গে পরিচিত। একটু ফাঁকা জায়গা পেলেই এই বাতাস ঘূর্ণির মতো উপরের দিকে উঠে যায়। আবার অনেক সময় ধূলোমাখা প্রকৃতির প্রাণে দোল দিয়ে যায় আপন মনে। এই বসন্তেই দেখা যায় অসম্ভব সুন্দর গোধূলি। তবে অনেক আগে গ্রামে গ্রামে কিছু কথা ও অতিকথার প্রচলন ছিল- বসন্তের বাউরি বাতাস যার গায়ে স্পর্শ করবে সেই রোগে ভুগবে; অথবা তাকে ভূতে ধরবে। গ্রামের মানুষের মধ্যে ভূত-প্রেতের বিশ্বাস ছিল প্রখর। এমনকি ওই সময় ওঝা ডেকে অনেকের ‘ভূত নামানো‘ও হতো। কিন্তু আমি আসি রোগের কথায়। বসন্তেই দেখা যেত কেউ কেউ প্রচণ্ড বমি করছে, তাদের মাথা ঘুরছে; এমনকি কেউ কেউ অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। এরকম হলো গ্রাম্যভাষায় বলা হতো ‘পোকা ধরা’ রোগ। কোনো একধরনের পোকায় ছুঁয়েছে বলে এরকমটা হয়েছে। লবণ ও পানিপড়া খেলে নাকি সেই রোগ ভালো হয়ে যেত।
বাপ-চাচার কাছে শোনা, একসময় বসন্তের বাউরি বাতাস গ্রামে গ্রামে কলেরা রোগ বয়ে নিয়ে যেত। সেজন্য বসন্তের বাউরি বাতাস দেখলে অনেকের মনে ভয় ও সংশয় দেখা দিত- এই বুঝি গ্রামে বসন্ত, কলেরা অথবা হাম এলো। যে গ্রামে একবার কলেরা ঢুকতো সেই গ্রামে এই রোগটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তো। দেখা গেছে, এক বাড়িতে কেউ একজন কলেরায় আক্রান্ত হলে পরে ওই বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের আক্রান্ত করে পুরো পাড়া এবং এক সময় পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ত। আর তখন কেউ কলেরায় আক্রান্ত হলে মৃত্যু প্রায় নিশ্চিতই ছিল। হঠাৎ কেউ হয়তো বেঁচে ফিরত। তবে বেশিরভাগই মারা যেত। ওই সময় কোনো গ্রামে কলেরা দেখা দিলে মানুষ খুব একটা বাড়ির বাইরে বের হতো না। নিজেদের ঘরে বন্দি রাখাই ছিল কলেরা থেকে পরিত্রাণের উপায়। এখন আর সেরকমটি নেই। মানুষ কলেরা রোগকে চিকিৎসা পদ্ধতি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কলেরার মতো হামও দেখা দিত এই সময়। এই রোগ শিশুদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতো। হামে অনেক শিশু মারা যেত এক সময়। আর যারা বেঁচে থাকতো হয় তারা বিকলাঙ্গ হতো, নয়তো বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তবে এক পর্যায়ে এসে হামের টিকা আবিষ্কারের ফলে এই রোগটি বাংলাদেশ থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে।
আজ থেকে একশ বছর আগে ক্যানসার, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, হার্ট-অ্যাটাক, লিভার সিরোসিস ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধির সঙ্গে মানুষের পরিচয় ছিল না। বড় ধরনের রোগ বলতে কলেরা, বসন্ত, হাম, টাইফয়েড, যক্ষ্মা- এগুলোই মানুষকে আতঙ্কে রাখতো। যক্ষ্মা এমনই ভীতিকর ও বিপজ্জনক রোগ ছিল যে বলা হতো- ‘যার হয়েছে যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’। ছোঁয়াচে ভেবে অনেকেই ভয়ে যক্ষ্মা রোগীর ধারে কাছে যেত না। এমনকি বাড়িঘরের আশপাশ দিয়েও কেউ যাতায়াত করতে চাইতো না। এখন চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার হওয়ায় আমাদের সেই যক্ষ্মা থেকে পরিত্রাণ মিলেছে।
পৃথিবীতে সংক্রামক রোগের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। কোনো একটি রোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো তাকে মহামারি বলে। এর আগেও পৃথিবীতে অনেক রোগ মহামারি রূপ ধারণ করেছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ অব্দে বর্তমানের লিবিয়া, ইথিওপিয়া ও মিসর ঘুরে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে ছড়িয়ে পড়েছিল এক ধরনের টাইফয়েড জ্বর। এই জ্বরে ওই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মারা যায়। ৫৪১ খ্রিষ্টাব্দে মিশর থেকে পুরো পৃথিবীতে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে জাস্টিনিয়ান প্লেগ। এতে মারা যায় প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। ১৩৫০ সালে ছড়িয়ে পড়া বুবোনিক প্লেগে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের মৃত্যু হয়েছিল। ১৬৬৫ সালে এই বুবোনিক প্লেগেই লন্ডনের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশের মৃত্যু হয়। ১৮৫৫ সাল চীন থেকে সূত্রপাত তৃতীয় প্লেগ মহামারি। পরে তা ভারত ও হংকংয়ে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই মহামারির শিকার হয়েছিল।
১৮১৭ সালে কলেরা রোগের প্রথম মহামারির শুরুটা হয়েছিল রাশিয়ায়। পরে তা স্পেন, আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, জার্মানি, ভারত ও আমেরিকায়ও মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় সারাপৃথিবীতে প্রায় ২২ থেকে ২৩ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। পরবর্তী সময় প্রায় দেড়শ বছর ধরে কলেরা বিভিন্ন সময়ে কয়েক দফা মহামারি আকারে দেখা দেয়। ১৮৮৯ সালে সাইবেরিয়া ও কাজাখস্তানে সূত্রপাত রাশিয়ান ফ্লুর। পরে তা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পরে। এই ফ্লুতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯১৮ সাল স্প্যানিশ ফ্লুতে প্রায় ৫০ কোটি লোক আক্রান্ত হয়। আর এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৫৭ সালে হংকংয়ে প্রথম এশিয়ান ফ্লু দেখা দেয়। এই ফ্লুটি দ্বিতীয়বার ছড়ায় ১৯৫৮ সালে। এতে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
নিজেদের উত্তরণ ঘটিয়ে মানুষ যখন আদিম যুগ থেকে কৃষিযুগে প্রবেশ করে সংঘবদ্ধ হয়ে বসবাস শুরু করতে থাকে তখন থেকেই বিভিন্ন সংক্রামক রোগ মহামারিতে রূপ নিয়ে মনুষ্য জাতিকে আঘাত করেছে। ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, গুটিবসন্ত, কলেরা, হাম প্রভৃতি রোগ নানা সময়ে মহামারি রূপ নিয়েছে নিয়েছে। মানবসভ্যতা যত উন্নত হয়েছে, মহামারির প্রবণতা তত বেড়েছে। কারণ সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে জনসংখ্যার ঘনত্বও বেড়েছে পৃথিবীতে। ফলে যেকোনো রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
এই মুহূর্তে নিকট অতীতের সবধরনের রোগের রেকর্ড ছাপিয়ে পৃথিবীব্যাপী ত্রাস সৃষ্টি করেছে একটি ভাইরাস। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম ভাইরাসটির প্রকোপ দেখা দেয়। প্রথম ধারণা করা হয়েছিল এটি নিউমোনিয়া। কিন্তু নিউমোনিয়ার চিকিৎসায়ও রোগটি ভালো হচ্ছিল না। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল, এটি এক ধরনের করোনাভাইরাস। পরবর্তী সময়ে যার নাম দেওয়া হয়- নভেল করোনাভাইরাস এন কভ ২০১৯ ( সার্স কভ২) । এটি নিকট অতীতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়া অন্যান্য ভাইরাস থেকে একদম আলাদা বৈশিষ্ট্যের। মানবদেহে এর বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ ব্যবস্থাই গড়ে ওঠেনি। এমনকি এ পর্যন্ত এটি প্রতিরোধে কোনো টিকা কিংবা সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠার জন্য কোনো ওষুধও আবিষ্কার হয়নি। জানা গেছে, ভাইরাসটি মানবদেহে কমপক্ষে ১৪ দিন থাকে। এর মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রথমে গলাব্যাথা, পরে সর্দি-জ্বর এবং এক পর্যায়ে গিয়ে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। আর ভাইরাসটি যখন মানবদেহে মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তার করে তখন অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে বমি, পেটব্যাথা এবং ডায়রিয়াও দেখা দেয়। এ পর্যন্ত জানা গেছে, যাদের শরীরে অ্যান্টিবডি বেশি তারা স্বাভাবিকভাবে সেরে ওঠে। আর যাদের শরীরে অ্যান্ডিবডি কম তাদের জন্য ভেন্টিলেশন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের (আইসিইউ) প্রয়োজন হয়। এদের মধ্য থেকে কেউ কেউ ফিরে আসে আবার কেউ কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ভাইরাসটি এ পর্যন্ত পৃথিবীর ২০৯টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পৃথিবীব্যাপী এতে আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছে কমপক্ষে ৯৬ হাজার। এটি এখন বিশ্বব্যাপী মহামারিতে পরিণত হয়েছে। করোনাভাইরাসটি চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়লেও সেখানে আক্রান্ত অনুযায়ী আনুপাতিক হারে মৃত্যুর সংখ্যা কম। তবে ইতালিতে ভাইরাসটি মারত্মক আকার ধারণ করেছে। এর পরেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইরান, সৌদিআরব, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ। তবে চীন থেকে ভাইরাসটির উৎপত্তি হলেও তারা সময় মতো পদক্ষেপ নেওয়ায় দেশটিতে মৃত্যুর হার অন্যান্য দেশের তুলনায় কমাতে পেরেছে। তাদের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে ছিল- প্রথমেই আক্রান্ত উহানকে চীন থেকে আলাদা করে দেওয়া অর্থাৎ পুরোপুরি লকডাউন। এরপর তারা ব্যাপকভিত্তিক টেস্টের মাধ্যমে কেস ডিটেকশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং করে। এরপর কঠোর কোয়ারেনটাইনের মাধ্যমে করোনাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছে। এরকম পদক্ষেপ নিয়েছে চীনের প্রতিবেশী রাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়াও। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ সময় মতো করোনা প্রতিরোধে পদক্ষেপ না নেওয়ায় এখন তা মহামারি আকার ধারণ করেছে। ভাইরাসটিতে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারাও যাচ্ছে হাজার হাজার। আর এ সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে।
গ্লোবাল ভিলেজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশও এই রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে চার শতাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে কমপক্ষে ২৭ জন। পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে মহামারির দিকে যাচ্ছে। ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণের সময়ও ফুরিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ১৭ কোটি মানুষের এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এখনই যথাযথ কোয়ারেনটাইন এবং সামগ্রিক লকডাউন প্রয়োজন। না হলে আমাদের অবস্থাও যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও স্পেনের মতো ভয়াবহ হতে পারে। করোনার বিস্তার রোধে জনগণের উচিত সরকারের দেওয়া নির্দেশগুলো কঠোরভাবে মেনে চলা। এছাড়া সকলকে আরও সচেতন হয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার অভ্যাস গড়ে তোলা। আর করোনার ক্রমবর্ধমান বিস্তার ঠেকাতে দ্রুততম সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যক কেস ডিটেকশন করে কোভিড-১৯ পজেটিভ রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান, কন্টাক্ট ট্রেসিং করে তাদের কোয়ারেনটাইন নিশ্চিত এবং যথাযথ লকডাউন এখন সময়ের দাবি। না হলে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভয়াবহ মহামারি।
আতঙ্ক মানুষকে তখনই স্পর্শ করে যখন সে ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারে। আর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে করতেই সে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়ায়। আমরা সেই জায়গায় দাঁড়াতে চাই না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের উদাহরণ দেখে নিজেরা সচেতন হই। ঘরে থাকি। সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে থাকাই এখন করোনা মহামারি ঠেকানোর একমাত্র পথ। বসন্তের সব আয়োজন থেমে গেছে। তার বাউরি বাতাসে জেগে করোনাকাল। গ্রীষ্মের দাবদাহে কিছুদিন সেটা আগুন জ্বালাবে। তবে কাল বৈশাখী ঝড় বাংলাদেশ থেকে সেই দাবদাহের আগুন উড়িয়ে নিয়ে শীতল ও স্নিগ্ধ পরিবেশ এনে দেবে বলেই প্রত্যাশা। যে পরিবেশে মানুষ আবারও লকডাউন ও আতঙ্ক ছাড়াই বাঁচবে।
লেখক: সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী