Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাপরবর্তী ভাবনা; প্রকৃতির স্থিতি আর আমাদের অস্থিরতা


৪ মে ২০২০ ১৬:২৫

শেষ কবে দেখেছো ঘন নীল আকাশ, শুভ্র মেঘছেঁড়া পড়ন্ত বিকেলের রঙিন ছটা, কিংবা নক্ষত্রে ভরা রাত? সমস্বরে হয়ত বলে উঠবে তোমরা, “এইতো কালই?” যেন এমনই ছিল আমাদের পৃথিবী, যেন বিশ্বপ্রকৃতি তার পূর্ণ গরিমায় সহসাই দেখা দিতেন, সর্বদা! তাই কি? আকাশের অমলতা, নদীর জলের স্বচ্ছতা, বনানীর ঐশ্বর্য, কদিন আগেও ছিল মলিন, অস্বচ্ছ, আর দরিদ্র। প্রকৃতির রস নিংড়ে শ্বাসরোধ করে দিয়েছিলাম আমরা। মানবজাতির উন্নয়ন-যন্ত্রের বিরামহীন ধাবিত হওয়া আজ প্রকৃতির প্রতিপক্ষ করে দাঁড় করিয়েছে আমাদের। ১৪টি সহস্রাব্দের পুরনো মিত্র, নিসর্গের সহচর, এই আমরা আজ তার হিংস্র অমিত্র।

বিজ্ঞাপন

ভেবে দেখো তো! মাস দুয়েকও ফুরোয়নি বোধ হয়! এ যেন যুদ্ধকালীন অনিশ্চয়তা, অমঙ্গলচিন্তা, আর এক অস্বাভাবিক অসহনীয় সঙ্গরোধের ভেতর দিয়ে চলেছি আমরা। শ্বাসনিরোধী একটা সময়। বন্ধুর সাথে বন্ধুর দেখা নেই, সহকর্মীর সাথে চায়ের কাপে আলোচনা বন্ধ, ক্লাসরুমে ছাত্রদের তারুণ্যেভরা উচ্ছলতা যেন দূর-অতীতের কোন সুসময় মনে হয় আজ। সব স্থবির এখন। কবে শেষ হবে এ বন্দী জীবন? কবে ছুটে বেরিয়ে যাবো, প্রিয় বন্ধুর আলিঙ্গনে আবিষ্ট হব, প্রিয় শহর, প্রিয় পথ, প্রিয় যাপিত জীবনকে আগের মতো করে ফিরে পাবো! এ আকুতি আজ আমাদের সবার।

বিজ্ঞাপন

কখনো কি ভেবে দেখেছি, এ দুর্যোগের গোঁড়ার কারণটি কি হতে পারে? যদি বলি বৈশ্বিক উষ্ণতাই এর কারণ? হেসে উঠবে তোমাদের অনেকেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকামী অনেকেই, পরিবেশবাদীদের অশেষ ফাঁকি বলে অগ্ৰাহ্য করবে। অথচ আজকের এ মানব বিধেয়-এর জন্যে দায়ী অণুজীব, করোনাভাইরাস, বন্য বাদুড় থেকে ছড়িয়েছে মধ্যবর্তী প্রাণীতে। যেমনটি ২০১২ সালের MERS আর ২০০২ সালের SARS এর জীবাণু বাদুড় থেকে ছড়িয়েছিলো উট আর সিভিট বিড়ালে এবং তাদের সংস্পর্শে এসে মানুষেও। প্রশ্ন হচ্ছে, এ প্রজাতিগত স্থানান্তর, আজ ঘটছে কেন? এ প্রবণতা কি সাময়িক, না এর পুনরাবৃত্তি হবে সহসাই? আর কি রূপে এমন মহামারীর সূচনা হতে পারে? কি করে তৈরি হবে মানবজাতি এই অদৃশ্য অমিত্রকে রুখে দিতে? এ প্রশ্নগুলো জরুরি এবং প্রাসঙ্গিক।

