Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনৈতিক সমর্থন থাকলে উগ্রবাদ দমানো সহজ নয়


৪ মার্চ ২০১৮ ২৩:১৭

রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হলে, গণতান্ত্রিক পথে চলতে চাইলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করবে এটাই সহজ কথা। কিন্তু আমাদের চলার পথ যে কঠিন হয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে পারি যখন আমরা দেখি রাষ্ট্র সে পথে নেই। সে পাঠ্যপুস্তক বদলে ফেলে সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর চাপে, সে তাদের কথায় ভাস্কর্য সরিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে উল্টো আঘাতের পথ বেছে নেয়।

যা কিছু প্রতিক্রিয়াশীল তাই  ফ্যাসিবাদ। উদার ধর্মনিরপেক্ষ শাসনব্যবস্থা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চাওয়া ছিল। কিন্তু সেখান থেকে আমরা এখন অনেক দূরে। আমরা দূরে গেছি বলেই এরা কাছে এসে আক্রমণ করে, হত্যা করে, হত্যার চেষ্টা চালায়। ধ্বংস-কিনারা থেকে জনগণই বাংলাদেশকে বারবার ফিরিয়ে এনেছে। হয়তো আবারও জনগণই বাংলাদেশকে ফিরিয়ে আনবে, কিন্তু রাজনীতি সত্যি জনগণের পথে থাকবে কিনা সে এক বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন এ কারণে যে, সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সন্ত্রাসী শক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না, এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নির্দ্বিধায় সব দলকে মানতে হবে– এমন একটি জায়গায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য নেই।

বিজ্ঞাপন

এমন একটি গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান খোঁজাই শ্রেয় কাজ অন্যসব বিতর্কের চেয়ে। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা প্রায়ই বলেন,  ‘বাংলাদেশে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের স্থান হবে না। ধর্মের নামে কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা বরদাশত করা হবে না।’  এসব আশ্বাস আমাদের কখনো কখনো আশাবাদী করে ঠিকই, কিন্তু পুরো আশ্বস্ত করে না। গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার পর পুলিশ ও র‌্যাবের জঙ্গি খতমের বেশ কিছু সফল অভিযান আমাদের আশ্বস্ত হওয়ার যে জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল, বলতেই হবে শনিবার সিলেটে অধ্যাপক জাফর ইকবালের হত্যাচেষ্টা আবার আমাদের শংকায় ফেলেছে।

বিজ্ঞাপন

সমস্যাটি রাজনৈতিক। এ কারণে প্রায় প্রতিটি জঙ্গ খতমের অভিযানের পর জঙ্গিদের কেন মেরে ফেলা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিএনপি নেতারা। অথচ তারা ভাল করেই জানেন কেন মেরে ফেলতে হয়। কারণ জঙ্গিরা মরতেই আসে, কোনোভাবেই আত্মসমর্পণ করে না। জাফর ইকবালকে হত্যা করতে আসা জঙ্গিকে আটক করেছে জনতা। আশা করছি তার পেছনের হুকুমদাতা ও এর পেছনের রাজনীতি উন্মোচিত হবে যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে।

সন্ত্রাস আর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান চায় মানুষ। কোনো ছাড় চায় না। কিন্তু বিষয়টি শুধুমাত্র পুলিশি বা প্রশাসনিক পদক্ষেপে নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু দিয়ে এগুতে হবে। সাধারণ মানুষ তার ঐক্য গড়ে নিয়েছে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন সময় রাজনৈতিক শক্তির, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের। সমস্যাটা যেহেতু রাজনৈতিক, তাই রাজনৈতিকভাবে কর্মসূচি এখন প্রয়োজন। এ কথা সত্য যে উগ্রবাদের প্রতি বিরোধী অবস্থানে থাকা দেশের বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থন থাকলে তা দমানো সহজ কাজ নয়।

মৌলবাদী শক্তি মোকাবিলা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় এখন। কিন্তু মনে হচ্ছিল একটা সময় সরকার বড় দ্বিধায় ছিল কী করতে হবে তা নিয়ে। একের পর পর লেখক ব্লগার খুন, পুরোহিত খুন, খ্রীষ্টান যাজক খুনের চেষ্টা, বিদেশি খুন, শিয়া ও আহমদিয়াদের উপর আক্রমণ যখন হচ্ছিল তখন সরকারকে অনেক বিব্রত ও বিচলিত দেখা গেছে।

সরকারের এই অবস্থান মানুষকেও একটা সংশয়ে ফেলেছিল যে, এটাই বুঝি বাংলাদেশের নিয়তি। হলি আর্টিজানের হামলা মানুষকে যেমন সন্ত্রাস আর জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছে, তেমনি সরকারকেও অনেক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

এই টার্গেট কিংলিং শুরু হয়েছে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিতে গড়ে উঠা গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করতে গিয়ে। যারা আস্তিক-নাস্তিক বিতর্ককে সামনে এনেছে তারাই হত্যা করছে, হত্যার সমর্থন দিচ্ছে, তারাই হেফাজতকে ঢাকায় এনেছিল, তারাই তাদের ডাকে সাড়া দিতে ঢাকাবাসীকে আহ্বান জানিয়েছিল। এবং তারাই জঙ্গি খতমে বিরোধিতা করছে নানা ছলচাতুরীতে।

কঠিন রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সাফল্য লাভের সম্ভাবনা নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্ভব হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি কার্যকর করা গেছে, এর পেছনে সরকার, বিশেষ করে তার শীর্ষ পর্যায়ে দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার কাজ করেছে বলেই।

জঙ্গিবাদ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে বড় বিষয়। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক কাম্য নয়। যেকোনো দেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এটা বড় সংকট। বাংলাদেশে জঙ্গিরা বিচ্ছিন্নভাবে কিছু পকেটে তৎপরতা চালালেও বৃহত্তর সমাজে শিকড় গাঁড়তে পারেনি। এর অন্যতম কারণ, এখানকার মানুষের সহিষ্ণু মনোভাব ও নারীর ক্ষমতায়ন।

আয়তনে বাংলাদেশ ছোট হলেও এর রয়েছে বিশাল জনগোষ্ঠী। এত বড় সমাজে কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে জঙ্গি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এর জন্য রাজনৈতিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। এমন বাস্তবতায় জঙ্গিবাদ নিয়ে সরকার তথা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্পষ্ট অবস্থান খুব জরুরি ছিল যা আমরা পুলিশের তৎপরতায় দেখতে পাই।

জঙ্গিদের পুলিশি চাপে রাখতেই হবে, তার কোনো বিকল্প নেই। তবে আবারও বলতে হচ্ছে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মাধ্যমে জঙ্গিবাদ নিরসন সম্ভব নয়। সামাজিকভাবে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা বাড়াতে হবে। এসব খুনিরা সংগঠিত আবার কোনো কোনো তরুণ জঙ্গি মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে ‘নেতৃত্বহীর’ জিহাদ শুরু করেছে।

দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক জাগরণের যে ডাক এসেছে তাকে এগিয়ে নিতে হবে। হলি আর্টিজানের হামলার পর সাংস্কৃতিক আঙ্গনে যে সাড়া পড়েছিল তা ঝিমিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। চুপ করে গেলে হবে না, কারণ তারা চুপ করে নেই। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কোন কিছুই বাদ দিচ্ছে না, সর্বত্রই বিচরণ করছে।

[এই কলামে উপস্থাপিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব]

 

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর