Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আপোষ না সংগ্রাম?


৪ মার্চ ২০১৮ ২০:০৭

২০১৩ সালের সেই গণজোয়ার আমাদেরকে আবার নতুন বাংলাদেশকে দেখতে শিখিয়েছিল। চিনতে ও ভাবতে শিখিয়েছিল কে আপন আর কে পর। ৩০ লক্ষ শহীদের স্বপ্নের বাংলাদেশে এখনও কারা “মুক্তিযুদ্ধ” শব্দটিকে মেনে নিতে পারছে না চিনতে শিখিয়েছিলো তাদেরকেও। সেই চেনা থেকেই আজও চিনছি, জানছি এক অচেনা বাংলাদেশকে।

১৯৭৫ থেকে ২০১৩ সময়টাকে যদি একটি ধারাবাহিকতায় আনা যায় তাহলে বোঝা যাবে কতটা পাল্টেছে ৪৭ থেকে ৭১ এর বাংলাদেশ। এই পালটানো কেবল অর্থনীতিতে নয়। এ পরিবর্তন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক। পরিবর্তনের ধাক্কায় আক্রান্ত হয়েছে রাষ্ট্রীয় বিবেক, পরিবর্তন এসেছে ব্যক্তির চিন্তা ও চেতনায়। এই লম্বা সময়ে সংখ্যাগত পরিবর্তনের পাশাপাশি ঘটে গিয়েছে গুণগত এক পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তন এসেছে রাষ্ট্রের আশ্রয় প্রশ্রয়ে। এই পরিবর্তন এসেছে কাঠামোগতভাবে। পরিকল্পিতভাবে ও কৌশলে চলেছে এই কর্মটি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াটি মূলত কাজ করেছে ভীমরুলের চাকে ঢিল ছোঁড়ার মত অস্ত্র হিসেবে। সেই অস্ত্রে ঘায়েল হয়ে জমাট বেঁধে থাকা বিষাক্ত ভীমরুলেরা ঝাঁকে ঝাঁকে বেড়িয়ে এসেছে খোলস ছেড়ে। সেই থেকে শুরু সরাসরি আক্রমণের। নানা চেহারায় এসেছে ওরা।

বিজ্ঞাপন

সারাবিশ্বজুড়েই এখন উগ্রবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, সন্ত্রাস, নাস্তিকতা, আস্তিকতার লড়াই চলছে। কিন্তু কতজন জানে এসব শব্দের সঠিক অর্থ? পাশের দেশ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নতুন করে উত্থান ঘটেছে হিন্দুত্ববাদের ঝান্ডার। হুমকীর মুখে প্রগতিশীল ধারা। কিন্তু কেন?

চলছে নানামুখী বিতর্ক। এই পরিবর্তন কী কেবল দর্শনগত পরিবর্তন? বেশীরভাগ মানুষ কী সত্যি উগ্রবাদী দর্শনকেই ভালোবাসে? যদি তাই হবে, তবে কেন তারা জাতীয়তাবাদকেও ধারণ করতে চায়? দেশপ্রেমের প্রশ্নে কেন তারা আগে নিজের দেশকেই বেছে নেয়?

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে বর্তমানে যে মৌলবাদের উত্থান এটাও কী ভারতের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থানের মত? আমার মনে হয় না। দুটোর মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য আছে। আর সেটি হচ্ছে ১৯৭১। ১৯৭১ আমাদের দেশকে দিয়েছে একটি স্বতন্ত্র মানচিত্র, দিয়েছে একটি আলাদা সংবিধান, আলাদা পরিচয়। আমাদের সবার পরিচয় আমরা বাংলাদেশী, আমরা বাঙালি। এর বাইরে আমাদের আর কোন জাতীয়তাবাদ নাই।

যারা এই পরিচয়কে মানতে পারছে না তারাই আঘাত করছে বারেবারে। যারা মানতে পারছেনা ১৯৭১ কেন এসেছিল। যারা মানতে পারছে না ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মত একটি নিরস্ত্র মানুষের দেশ একটি সশস্র পাকিস্তানি বাহিনীকে হারিয়ে দিয়েছিল আর পাকিস্তানি বাহিনী লজ্জায় মাথা নত করে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিল তারাই ফুঁসে ফুঁসে ওঠে সুযোগ পেলেই।

বাংলাদেশ কখনই মুসলমানের একার দেশ ছিল না। এ দেশের ১৬ কোটি জনতার একটাই পরিচয়। আর সে পরিচয় তারা বাংলাদেশী, তারা সকলে বাঙালি। এই চেতনা থেকে যখনই রাষ্ট্র সরতে শুরু করেছে ঠিক তখন থেকেই ধ্বস নামতে শুরু করেছে। সংবিধানের কাটাছেড়া সে কাজটিকে সাহায্য করেছে। আস্তিক, নাস্তিকের পরিচয় কী? কাদের আস্তিক বলা হয় আর কাদেরই বা নাস্তিক বলা হয়? এ তর্কইবা কেন? কারা তুলেছিল এই তর্ক? খুব খেয়াল করে বুঝতে হবে। এই দেশে মুক্ত প্রগতিশীল মানুষের সংখ্যা কখনই কম ছিল না। দেশ ও সমাজ নিয়ে প্রগতির কথা বলতেন এমন মানুষের সংখ্যা সবসময় ছিল বেশী। তাঁদের একটা আলাদা সম্মান ছিল, সমাজের মানুষ তাঁদের কথা শুনতেন, মানতেন এবং পালন করে চলতেন।

বাঁধা ছিল, অমান্যও ছিল। প্রতিক্রিয়া ছিল, প্রতিরোধও ছিল। কিন্তু সেটা ছিল আদর্শিক প্রতিরোধ। শারীরিক আঘাতের রাস্তা কখনোই খোলা ছিল না। ইচ্ছে থাকলেও অতটা সাহস তারা পায়নি কখনোই।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানিরা যে বুদ্ধীহীন জাতি করতে চেয়েছিলো আমাদেরকে সে একই রাস্তায় হাঁটছে আজকের বাংলাদেশ। ক্ষয়ের শুরু ১৯৭৫ থেকেই। এই ক্ষয়ের দায় রাষ্ট্রকেই নিতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারাই এসেছে তারাই প্রতিষ্ঠিত করেছে চাইলেই যে কাউকেই সরিয়ে দেয়া যায়। এই হত্যাযজ্ঞের জন্ম দিয়েছে সেনাবাহিনী থেকে আসা রাষ্ট্রপতিগণ। সেই থেকেই শুরু মুক্তবুদ্ধিকে দমন করার প্রক্রিয়া। সেই থেকেই শুরু দেশকে পিছিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির। তাদের পরিচালিত নীতিতেই দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির শুরু। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে হত্যাকে জায়েজ করার নীতি শুরু করা হয়েছে।
এসবই সবার জানা। বর্তমানে ক্ষমতাসীন সরকারের গত এবং এই শাসনামলে আমরা হয়ত সেই দায় থেকে কিছুটা মুক্তি পেয়েছি কিন্তু উগ্রবাদের উত্থানকে ঠেকাতে পারিনি। ৪২ বছরের অপসংস্কৃতি আমাদের মেরুদন্ডকে ক্ষয়ে দিয়ে গেছে। মগজে ঢুকিয়েছে ধর্মান্ধতার বিষ। সাংস্কৃতিকভাবে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে মৌলবাদের বীজ।

ওদের একমাত্র শত্রু মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিবুদ্ধি আর প্রগতিশীল চিন্তার বিকাশ। যে চিন্তা সমাজে ঢেউ তৈরী করে, ধাক্কা দেয় বদ্ধ ও পচা চিন্তার শক্তিকে। মানুষকে ভাবতে শেখায় ইহজাগতিক বিষয়ে। ওদের এই ভয় আগেও ছিল, এখনও আছে। ৭১ সালে চেষ্টা করেছিল ধর্মের দোহাই দিয়ে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে। কিন্তু পারেনি। পারেনি কারণ, তখন মানুষ বুঝেছিল পাকিস্তান আমাদের শত্রু। এরা আমাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈক ও সাংস্কৃতিক অধিকারকে ক্ষুন্ন করছে। কিন্তু আজ তো আর পাকিস্তান নেই।

