করোনা ক্রান্তি— পরিবর্তনের গান গাইছে পৃথিবী
১৯ এপ্রিল ২০২০ ০৭:০৯
নিষ্ঠুর সুন্দর একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। জীবনভর যে মানুষ শিখে এসেছে একসাথে থাকতে হবে, পরিচিত কাউকে দেখলেই যে আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে স্পর্শ করার জন্য, জড়িয়ে ধরেছে একটু শান্তির আশায় সেইসব কর্মকাণ্ডই না কি এখন মৃত্যু ডেকে আনবে।
একসময় আপন জনের মৃত্যুর সংবাদ পেলে সবাই দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতো এখন মৃত্যুর সংবাদে সবাই যত দূরে পারে পালিয়ে যাচ্ছে। মানুষেরা প্রচণ্ড উৎকণ্ঠিত।
মৃত্যুভয়ের পাশাপাশি রয়েছে জীবিকা উপার্জনের উপায় হারিয়ে ফেলার ভয়। ক্ষমতা যার আছে সে ক্ষমতা হারিয়ে ফেলার। ভয়ে আছে। সবাই কোন না কোন ভয়ে আক্রান্ত। অথচ দরজা খুলে বাইরে ঝুলে থাকা কাঠের বারান্দাটায় এসে দেখি প্রকৃতিতে কোথাও কেউ মানুষের জন্য কাঁদছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের যে ছোট্ট শহরটাতে আমি থাকি সেখানে এখন বসন্ত এসেছে। এতদিনের প্রচণ্ড শীতে মরে কাঠ হয়ে যাওয়া সব গাছেরা, শুকিয়ে যাওয়া ঘাসেরা আবার খলবল করে হেসে উঠেছে। গাছে গাছে বেগুনি, সাদা, লাল, হলুদ নানান রঙের ফুল। ঝলমলে সূর্যের আলো নতুন সবুজ পাতায় পিছলে পড়ছে।
এতদিন ধরে মানুষেরা প্রচার করে এসেছে যে তারাই সৃষ্টির সেরা জীব, আর বাকি সব প্রাণকে সৃষ্টি করা হয়েছে তাদেরই সেবার জন্য। অথচ এখন এই হেসে খেলে ওঠা প্রকৃতিকে দেখে মনেই হচ্ছেনা মানুষের সেবায় তাদের কোন মন আছে। তারা আছে নিজের আনন্দে। মানুষের এতদিনের শিখে আসা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে।
এদিকে বাকি সব জমায়েতের মত ধর্মীয় জমায়েতও বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। মানুষ এতদিন ধর্মীয় সব ধরণের জমায়েতের মধ্যে যে পবিত্রতা আরোপ করে এসেছিলো তাও ভুল প্রমাণিত হয়েছে। পবিত্র জমায়েত আর সাধারণ জমায়েতের অর্থ এখন এক হয়ে গিয়েছে। চিরজীবন প্রায় সব প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসীরা সব ধরণের উপাসনালয়ে, ধর্মীয় পবিত্রস্থানে বিশ্বাসীদের সশরীরে হাজির হওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে এসেছে, সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকে একদম হুট করে সরে আসা তাদের জন্য প্রচণ্ড কঠিন হবার কথা। হয়েছেও তাই। প্রচুর পক্ষে-বিপক্ষে বাক বিতণ্ডা, তর্ক বিতর্ক, হইচই চলছে এ নিয়ে।
অন্যদিকে হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃতের তালিকা। যেই কাঠামোবদ্ধ জীবন নিয়ে মানুষের গর্বের শেষ ছিলো না, যেসব কাঠামোকে কেউ মানতে না চাইলে ভ্রুকুটি আর লাঞ্ছনা জুটতো অনেকের কপালে সেই কাঠামোগুলোই এখন ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
এই বিচ্ছিন্নতার সময়ে মানুষ সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে ইন্টারনেটের ওপর। উন্নত দেশগুলোর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সেমিস্টারের বাকি কর্মকাণ্ড অনলাইনে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। এর মাঝে অনেকে এমন মতামতও দিচ্ছেন যে, করোনা পরবর্তী সময়েও হয়তো এই অনলাইন শিক্ষা অথবা দূরশিক্ষণ পদ্ধতি আগের চেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করবে।
সাধারণত স্প্রিং সেমিস্টারের শেষে যুক্তরাষ্ট্রসহ নানান দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তন শব্দটির ইংরেজি হল কনভোকেশন, যার অর্থই হচ্ছে একত্র হওয়া। এর মাধ্যমে ছাত্ররা মোটামুটি দীর্ঘ একটা সময় শিক্ষা জীবনের নানান নিয়মকানুন মেনে চলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করে এবং একই সাথে জীবনের একটা নতুন অধ্যায় শুরু করতে যায়। এক অধ্যায় থেকে আরেক অধ্যায়ে যাবার এই মধ্যবর্তী সময়টাকে স্মরণীয় করে রাখতেই মূলত সমাবর্তনের আয়োজন করা হয়।
এবার প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তন পিছিয়েছে। শুনেছি কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন সমাবর্তনের আয়োজন করছে। এর মধ্যে টোকিওর এক বিশ্ববিদ্যালয় তো রীতিমত তাদের ছাত্রদের জায়গায় রোবট দিয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের কাজ সেরে ফেলেছে।
গ্র্যাজুয়েটরা সবাই যার যার ঘরে বসে দূর থেকে নিজ নিজ রোবটকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রতিটি রোবটের উপরের অংশে একটি ট্যাব যুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং সেই ট্যাবে দেখা যাচ্ছে গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের মুখ। মাথায় সমাবর্তন ক্যাপ আর কালো গাউন পরা সেই রোবটগুলো সমাবর্তন হলে গিয়ে হাসিমুখে শিক্ষকদের হাত থেকে সনদপত্র গ্রহণ করেছে, শিক্ষকরা হাত তালি দিয়ে ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে আসা রোবটদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
মানুষের অনুষ্ঠানগুলোতে প্রতিষ্ঠানে উপস্থিত না হতে পেরে নিজের রোবট প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেয়ার এই বিশাল ঘটনাটি নীরবে ঘটে গেলো। এরপরে হয়তো এমন ঘটনা আরো ঘটবে। ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে মানুষ যদি যেতে না পারে তাহলে হয়তো প্রতিনিধি রোবটকে পাঠিয়ে দেবে। কারণ আমরা দেখতে পেয়েছি ধর্মীয় প্রার্থনালয় ফাঁকা পড়ে থাকার বিষয়টা মানুষকে ভীষণভাবে পীড়া দেয়।
করোনা আক্রমণের শুরুতেই যখন মক্কায় মুসলিমদের ঐতিহাসিক প্রার্থনার স্থান কাবা বন্ধ করে দেয়া হলো তখন অনেক মুসলিম প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলো। কেউ বলতে চাইলো কাবা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি, এর কিছু কিছু অংশে এখনো তওয়াফ হচ্ছে। কেউ বললো এটা কেয়ামতের আলামত। এরপর দেখা গেলো সবাই একটা ভিডিও শেয়ার দিচ্ছে যেখানে কাবার আকাশে একঝাঁক পাখি গোল হয়ে উড়ছে। ধর্মপ্রাণ মানুষেরা বলতে লাগলো, মানুষ নেই তো কি হয়েছে, পাখিরা তওয়াফ করছে। অর্থাৎ কাবায় তওয়াফ কখনো থামবে না।
এদিকে আমি যুক্তরাষ্ট্রের যেই স্টেটে থাকি সেখানে রক্ষণশীল খ্রিষ্টানদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। এই অঞ্চলের একজন গভর্নর প্রার্থনালয়ে জনসাধারণের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি নির্বাহী আদেশ দিয়েছিলেন যা স্টেটের আইন প্রণেতাদের ভোটে নাকচ হয়ে যায়। তাদের মতে, এই আদেশ মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার লঙ্ঘন করে যা স্টেটের আইনের পরিপন্থী।
একই ঘটনা ঘটেছে নিউইয়র্কের রক্ষণশীল ইহুদি পাড়াতেও। মৃতের হার হু হু করে বেড়ে যাবার পরেই কেবলমাত্র এই রক্ষণশীলদের হাতে পায়ে ধরে ধর্মীয় সভায় না যেতে রাজি করানো গেছে।
এদিকে সব ধর্মেরই সংস্কারপন্থীরা ক্রান্তিকালীন সময়ে পরিবর্তিত ব্যবস্থায় ঘরে বসেই প্রার্থনার পক্ষে কথা বলে যাচ্ছেন। সুতরাং স্পষ্ট ভাবেই রক্ষণশীল এবং সংস্কারপন্থীদের মধ্যে একটা টানাপড়েন লক্ষ্য করা যাচ্ছে চলমান ঘটনাপ্রবাহে।
প্রতিদিন কতশত হৃদয়বিদারক দৃশ্য আঁকা হচ্ছে এই পৃথিবীতে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব অনেক দৃশ্য আবার ছড়িয়ে পড়ছে, সবার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমনই একটা দৃশ্যে দেখলাম; এক চিকিৎসক তার ছোট বাচ্চাটিকে এক নজর দেখার জন্য বাসার বাইরে কাঁচের দরজার সামনে বসে আছে। ছোট্ট মেয়েটি বাবাকে দেখে বাবার কোলে ঝাঁপ দিতে উঠে পড়ার জন্য ছুটে এসেছে। তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে টেনে দরজা খোলার চেষ্টা করছে আর কাঁদছে। কিন্তু বাবার কোলে ওঠার উপায় নেই, দরজা খোলার উপায় নেই।
সাধারণ সময়ে যে সিদ্ধান্ত নিতে বছরের পর বছর তর্ক বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেতে হতো সেই সিদ্ধান্তগুলোই অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে নিয়ে ফেলা হচ্ছে। কে আরো বেশিদিন এই পৃথিবীর আলো হাওয়া খেতে পারার অধিকার রাখেন সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হচ্ছে কোনরকম বিরোধিতা ছাড়াই।
এক বিশাল সংখ্যক প্রবীণ প্রজন্মকে আমরা হয়তো হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। অনেক শিশু তাদের নানু-দাদুর কোলে বসে রূপকথার গল্প শোনার সুযোগ আর পাবেনা। আমাদের শিশুরা শিখে যাবে কেমন করে অনেক দিন পর বাবা-মাকে দেখেও ঝাঁপ দিয়ে তাদের কোলে উঠে না পড়ে দুর থেকে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয়।
আমাদের পরের প্রজন্ম শিখে যাবে কিভাবে নিজের শোবার ঘরে বসে কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের যন্ত্রচালিত আরেকটি অংশকে অফিসে পাঠিয়ে দিয়ে দিনের সব কাজ কর্ম সেরে ফেলতে হয়! অথবা, কাজের চাপে পারিবারিক অনুষ্ঠানে, শোকসভায়, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে না পারলে নিজের রোবটকে পাঠিয়ে দিয়ে দায়িত্ব সেরে ফেলতে শিখে যাবে আমাদের পরের প্রজন্ম।
পরিবর্তনের গান গাইছে পৃথিবী। যারা এই সময়টা অতিক্রম করছি তাদের উচিত হবে প্রতিটি মুহূর্তকে, প্রতিটি ঘটনাকে অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে দেখা এবং উপলব্ধি করা।
লেখক: গবেষক, রিলিজিয়াস স্টাডিজ