করোনার ক্ষয় বুঝবে সবাই, ততদিনে দেরি না হয়ে যায়
১৮ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৪০
আমি মার্চ মাসের ১৭ তারিখে কক্সবাজারে পৌঁছলাম আর শুরু হলো করোনার প্রকোপের প্রাথমিক পর্যায়। আমার সহকর্মীরা ঠাট্টা করেন যে আমি নাকি যেখানে যাই সেখানেই মহামারি শুরু হয়। আফ্রিকাতে যাওয়ার পরে শুরু হয়েছিল জিকা ভাইরাস আর প্রাণঘাতী ইবোলা। আর এখানে আসতে না আসতেই করোনা। কে জানে আমার সাথে মহামারির কি সংযোগ!
কক্সবাজারে আমি এখনও হোটেলে থাকি। কোভিড-১৯ এর কারণে বাসায় উঠা হয়নি এখনও। হোটেলে কয়েকজন সহায়তাকারী আছেন। তার মধ্যে সামিনা (ছদ্মনাম) নামের একজন নারীকর্মী পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। তার সাথে কথা বলি টুকটাক। মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পায় আর দুপুরের খাবার। স্বামী রিকশা চালায়, দুটি সন্তান তার। কক্সবাজারে লকডাউন শুরু হবার পরে দু’একদিন স্বামীটি চুপেচুপে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিল পুলিশের দাবড়ানিতে ফিরে এসেছে। রিকশার জমার টাকাও উঠে নাই। সামিনা ঘরভাড়া দেয় ১৮০০ টাকা, ছেলের স্কুল এখন বন্ধ বলে পড়ার বাবদে কোন খরচ এখন নাই। কিন্তু ছোট সন্তানের দুধের খরচ আছে। নিজেদের খাবার, গ্যাস কিনতে হয় রান্নার জন্য, ওষুধপাতি না হয় বাদই দিলাম। ‘কিভাবে চালাচ্ছো’ জানতে চাইলে বারান্দার ফ্লোর মুছায় ব্যস্ত সামিনার হাত থেমে যায়। মুখ তুলে তাকিয়ে হাসে সে, তার চোখের তারার বেদনা, ক্ষোভ আর ব্যাঙ্গমাখা হাসির সামনে আমি কুঁকড়ে যাই। দুটো মুরগী ছিল তাদের, ডিম দিত। গত সপ্তাহে একটাকে কেটে খেয়েছে। আরেকটা বিক্রি করে আড়াইশ টাকা পেয়েছে। হোটেল থেকে তাকে যে খাবার দেয়, সেটা এখন সে বাড়িতে নিয়ে যায় দুই সন্তানের জন্য। সকালে সে নাস্তা করেছে কিনা জানতে চাই। মুখভরা পান নিয়ে আবার হাসে সে, ‘আফা, চা খাইছি, আর পান খাইলে খিদা একটু কম লাগে।’ সকালে নাস্তায় খাওয়া ডিম রুটি আমার পেটের ভেতরে লাথি মারে।
কিন্তু সামিনার কাহিনী কি কোন একক কাহিনী? নীরব দুর্ভিক্ষের সামিনা কাহিনী লক্ষের কোটা ছাড়িয়ে যাবে কয়েক সপ্তাহে, কোটি ছাড়াবে কয়েক মাসে।
আমি ভাবি, ক্ষুধা কষ্টের কথা বাদ দিয়ে না হয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয় নিয়ে কথা বলি। সামিনার একটা মাস্ক আছে কিন্তু সেটা পরলে তার দম বন্ধ লাগে! বাচ্চারা বাসায় বারে বারে হাত ধোয় কি না জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, যতক্ষণ সে বাসায় থাকে চেষ্টা করে কিন্তু সাবানের খরচও তো ব্যাপার। তবু সে দাম দিয়ে লাক্স সাবান কিনে এনেছে! আমি বুঝাতে চাই- লাক্স নয়, দরকার কাপড়কাচা সাবান। তাকে কিছু মাস্ক আর রিইউজেবল গ্লাভস দেই আর একটা হ্যান্ডওয়াশ। খুশি হয়ে ধন্যবাদ জানায় সে। সঙ্গে এও বলতে ভুলে না ‘গরিবরে আল্লায় দেখবে!’ তার এই কথার উত্তর দেই না সঙ্গত কারণেই। বারে বারে মাস্ক পরা আর সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার কথা মনে করিয়ে দিই। সামাজিক দূরত্ব পালন করার কথাও বোঝাতে চেষ্টা করি। তার সমঝদার মাথা নাড়া দেখে আশ্বস্ত হই যাক কাউনসিলিং কাজে লেগেছে। পরেরদিন সকালে মাস্কবিহীন, গ্লাভস ছাড়া সামিনাকে সিঁড়িতে দেখে আমি হতবাক! সে কাঁচুমাচু স্বরে বলে, ‘দম বন্ধ হয়ে আসে আফা’। তবে সে আমাকে অভয় দেয়, ‘হাত ধুইছি আফা আর ধোয়া কাপড় পরে আসছি, বাসায় গিয়া গোসল করে কাপড় ধুইয়া ফালামু’। আমি নিমিষে অনুভব করি আমদের কমিউনিটি কর্মীদের এতো চেষ্টার পরেও মানুষ যখন ব্যাপারটার ভয়াবহতা বা গুরুত্ব বুঝে না তখন মনের অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তাদের।
শুধু কক্সবাজারেই ব্র্যাকের কর্মীরা মার্চ মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে লাখের বেশি মানুষের কাছে কোভিড-১৯ থেকে বেঁচে থাকবার উপায় এবং তথ্য পোঁছে দিয়েছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন উপজেলা, ইউনিয়ন আর গ্রামের মানুষদের কাছে। সেই সংখ্যা এখন সাড়ে তিন লাখের বেশি। এক হাজারের মতো হাত ধোয়ার স্ট্যান্ড বা হ্যান্ড ওয়াশিং স্টেশন করা হয়েছে সাবান এবং পানির সুবিধাসহ। সামাজিক দূরত্ব পালন যখন শুরু হলো তখন মেগাফোনে মাইকিং করে মানুষের কাছে তথ্য পৌঁছানোর কাজ চলেছে। কুদ্দুস বয়াতি আর শিল্পী সাংসদ মমতাজ ব্র্যাকের সাথে এগিয়ে এসেছেন তাদের কণ্ঠে সুরে সুরে মানুষকে সাবধান বানী পৌঁছে দিতে। ব্র্যাকের সকল কর্মীকে মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করা হয়েছে। আমাদের অফিসে একসাথে দুইশ মানুষ বসে কাজ করবার মতন ওয়ার্ক স্টেশন আছে। কিন্তু সেখানে এখন হাতে গোনা দশ জনের বেশি মানুষ পাওয়া যাবে না। তাও তারা সরকার ঘোষিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে জরুরি কাজগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত। আমাদের চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মীরা সুরক্ষার যাবতীয় নিয়ম মেনে এবং সুরক্ষিত হয়ে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন। তারপরও ঝুঁকি থেকে যায় এই অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণের।
টিভিতে যখন দেখি সেনাবাহিনী বা পুলিশকর্মীরা নিজের স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে সাধারণ জনগণকে করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে তাদেরকে বাইরে ঘুরাঘুরি না করবার জন্য বলছেন তখন ভারি অবাক লাগে, কষ্টও লাগে। দরিদ্র মানুষের কথা বুঝি, পেটে ক্ষুধার কষ্ট করোনার ঝুঁকির ভয় থেকেও বেশি। কিন্তু যাদের পেটের দায় নেই তারা কেন এমন বেহুদা কাজ করবেন! মনোবিজ্ঞানীরা হয়তো বলতে পারবেন, মহামারির সময়ে মানুষের এমন কর্মকাণ্ডের কারণ! আমার কেন যেন মনে হয়, জাতি হিসাবে আমাদের মধ্যে ‘আমার কিছু হইবো না’ বা ‘কপালে থাকলে যা হইবার হইবো’ ইত্যাদি যে মনোভাব আছে এই বেয়াক্কেলে কাজকারবার তারই প্রকাশ। হোটেলের বারান্দা থেকে সামনের বাড়ির ছাদে নাহলেও কুড়িজন মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শব ই বরাতের নামাজ করছেন দেখে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, বাড়িটি একজন স্থানীয় কমিশনারের। সারাদিন ধরে মাইকিং শুনি, আপনারা দয়া করে ঘরে থাকুন, বাইরে অযথা ঘুরাঘুরি করবেন না।“আবার মনে হয় আমাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা বা স্বার্থপরতাও একটা ব্যাপার। শুধু নিজেরটুকু ঠিক থাকলেই হয়, অন্যের কথা ভাবার দরকার কি! কখন যে বুঝতে পারবো শুধু নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই যথেষ্ট নয়। যুথবদ্ধ নিরাপত্তা দরকার এই ভাইরাসকে বিরত করতে। জানি একসময় বুঝবে সবাই, কিন্তু ততদিনে দেরি না হয়ে যায়।
মনে পড়ে ২০১৯ এর ইবোলা মহামারীর সময়ে উগান্ডার মানুষকে দেখেছি সরকারী সকল নির্দেশ রিলিজিয়াসলি মেনে চলতে। আফ্রিকার এই গরীব দেশে স্বাস্থ্যব্যাবস্থা প্রায় নাই এর কোঠায়, তারপরেও সারা দেশের মানুষ সরকারের সাথে সংহতি প্রকাশ করে চার মাসের মাথায় ইবোলার মতন প্রাণঘাতী মহামারীকে রুখে দিতে পেরেছিলো । চার্চ, মসজিদ সব জায়গায় মানুষের সমাগম কমিয়ে আনা হয়েছিল। ২০১৯এর মে মাসের ২৫ তারিখে প্রথম ইবোলা সাসপেক্ট এর রেজাল্ট পজিটিভ কনফার্ম হয়েছিলো জুন মাসের ৩ তারিখে আর এই ৯ দিনের মধ্যেই উগান্ডা সরকারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সবধরনের সম্ভাব্য ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেছিল। স্বাস্থ্য মন্ত্রী মাদাম ডাঃ জেন রুথ আচেং দ্রুত টাস্ক ফোরস গঠন করে , এনজিও এর সাথে বৈঠক করে দায়িত্ব বণ্টন করে দেন। অসম্ভব কর্মঠ এই মানুষটিকে দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে দেখেছি। তাঁর টুইটার একাউন্ট থেকে পাওয়া যেত সব খবরাখবর। নিজে উপস্থিত থাকতেন সভাগুলিতে, তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত দিয়ে দিতেন। সবাই মিলেই ইবোলা রুখতে পেরেছিলাম, হ্যাঁ আমিও ছিলাম সেই টাস্ক ফোরসে।
আফ্রিকা থেকে চলে এসেছি বছরের শেষে, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় নাই। উগান্ডা আবারও এখন পর্যন্ত সফলতার সাথে করোনা মোকাবিলা করছে। মাদাম জেন এখনো স্বাস্থ্যমন্ত্রী আছেন এবং সবাইকে সাথে নিয়েই কাজটিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। আমি এখনো তাঁর টুইটার থেকেই খবরাখবর পাই। আফ্রিকার দেশ উগান্ডা তাদের ঢিলেমির জন্য বিখ্যাত, অথচ তারাই করোনার আগে আগে দৌড়চ্ছে আর সময় পেয়েও আমরা কাজে লাগাতে পারিনি। উগান্ডার সাফল্যে ভাল লাগে, নিজের দেশের ব্যর্থতা দেখে কষ্ট লাগে।
চিকিৎসকদের কথা বলছিলাম, আমাদের দেশে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে অনেক সমালোচনা হচ্ছে। ডাক্তাররাও মানুষ আর মানুষ ভয় পায়। কেউ কেউ ভয়ের কাছে প্রথমেই হার মানে আবার অনেকেই রুখে দাঁড়ায়। ভয় ভেতরে নিয়েই রুখে দাঁড়ায়। আমাদের দেশেও তাই হচ্ছে ক্রমশ। আমাদের ডাক্তাররা রুখে দাঁড়াচ্ছেন ভাইরাসের বিরুদ্ধে সীমিত রিসোর্সে যতখানি পারা যায়। কিন্তু আসলে তো তাঁদের সুরক্ষা অনেক জরুরী। আমাদের ডাক্তার নার্স, সকল স্বাস্থ্যকর্মীর সুরক্ষা এখন ফার্স্ট প্রায়োরিটি, তাঁরা ইনফেক্টেড হয়ে পরলে আমাদের জন্য কে লড়বে? এটাও আমরা ভুলি কেমন করে যে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা উপকরণ (পিপিই) ছাড়াই আমাদের অনেক ডাক্তাররা প্রথমদিকে রোগীর সেবা দিয়েছেন। তাঁদের সেই সাহসিকতার জন্য আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।
দিনের শেষে মানুষের পাশেই মানুষ দাঁড়ায়, ভয় নিয়েও দাঁড়ায়। পরস্পরের হাত ধরে উষ্ণতা যোগায়, সাহস যোগায় আর এভাবেই এই পৃথিবী এগিয়ে যায়।
লেখক: উন্নয়নকর্মী
ইমেইল: [email protected]