আজকে আছে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র যেখানে মৌলিক অধিকার হরণের পিছনে নেই কোন বাইরের শক্তি। তাই বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে দিতে দরকার অভ্যন্তরীন কৌশল। বাংলাদেশীদের এখন চাহিদা আর স্বাধীনতা বা স্বার্বভৌমত্ব না। সেই চিন্তা থেকে মুক্ত সাধারণ জনগণ এখন শান্তি খুঁজে পায় পারলৌকিক রাস্তায়। এই দূর্বলতাকেই সুযোগ হিসাবে নিয়েছে ৭১ এর পরাজিত শক্তি। তারুণ্যকে বিভ্রান্ত করতে পারলে কেল্লাফতে। তাই এই তারুণ্যকে প্রভাবিত করতে পারে এমন মানুষকে সামনে রাখা যাবে না। হটিয়ে দাও এদেরকে। যে ব্যক্তি বা যার কথা সমাজে সুচিন্তার সূত্র তৈরীতে সাহায্য করবে তাকেই সরাতে হবে। সরানোর কায়দা কী? কায়দা হচ্ছে ধর্মীয় আবেগ ধরে এগিয়ে যাওয়া। সরাসরি কৌশলে যখন পারছিল না তখনই সামনে নিয়ে এলো আস্তিক, নাস্তিক অস্ত্রটিকে।

আমাদের রাষ্ট্র নিজে কী এই হিসাবে আক্রান্ত নয়? সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপোষে আর যাই হোক, একটি মুক্তচিন্তার দেশ গড়া যায় না। ওরা এই খেলা শুরু করেছে ২০১৩ সালে। একই খেলা এখনও চলছে। একে একে মুক্তচিন্তকদের হত্যা করে চলেছে। আমরা চুপ করে দেখছি আর গলা ছেড়ে বলছি বাংলাদেশে কোন মৌলবাদের ঠাঁই নেই। আসলেই কী নেই? যদি না থাকে তবে সরকারকে প্রমাণ করতে হবে এই রাষ্ট্র সকলের, এই রাষ্ট্র বন্ধাত্ব চায় না। এই রাষ্ট্র ধর্মের নামে মানুষ হত্যাকে অধর্ম মনে করে। ইসলামকে রক্ষা করতে হলে আগে মানুষের অধিকার রক্ষা করতে হবে। ইসলাম তর্ক করতে শিখায় কিন্তু ভিন্নমতের মানুষকে জবাই করতে শিখায় না।

৯০ ভাগ মুসলমানের দেশ বলে যারা ইসলামের ঢাল নিয়ে মাঠে মানুষ মারার মিশনে নেমেছে আপামর জনতাকে সাথে নিয়ে এ কিলিং মিশনকে ঠেকাতে হবে। খুনীদের কোন জাত নেই, ধর্ম নেই, দেশ নেই। খুনীদের একটাই পরিচয় তারা অপরাধী। অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের ধর্ম। তাই সরকারে যারা আছেন বা আসবেন তাদের আগে নির্ধারণ করতে হবে আপনি কী দেশের বেশীরভাগ মানুষকে সুরক্ষার দায়িত্বে আছেন না মুষ্টিমেয় কিছু স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশী করার লক্ষে আছেন?

জাফর ইকবালের উপর আক্রমন কেবল একজন জাফর ইকবালকে টার্গেট করে নয়। এ টার্গেট বাংলাদেশকে পাকিস্তানে রূপান্তরিত করার টার্গেট। সরকারের মাঝে যারা আপোষের রাস্তায় এর সমাধান চাইছেন তারা হয় ৪৭ থেকে ৭১ এর ইতিহাসকে অস্বীকার করতে চাইছেন না হয় না জেনে রাষ্ট্রের ধ্বংস করছেন। বাংলাদেশের পিছনের ইতিহাস কখনও আপোষের নয়। আপোষ করলে আজকে শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হতে পারতেন না। আজকে তিনি জাতির পিতার আসনে থাকতেন না। এখনও সময় আছে আপোষের রাস্তা ছেড়ে প্রতিরোধের রাস্তায় আসুন। দেশের বেশীরভাগ জনতা হত্যার রাজনীতি চায় না, মৌলবাদের বন্ধাত্ব চায় না। তারা শেষবিচারে একটি মুক্তবুদ্ধির বাংলাদেশকে চায়। ১৯৭১ এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কিছু হতে পারেনা। দেশের মানুষকে সাথে নিয়ে রুখে দিন এই হায়নাদের। দেশটিকে আর রক্তাক্ত দেখতে চাইনা আমরা।

[এই কলামে উপস্থাপিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব

সারাবাংলা/আরএফ 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর