করোনাসংকট আর ভবিষ্যত আমলাতন্ত্রের রূপরেখা
২৫ এপ্রিল ২০২০ ২২:৩৮
মনে পড়ে, ২০০৮ সালের একটা ঘটনা। জাতিসংঘের হয়ে একটা প্রকল্পে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল তখন। বিদেশি একজন পরামর্শকও কাজ করছিলেন আমার সঙ্গে। আমরা সরকারি একটা সংস্থার উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তার সঙ্গে একটি মিটিং ঠিক করেছিলাম।
মিটিং শুরুর মিনিট পনেরো পরেই আমরা বুঝতে পারছিলাম যে হয় আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে খুব একটা ধারনা নেই অথবা এ নিয়ে কথা বলার তেমন কোনো আগ্রহ নাই তার।
আমরা আরও কিছুক্ষণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই, হাল ছেড়ে দিয়ে বের হয়ে চলে আসি। বের হওয়ার পথে একজন অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মকর্তার সাথে দেখা হয়। হাতে সময় ছিল, তার সাথে কথা বললাম, চা খেতে খেতে নানা বিষয়ে কথা চললো। একপর্যায়ে আলোচনা শুরু হল আমাদের প্রকল্প নিয়ে, কথা চললো প্রায় এক ঘণ্টা।
আমরা যে বিষয় নিয়ে কথা বলতে ঐ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে দেখা করেছিলাম, সেই বিষয়ে তরুণ অফিসারের কাছে থেকে আমরা পদ্ধতি-প্রক্রিয়া, অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি অনেক কিছু জানতে পারলাম। কথা শেষ করে বের হওয়ার সময় আমার সাথে থাকা বিদেশী পরামর্শক আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলেন “আমাকে একটা ব্যাপার বলতে পারো? কেন এই ভদ্রলোক এই চেয়ারে আর ঐ ভদ্রলোক ঐ চেয়ারে?”
বাংলাদেশ সরকার কিভাবে করোনা মহামারীকে প্রশাসনিকভাবে সামলাচ্ছে? সেটা নিয়ে চিন্তা করতে বা বিশ্লেষণ করতে গেলেই, আমার সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। আমার ধারনা সেই প্রশ্নটা মোটামুটি দেশের প্রশাসনের বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় ব্যর্থতার সারসংক্ষেপ।
আমার ধারনা আমাদের সার্বিক প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়ার দুটো নির্দিষ্ট ফোকাস আছে- নীতিনির্ধারণী ও পরিকল্পনা পর্যায়ে একটা সমন্বিত কর্মপন্থা ও কৌশল প্রণয়ন করা এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে তার বাস্তবায়ন করা। এটা এখন মোটামুটি স্পষ্ট যে, মাঠ পর্যায়ে আমাদের প্রশাসন নির্ধারিত নীতির কিছু কিছু অংশ বাস্তবায়নে বেশ সফল যেখানে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নীতি নির্ধারণ ও প্রণয়নে রয়ে গেছে ভয়াবহ ব্যর্থতা।
খুব সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অফ গভর্নেন্স ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছে। গবেষণায় সহায়তা করেছে ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ। গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল- কোভিড-১৯ এর সময়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপরে জনগণের আস্থা বা ভরসা কতোটা? এই গবেষণাটা আস্থা সম্পর্কিত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেনি বলে আমার ধারনা। কিন্তু কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। যেমন, বিভিন্ন জেলায় জনসাধারণকে লকডাউনের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো এবং তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনের প্রশংসনীয় সাফল্য। আমার কাছে মনে হয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে লকডাউন বাস্তবায়ন করতে ও মানুষকে ঘরে রাখতে। এ থেকে বোঝা যায়, স্থানীয় প্রশাসনে ও মাঠপর্যায়ের আমলাতন্ত্রে যারা আছেন তারা তাদের কাজ ঠিকঠাক করছেন, বুদ্ধিদীপ্তভাবে সমস্যার সমাধান করে জনগণের জীবনকে সহজ করে তুলছেন। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের আমলাতন্ত্রের বছরেরে পর বছর ধরে চলে আসা যে শ্রেণীবদ্ধ কাঠামো (হায়ারার্কিয়াল) ব্যবস্থা সেটাকে ভেঙ্গে ফেলার একটা চেষ্টার ইঙ্গিত তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে। সেটা কিছুটা হলেও আমলাতন্ত্রকে ধীরে ধীরে একটা সমন্বিত সুশাসনের দিকে নেয়ার প্রচেষ্টা।
গবেষণার ফলাফল দেখে খুব একটা অবাক হইনি আমি। সেই ২০১৫ থেকে আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। আমলাতন্ত্রকে আমরা বই-পুস্তকে এতদিন যেভাবে পড়ে এসেছি গত এক দশকে তা বদলে গেছে অনেকটাই। একটা কর্মচঞ্চল আর বুদ্ধিদীপ্ত নতুন প্রজন্ম ঢুকেছে আমাদের প্রশাসনে। এরা সুশিক্ষিত। তারা জানে তারা কি করছে? কেন করছে? এবং তাদের একটা বড় অংশ বাস্তবিক অর্থেই জনগণকে প্রশাসনিক সেবা প্রদানে সচেষ্ট। এক্ষেত্রে অবশ্য একটা ব্যাপার পরিষ্কার করা প্রয়োজন এবং তা হলো প্রশাসনের সব সময়ই একটা সহজাত বিচক্ষণতার শক্তি থাকে এবং এই থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। বর্তমানে করোনা সংকট এই প্রাণচঞ্চল, বুদ্ধিদীপ্ত কর্মকর্তাদের একটা বড় সুযোগ করে দিয়েছে তাদের উপর চাকরিসূত্রে অর্পিত বিশেষ সেই ক্ষমতার প্রয়োগ বা ব্যবহার করতে। এটা ভালো তবে এটাও মনে রাখা দরকার যে, আমলাদের লাগামহীন ক্ষমতা দেয়া বা তাদের তা ব্যবহার করাটা কখনোই কারো জন্য ভাল কিছু বয়ে আনেনি। আমরা জানি এরকম অর্পিত ক্ষমতার ব্যবহার আমরা একেবারে দূর করতে পারবো না তবুও অন্তত এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা থাকা দরকার।
যখন রাজনৈতিক জবাবদিহিতা বা নজরদারি ব্যবস্থাটা ভেঙে পড়ে, তখন অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলো আমলাতন্ত্রকে সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ করে দেয় ‘পুরস্কার’ বা ‘টোপ’ হিসেবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই ঘটনাটাই ঘটছে এবং অনেক সময়ই তা খুব একটা ভালো ফল দিচ্ছে না।
কোন ডিসি হয়তো সাংবাদিককে হুমকি ধামকি দিচ্ছে্ন, কোন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তার এখতিয়ারের বাইরের চলে যাচ্ছেন, আবার কোন এসি-ল্যান্ড হয়তো সেই কর্মকাণ্ড উদযাপন করছে ইত্যাদি। শেষ পর্যন্ত, এই আমলাতন্ত্রের প্যাঁচে একদিকে ভালো কর্মকর্তারা একটা খারাপ সিস্টেমের মধ্যে আটকা পড়ছে অন্যদিকে খারাপরা সিস্টেমের সীমাবদ্ধতা কাজে লাগিয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করছেন। এখানে মনে রাখা দরকার, এই ব্যর্থতার ঘটনাগুলো বা ভুলগুলোই প্রশাসনের অর্জনগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে যথেষ্ট।
একটা নিবেদিতপ্রাণ আমলাতন্ত্র থাকা তো আশীর্বাদের মতই, বিশেষত আমলাতন্ত্র যখন অন্য সংস্থার সাথে একত্রে কাজ করার, সংযুক্ত হওয়ার প্রয়োজনীয়তা জানে-বোঝে এবং সেসবের সাথে জনসংশ্লিষ্ট হয়। মাঠপর্যায়ের বাস্তবায়ন সবসময় ঠিকভাবে করতে পারে না বা পারবে না যখন কেন্দ্রীয় সরকার কৌশলগত সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় পর্যায়ের সমন্বিত কর্মকাণ্ডের তেমন কোন গুরুত্বই থাকে না যখন জাতীয় পর্যায়ে পরিকল্পনার প্রক্রিয়াটা সমন্বয়ের অভাবে ধুঁকতে থাকে।
সরকার যদি জাতীয় পর্যায়ে দক্ষ ও কুশলী বিশেষজ্ঞদের সংযুক্ত করার প্রয়োজন বোধ না করেন, মাঠপর্যায়ের উদ্ভাবনী সমাধান যেগুলো আমাদের তরুণ আমলারা বিভিন্ন নাগরিক সামাজিক সংস্থা ও দাতব্য সংস্থার সাথে একত্রে প্রয়োগ করছেন, তেমন কোন ভূমিকাই আর রাখে না।
যতদিন তারা এই নিয়মের প্যাচে আটকে থাকবেন আর তাদের কর্তাব্যক্তিরা বিশৃঙ্খল ও বিভ্রান্তিকর নির্দেশনা দিতে থাকবেন ততদিন আমাদের এই তরুণ আমলারা সফল হতে পারবেন না।
দিনশেষে, এই আমলাতন্ত্র তার সকল দ্বিচারিতা নিয়ে একটা মস্তিষ্কহীন দানবের (লেভিয়াথান) মতই আচরণ করবে, যার উদ্দেশ্য হয়ত সৎ ছিলো। ফলে ঘুরে ফিরে আমাদেরকে সেই আগের প্রশ্নে নিয়ে যায় “কেন এই ভদ্রলোক এই চেয়ারে আর ঐ ভদ্রলোক ঐ চেয়ারে?” অথবা “ঐ ভদ্রলোকগুলো” কেন তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে? প্রশ্নটা সবারই জানা, উত্তরটা জানা নেই। তবে ব্যর্থতাটা আমাদের সবার।