২০১২ এবং ২০০২ সালের দুটো মহামারীই হয়েছে করোনা ভাইরাস থেকে। MERS আর SARS এর প্রকোপ বিশ্বব্যাপী এতটা দানা বাঁধেনি তখন, অণুজীবটির সংক্রমণের হার কিছুটা কম থাকবার কারণে। তবে কেন গত দুই দশকে এই অণুজীব বেশি সংক্রমিত হচ্ছে তা ভাববার বিষয়। গত তিন দশক ধরেই বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাবার ফল সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। বনানীতে দাবানল, হিমবাহের ক্রমশ: নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, ভূপৃষ্ঠের উষ্ণতা বৃদ্ধি, এ সবই প্রতিভাত হয়েছে এ সময়কালে। অনেক প্রাণীর মতোই বন্য বাদুড়ের বাস রেনফরেস্ট-এর সর্বোচ্চ ক্যানোপিতে। তারা তাদের এ আবাস্থলে খুঁজে পাওয়া ফলমূল খেয়ে জীবন ধারণ করে। যদি বন নিধন আর বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বাদুড়েরা ঘর ছাড়া হয়, তারা যাবে কোথায়? স্বাভাবিকভাবেই, অন্য বন্য জন্তুদের আবাসস্থলে আশ্রয় নেবে তারা। এমনকি, শহরতলীর গৃহপালিত পশুকুলের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়াও যেন নিয়মিত এখন। এহেন অযাচিত মিথস্ক্রিয়াই ছড়িয়ে দিচ্ছে করোনা ভাইরাসের মতো সংক্রামক অণুজীব, বৃহত্তর প্রাণিকূলে, এবং তারপর মানবকূলে।

বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের সময়কালীন বিউবনিক প্লেগ, ১৯১৮-এর মহামারী, কিংবা ২০১৯-এর কোভিড-১৯, মানবকুলের ঘুম ভাঙেনি কখনও। zoonotic virus অর্থাৎ, প্রাণী থেকে প্রাপ্ত জীবানুর সংক্রমণ ২০১৯-২০২০-এর করোনা ভাইরাসের মধ্য দিয়ে থেমে যাবে এমনটি ভাববার অবকাশ নেই। ব্রাজিল অথবা ভেনিজুয়েলাতে বনানী উজাড় হয়ে যাওয়া থেমে যাবে বলে মনে হয় না। ক্যালিফোর্নিয়ার স্প্রুস কিংবা অস্ট্রেলিয়ার ইউক্যালিপটাস গাছের বনে দাবানল ছড়ানোকে প্রতিহত করবে কে? হিমবাহ নিশ্চিহ্ন হয়ে হাওয়া কি কেবল সম্ভাব্য প্লাবনের আশঙ্কাতেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে, না আদিম সমাধিস্থ অচেনা অণুজীব জলপ্রবাহে মিশে যাবে, জলপ্রবাহের সাথে পৌঁছে যাবে মানুষের আবাসস্থলের খুব নিকটে? কোরাল সাগরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সাথে সাথে। ক্ষতিগ্রস্থ হবে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য। বন্য কিংবা গভীর সমুদ্রের প্রাণীকূলের জন্যে আমাদের ভাবনা না থাকাটি অস্বাভাবিক নয়। তবে প্রাণীকুলের বাসস্থান ছেড়ে যাবার চুড়ান্ত ফলাফল যে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা ডেকে নিয়ে আসবে, হরণ করবে আড়াই লক্ষ প্রাণ, এই সত্য, অপ্রত্যাশিত হলেও আজ স্বীকার করতেই হবে।

মানব সভ্যতাকে আমরা যেভাবে জানি, তার পরিসমাপ্তি ঠেকাতে গেলে মানুষ এবং বিশ্বপ্রকৃতির সহাবস্থান একান্তই আবশ্যক। প্রাণিকুল সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে এই মহাপ্রলয় থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার মানবজাতিকে কিছুটা প্রস্তুত করলেও, আমাদের একান্ত মনোযোগ যদি মনুষ্যকুলের প্রতি নিবিষ্ট থাকে, এর ভবিষ্যৎ ফল শুভ হবে না।

সুস্থ প্রকৃতি আমাদের অস্থির করে তোলেনি; বরং মানবসৃষ্ট সঙ্কট আজ এই দুঃসহ দুর্যোগের সূচনা করেছে। আমাদের বন্দিদশায় প্রকৃতিতে স্থিতি এসেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের গতি হয়েছে শ্লথ। ফুল আর পাখিদের বসন্ত আজ, মাছেদের মহোৎসব। আগামী মাস কিংবা বছর, যখনই আমরা “স্বাভাবিক” জীবনে ফিরে যেতে পারিনা কেন, এক পুনর্জীবিত বিশ্বপ্রকৃতির মুখোমুখি হবো আমরা। আমাদের কালকের কর্ম নির্ধারণ করবে মানবকুলের ভবিষ্যত অবস্থান। নূতন পৃথিবীতে পা দেবার আগে একটিবার যেন এই কাঙ্খিত সহাবসস্থানকে বিবেচনায় আনি আমরা।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক- সিভিল, আর্কিটেকচারাল, এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এট অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র

করোনা করোনাভাইরাস

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর