Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আওয়ামী লীগ: স্বাধীনতার এক স্বপ্ন সারথীর পথচলা


২৩ জুন ২০২০ ০৮:৩৫

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। একজন মানুষ। একজন অসীম সাহসী, প্রজ্ঞাবান রাজনীতিবিদ, রাজনীতির কবি (Poet of Politics)। শরীরে টুঙ্গিপাড়ার পলিমাটির প্রলেপ মেখে বড় হওয়া একজন ‘খোকা’ অনন্য-অসাধারণ ও চিরস্মরণীয় এক বিশেষ অবদানের জন্য। পদে পদে জীবন বিপন্ন করে, স্রোতের বিপরীতে নৌকা চালিয়ে, সমঝোতার সিংহাসনকে পাশ কাটিয়ে একটি জাতিকে তিনি স্বাধীন করার সাহস দেখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত সাফল্যের সাথে ছিনিয়ে এনেছিলেন স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। এটাই একজন শেখ মুজিবুর রহমানের অবিস্মরণীয় অর্জন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যে দেশ গণতান্ত্রিক রীতি মেনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর অনেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতা পূর্ব বাংলার রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি, আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, অলি আহাদ, মোজাফফর আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা আর অন্য বলয়ের ফজলুল কাদের চৌধুরি, নুরুল আমিন, বগুড়ার মোহাম্মদ আলী আরও কত শত প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ। কিন্তু তারা কেউই সেই সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে পারেননি। দিতে পারেননি মুক্তির দিশা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, সেই সূর্যকে নতুন করে পূর্ব দিগন্তে নব মহিমায় উদীত করার স্বপ্ন দেখাতে পারেননি কেউই। আর এখানেই ব্যতিক্রম একজন শেখ মুজিব। উল্লেখ করা যেতে পারে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দিও একটি স্বাধীন দেশের কথা কখনও ভাবেননি। ১৯৫৬ সালের সেপ্টম্বরে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁকে একজন সংবাদিক পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে সোহরাওয়ার্দি বলেছিলেন, তাঁর (সোহরাওয়ার্দি) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অর্ধেক পূরণ হয়ে গেছে (আহমদ: ২০১৬)। এই জায়গাইে একজন মানুষ শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অনন্য। অসীম সাহসী ও দূরদৃষ্টি সম্পন্ন শেখ মুজিব অবিচল ছিলেন মানুষের অধিকার আদায় তথা স্বাধীনতা অর্জনের আন্দোলনে। নিজের ব্যক্তিগত কোন অর্জনের মধ্যে তিনি বাঙালি জাতির প্রাপ্তি দেখেননি বরং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অর্জন ও অগ্রগতিতে দেখেছেন নিজের সফলতা ও রাজনীতির সার্থকতা। যেখানে অন্যান্য নেতারা ছিলেন পলায়নপর ও সমঝোতাবাদী।

বিজ্ঞাপন

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ একটি অত্যন্ত ফলাফল নির্ধারণী ঘটনা। যার প্রভাব এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে এখনও স্পষ্ট। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ শেখ মুজিবুর রহমানকেও ভাবিয়েছিল। অস্বাভাবিক, কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাঙালির অধিকার আদায় ও অর্থনৈতিক মুক্তি নিয়ে শুরু থেকেই তাঁর সংশয় ছিল। উল্লেখ্য ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় ফেরেন শেখ মুজিব। শুরু হয় নতুন পথ চলা। ঐ সময় থেকেই তিনি নতুন কিছু করার, নতুন করে কিছু করার চিন্তা করছিলেন। দেশের মানুষ ও ভবিষ্যত নিয়ে তাঁর ভাবনা চিন্তার আমূল পরিবর্তন আসে ১৯৫২ সালে চীন সফরের পর। ১৯৫২ সালের ১৫-১৬ সেপ্টম্বর শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে পিকিং সফর করেছিলেন শেখ মুজিব। ঐ সফরে সাংহাই, নানকিং ও হ্যাংচোসহ বেশ কয়েকটি চীনা শহর দেখার সুযোগ হয়েছিল শেখ মুজিবের। মাও-সে-তুং এর নয়া চীনের অর্থনৈতিক সংস্কার ও অগ্রগতি শেখ মুজিবকে বিস্মিত করে। সাথে নয়া পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতি অবহেলা আর অবজ্ঞা নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে শেখ মুজিবুর রহমানকে। যার প্রতিফলন পাওয়া যায় ‘অসমান্ত আত্মজীবনী’(২০১২)’তে। শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন,

‘আমরা স্বাধীন হয়েছি ১৯৪৭ সালে আর চীন স্বাধীন হয়েছে ১৯৪৯ সালে। যে মনোভাব পাকিস্তানের জনগণের ছিল, স্বাধীনতা পাওয়ার সাথে সাথে আজ যেন তা ঝিমিয়ে গেছে। সরকার তা ব্যবহার না করে তাকে চেপে মারার চেষ্টা করেছে। আর চীনের সরকার জনগণকে ব্যবহার করেছে তাদের দেশের উন্নয়নমূলক কাজে। তাদের সাথে পার্থক্য হল, তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ এবং এদেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন। ফলে দেশের জনগণের মধ্যে ও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে হাতাশা দেখা দিয়েছে। একমাত্র পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। সাদা চামড়ার জায়াগয় কালা চামড়ার আমদানি হয়েছে’ (রহমান,২০১২: ২৩৪)।

শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুতই বুঝতে পারেন স্বাধীনতার নামে পাঞ্জাবি আমলাতন্ত্র বাঙালিদের উপর চেপে বসেছে। শুরু হয়েছে লুটপাট আর শোষণের আরেক অধ্যায়। শুরু থেকেই এই শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ভাষার প্রশ্নে যে আন্দোলন শুরু হয় সেই আন্দোলনে শেখ মুজিব ছিলেন সামনের কাতারে। ৫২’তে তীব্র আন্দোলন ও ছাত্রদের উপর গুলি চললে কারাগারের ভেতর থেকেই এর প্রতিবাদ করেন। ভাষা আন্দোলনের দুই বছরের মধ্যে ১৯৫৪ সালের ৮ই মার্চ অনুষ্ঠিত হয় যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন। আবেগ আর অর্থনৈতিক অধিকারের ২১ দফা ভিত্তিক ঐ নির্বাচন মুসলিম লীগকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলে (৩০০ আসনের মধ্যে মুসলিম লীগের আসন মাত্র ৯ টি)। তবে নির্বাচনে জয়লাভের পর ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করার আগে থেকেই শুরু হয় নতুন ষড়যন্ত্র। মন্ত্রিসভার শপথের দিনই আদমজী জুট মিলে বাঙালি-বিহারী দাঙ্গায় ব্যাপক রক্তক্ষয় হয়। অন্যদিকে প্রশাসনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে বাঙালি কর্তৃত্বের আতঙ্ক। যা মোকাবেলায় ঐ সময় তেমন কোন কঠোরতা ও প্রজ্ঞা দেখা যায়নি ঐ সময়ের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। এরমধ্যেই কেন্দ্রিয় সরকার করাচী থেকে ৯২(ক) ধারা জারি করে। আর মাত্র ১৫ দিনের মাথায় বাতিল হক মন্ত্রিসভা (১৫মে-২৯মে ১৯৫৪)। তখন মওলানা ভাসানী লন্ডনে আর চিকিৎসার জন্য সোহরাওয়ার্দি জুরিখে। ফজলুল হক গৃহবন্দী। তারপরও দেড় ডজন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য বাইরে ছিলেন। তাদের কেউ সেই সময় পাক সরকারের এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করেননি। সবাই চুপচুপ, ভীত। মন্ত্রিসভা বাতিলের পর গর্ভনরের দায়িত্ব নিয়ে আসেন অবাঙালি ইস্কেন্দার মীর্জা। যার মন জুগিয়ে চলতে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু করেন বাঙালি নেতারা। বাংলার বাঘ (শের) ফজলুল হক তাকে ‘খাঁটি বাঙালি’ হিসেবে আখ্যা দেন! (মুরশিদ:২০১০)।

এমন আপোষকামী পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি মনে করেছিলেন এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ হওয়া জরুরি। তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন, সবাই সমঝোতার পথে হাঁটলেও শেখ মুজিব কারাবরণ করেছিলেন স্বেচ্ছায়। উল্লেখ্য শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাবন্দী ছিলেন (প্রথম আলো:২০১৭)। কারাগারের সেল-ই হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘরবাড়ি। ১৯৫৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের এই কারাবরণের কাহিনী অনেকটা কিংবদন্তীতূল্য। ৯২(ক) ধারা জারির পর দেশে থাকা শীর্ষ নেতারা ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে, আত্মগোপনে। কিন্তু শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বেচ্ছায় গ্রেফতার হয়ে স্থাপন করেছিলেন অনন্য নজির। নিজেকে গ্রেফতারের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ফোন করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে (শেখ মুজিব) গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি গাড়ি পাঠিয়ে দেন’ (রহমান,২০১২:২৭১)।

যুক্তফন্ট্রের নির্বাচনে অভূতপূর্ব বিজয় যেমন এদেশের রাজনীতিতে অনন্য ঘটনা ঠিক তেমনি চাপের মুখে পলায়নপর হওয়া, লাঠি-বন্দুকের মুখে সমঝোতামুখী হওয়ার নেতিবাচক দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছিলেন বাঙালি শীর্ষ রাজনীতিবিদরা। যে বিষয়টি ভীষণভাবে ব্যথিত করেছিল শেখ মুজিবকে। তাইতো তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘নীতিবিহীন নেতা নিয়ে আগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়, কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না’ (রহমান,২০১২: ২৭৩)।

নীতিবিহীন শীর্ষ নেতারা যখন ভবিষ্যত স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টায় মশগুল এমন সময়ই জারি করা হয় সেনা শাসন। প্রথমে ইস্কান্দার মীর্জা পরে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে শুরু হয় ধড়পাকড়। রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে স্থবিরতা। এক স্থবিরতা চলে কয়েক বছর। তবে ৬০ এর দশকের শুরুতে ছাত্র রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিশেষ গতি পায়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম শতবার্ষিকীর আয়োজন ও তাতে সেনা কর্তৃপক্ষের বাঁধার ফলে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আরও দুর্বর হয়ে ওঠে। এদিকে আইয়ুব খানের কড়া সেনা শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে। মাঝে ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পর নতুন কর্মসূচি নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে হাজির হন শেখ মুজিব। উল্লেখ্য লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বরে রহস্যজনকভাবে সোহরাওয়ার্দির মৃত্যু হলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে চলে আসেন শেখ মুজিব। দলটির মধ্যে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ ও সাহসী নেতাদের প্রতিনিধি। যারা পুরাতন ধ্যান-ধারনার বাইরে গিয়ে বাঙালির অধিকার আদায়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য উন্মুখ ছিলেন। নতুন দিনের, নতুন সম্ভাবনার এই রাজনীতির শুরুতেই ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে ঘোষণা করেন তাঁর ঐতিহাসিক ‘৬ দফা কর্মসূচী’। যা পরবর্তীতে বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ হিসেবে প্রতীয়মান হয়। এতে পুরো পাকিস্তানের রাজনীতিতে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়। আইয়ুব খান হুমকি দেন ‘অস্ত্রের ভাষায়’ এই কর্মসূচি নস্যাৎ করার। শেখ মুজিবুর রহমানের এই ‘৬-দফা কর্মসূচী’তে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তির দিক নির্দেশনা ছিল। ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অঙ্গীকার। নানা দিক থেকে ৬-দফা একটি সমন্বিত, সুচিন্তিত রাজনৈতিক কর্মসূচি হলেও অনেকেই এই কর্মসূচির বিরোধীতা করেন। এমন কি ঐ সময়ের বুদ্ধিজীবীরা ৬-দফা’কে ভালোভাবে নেয়নি। শুধু ছাত্রলীগ এই ৬-দফা’কে ‘ম্যাগনা কার্টা’ (Magna Carta) বা অধিকারের দলিল হিসেবে গ্রহণ করে।

এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান নানা কর্মসূচিতে ৬-দফা’কে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে যান। দিন-রাত সভা, সমাবেশ, কর্মী সভা ও জেলা পর্যায়ের সভা করে জনমত তৈরি করেন। ধীরে ধীরে এই কর্মসূচি সম্পর্কে মানুষের জনমত গঠিত হতে থাকে। উল্লেখ্য ৬-দফাকে রাজনৈতিক দাবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে দৈনিক ইত্তেফাক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান যখন ‘৬-দফা’ নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছেন তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে তেমন আর কেউ ছিলেন না। সোহরাওয়ার্দির মৃত্যুর পর আতাউর রহমান খান ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট গঠন করলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। পাকিস্তানপন্থী, ডানপন্থী বা জিন্নাহ্পন্থী রাজনীতিকরা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পালাবদলের জোয়ারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। মওলানা ভাসানী তখন ন্যাপ নিয়ে নিজের মতো করে দল গোছানোর চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু প্রভাব ছিল সীমিত। মস্কোপন্থী অধ্যাপক মোজাফরের রাজনৈতিক শক্তিও ছিল বেশ সীমিত। এমন বাস্তবতায় শেখ মুজিবুর রহমান ও তার ‘৬-দফা’ কে প্রধান সমস্যা (বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মসূচি) হিসেবে বিবেচনা করে পাক কর্তৃপক্ষ। ১৯৬৬ সালের ৮ই মে গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় শেখ মুজিবুর রহমানের আরেক দফা লম্বা কারাজীবন। এ দফায় তাকে খুব সামান্য, নগন্য সব মামলা দিয়ে কারাগারে আটকে রাখা হয়। জামিন হওয়ার পর জেল গেটেও আটক হন। এদিকে শেখ মুজিবুর রহমানে বিরুদ্ধে শুরু হয় আরেক ভয়াবহ ষড়যন্ত্র। দেশদ্রোহীতার অভিযোগে তাঁকে ১ নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে ‘আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করে আইয়ুব খানের সরকার (মুরশিদ:২০১০)।

একজন সাহসী শেখ মুজিব, যিনি জীবন ভয়কে তুচ্ছ করে ৬-দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের কথা চিন্তা করেছেন, বাঙলার মানুষের মুক্তির চিন্তা করেছেন তার প্রতিফলন পাওয়া যায় ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৮)’তে। ১৯৬৬ সলের ২রা জুন প্রতিদিনের দিনলিপিতে একজন শেখ মুজিবুর রহমান ঐ সময়ের অন্যান্য নেতাদের সমঝোতা ও পলায়নপর মানসিকতা নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন লিখেছেন। তখন ন্যাপ নেতা মশিয়ুর রহমান আইয়ুব খানকে খুশি করতে কড়া কড়া বিবৃতি দিতেন। যা পত্রিকার পাতাতে প্রকাশিত হতো। উল্লেখ্য মশিয়ুর রহমান একাধিকবার ৬-দফা ভিত্তিক আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নবাদী আন্দোলন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ২রা জুন ১৯৬৬ শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন,

‘এদের এই ধরনের কাজেই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা ধরা পড়ে গেছে জনগণের কাছে। জনগণ জানে এই দলটির কিছু সংখ্যক নেতা কিভাবে কৌশলে আইয়ুব সরকারের অপকর্মকে সমর্থন করছে। আবার নিজেদের বিরোধী দল হিসেবে দাবি করে এরা জনগণকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছে। এরা নিজেদের চীনপন্থী বলেও থাকেন। একজন এক দেশের নাগরিক কেমন করে অন্য দেশপন্থী, প্রগতিবাদী হয়? আবার জনগণের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে চিৎকার করে। ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে চাই না, তবে যদি তদন্ত করা যায় তবে দেখা যাবে, মাসের মধ্যে কতবার এরা পিন্ডি করাচী যাওয়া-আসা করে, আর পারমিটের ব্যবসা বেনামীভাবে করে থাকে। এদের জাতই হলে সুবিধাবাদী। এর পূর্বে মওলানা ভাসানী সাহেবও ছয় দফার বিরুদ্ধে বলেছেন, কারণ দুই পাকিস্তান নাকি আলাদা হয়ে যাবে।’ (রহমান,২০১৮: ৫৭)