আমরা যারা বাংলাদেশের লোক প্রশাসন নিয়ে ভাবি, আমাদের জাতীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা যেটা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কাজ করে তা নিয়ে একটাও গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করতে পারি নাই। স্থানীয় প্রশাসন নিয়ে বেশ কিছু কাজ হয়েছে, কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে সরকার ব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা মোটামুটি উপেক্ষিত। উন্নয়ন সংস্থাগুলোও সরকারকে এ বিষয়ে তেমন কোন সহায়তা করে নাই যা দিয়ে আমাদের সার্বিক আমলাতন্ত্রকে অনুসন্ধিৎসু চোখে বিশ্লেষণ ও বোঝার চেষ্টা করা যেত। আমরা আমাদের রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রের ক্রমবিবর্তনশীল সম্পর্কটাকে স্থানীয় কিংবা জাতীয় কোন পর্যায়েই পদ্ধতিগতভাবে বিশ্লেষণ করে দেখি নাই। আমলাতন্ত্রের সামন্তবাদী প্রভুত্ব নিয়েই আমাদের এখনো যত আলোচনা, যেখানে আমরা হয়তো খুঁজে দেখতে পারতাম যে আমাদের আমলাতন্ত্রে কি দিন দিন আরও বৈচিত্র্যময় উন্নয়ন ও প্রতিনিধিত্বমূলক হচ্ছে কিনা।
আমরা এখনো যেকোনো সংস্কার প্রক্রিয়া ব্যর্থ হওয়ার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও আমলাতান্ত্রিক জটিলটাকেই দোষ দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু খুঁজে দেখছি না আমলাতন্ত্রের পক্ষ থেকে যে বাধা আসছে, সেটা কেন আসছে এবং যারা এই বাধা পার হয়ে সংস্কার আনছেন তারা সেটা কিভাবে আনছেন।
রাজনৈতিক সদিচ্ছাকেও যথাযথভাবে সংজ্ঞায়িত করিনি কখনো। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যে বিভাজন, সেটা আমরা চিন্তায় আনিনি এবং আমলাতন্ত্রের উপরে এর কি প্রভাব সেটাও খোঁজার চেষ্টা করিনি। আমলাতন্ত্রের ভেতরে যে প্রশাসনিক জবাবদিহিতার কাঠামো আছে সেটাও গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা হয়ে উঠেনি।
করোনাভাইরাস সংকট বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের ইতিহাসে একটা মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার মত সময় হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার। করোনার কারণে আমাদের সমস্যা-বিপদ সবই আমরা স্বচক্ষে দেখছি। তাইতো আমলাতন্ত্রকে আমাদের আরও একবার যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা দরকার।
লোকপ্রশাসনের ভবিষ্যতের জন্য আমার মতে নিচের প্রশ্নগুলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-
রাজনীতি-আমলাতন্ত্রের সম্পর্ক: সময়ের সাথে এই সম্পর্ক কিভাবে বিবর্তিত হচ্ছে? ২০১৮-১৯ সালের নির্বাচনের পর এই সম্পর্ক এখন কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? আমরা কি কিছু কাগুজে ‘বাঘ’ বসিয়ে রেখেছি মাথায় আর সদিচ্ছা নিয়ে কিছু তরুণ আমলা মাঠ পর্যায়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন? যদি তাই হয়, তাহলে এ থেকে উত্তরণের উপায়টা কী?
আন্তপ্রজন্ম পার্থক্য: জেন এক্স আর জেন ওয়াইরা এখন সিভিল সার্ভিসে ঢুকছেন। আমলাতন্ত্রের সাংগঠনিক কাঠামোকে তারা কিভাবে পাল্টে দিচ্ছেন? দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ আমলারা তাতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন? আমাদের সিভিল সার্ভিসের কাঠামোতে এর ভূমিকা কি?
জবাবদিহিতা: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে জবাবদিহিতা বলতে কি বোঝায়? ‘রুড একাউন্টেবিলিটি’র মত কনসেপ্টগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেমন কাজ করতে পারে? অপ্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা কতটা গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় পর্যায়ে? রাজনৈতিক জবাবদিহিতা কি আমাদের পেশাদারী জবাবদিহিতাকে প্রভাবিত করছে? কতটুকু করছে?
আমলাতন্ত্রকে পরিচালনা: আন্তঃসংস্থা সম্পর্ক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমাদের আমলাতন্ত্র কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? আমরা তা কিভাবে চিহ্নিত করতে পারি? এইখানে অংশীদারি কারা? তারা কিভাবে কাজ করছে? বিপত্তিগুলো কি কি? এই সঙ্ঘবদ্ধ ব্যবস্থায় জবাবদিহিতা দিয়ে কি বোঝায়?
কর্মদক্ষতা ব্যবস্থাপনা: বার্ষিক কর্মদক্ষতার মূল্যায়নের যে প্রক্রিয়া সেটা কতটা কার্যকর?
ভবিষ্যতের আমলাতন্ত্রের রূপরেখা তৈরি করতে উপরের এই বিষয়গুলো আমার কাছে মনে হয়েছ আরও গভীরভাবে আলোচনা করা দরকার।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ভাষান্তর: ফয়সাল আদনান