একজন শেখ মুজিবুর রহমানের মাহত্ম্য এখানেই। তিনি সুবিধাবদের পক্ষে নয়, ছিলেন জনগণের অধিকারের পক্ষে। যার জন্য দিনের পর দিন জেল খেটেছেন। ফাঁসির দড়ি মাথায় উপর নিয়ে গণমানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর অন্যরা করেছেন নানা পন্থী, নানা ভিনদেশী আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতি। অন্যান্য রাজনীতিবিদরা কখনই মূলে পৌছাতে পারেননি। তারা ছিলেন উপ-ধারাতে। মূল ধারায় নন। আর শেখ মুজিব তাঁর দূরদর্শিতায় ধাপে ধাপে জনগণকে নিয়ে গেছেন অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতার পথে।

১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলায় শেখ মুজিব যখন কারাগারে, তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়। ঘটা করে উন্নয়নের দশক পালন করেও আইয়ুব খান আন্দোলনের আগুন দমাতে পারেননি। ‘ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ এর তীব্র আন্দোলন ও মওলানা ভাসানীর নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ৬৯’ সালে সংঘঠিত হয় এক অভুতপূর্ব গণ অভ্যুত্থান। যে গণ আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হয়ে প্রধান রাজনৈতিক নেতাতে পরিণত হন। ছাত্র সমাজ শেখ মুজিবুর রহমানকে আখ্যায়িত করে ‘বঙ্গবন্ধু’ বা বাংলার বন্ধু হিসেবে। এরপর বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন শেখ মুজিব।

১৯৭০ সালের নির্বাচন শেখ মুজিবুর রহমান ও বাংলাদেরে রাজনৈতিক ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ। যে নির্বাচনে বাংলার অপামর জনসাধারণ শেখ মুজিবুর রহমানকে তাদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে নেন। এই নির্বাচনে শেখ মুজিব ৬-দফা ভিত্তিক নির্বাচনী ইশতেহারের পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে সামনে নিয়ে আসেন। জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০ আসনে জয় লাভ করে পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান চরিত্রে পরিণত হন শেখ মুজিব। তবে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হলে আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজপথে নামতে হয়। ১ মার্চ ১৯৭১ আইয়ুবের উত্তরসূরী ইয়াহিয়া খান গণ পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করলে প্রবল গণ আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ওঠে ঢাকার রাজপথে, বাংলার পথে-প্রান্তরে। ৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে পাঠ করেন মুক্তি ও স্বাধীনতার অমর কবিতা। যে কবিতার ছন্দ আর ভবিষ্যত নির্দেশনায় ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে ওঠে। এক নেতা ও এক দেশের জন্য সশন্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি নেয় পুরো জাতি।

এরপর রাজনৈতিক দৃশ্যপটে শুরু হয় নতুন নাটক। আলোচনার নামে কালক্ষেপণে ঢাকায় আসেন ইয়াহিয়া খান। আসেন চতুর ভুট্টোও। শুরু হয় আলোচনা। অন্যদিকে সাধারণ পোষাকে বেসামরিক বিমানে ঢাকায় আসতে থাকে পাক সেনারা। সমুদ্রপথে অস্ত্র। শেখ মুজিবুর রহমানও বসে ছিলেন না। আসন্ন সংঘাত আর চূড়ান্ত সংগ্রামের জন্য তিনিও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ছাত্র-যুব নেতাদের দিচ্ছিলেন সংকটকালের নির্দেশনা। স্বাধীনতার লক্ষ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তুতি ও তাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সহযোগিতার বিষয়ে অনেক আগে থেকেই কার্যকর যোগাযোগ রেখেছিলেন শেখ মুজিব। যে যোগাযোগ শেখ মুজিবুর রহমান শুরু করেছিলেন অনেক আগেই। উল্লেখ্য, ১৯৬৯ সালের অক্টোবরে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন শেখ মুজিব। ঐ সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের কাছে স্বাধীনতার জন্য সাহায্য চেয়েছিলেন। সেই সময়ই জরুরি যোগাযোগের জন্য ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা ও কূটনীতিকদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ আলাপ হয়েছিল।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে মার্চের উত্তাল সময়ে ইন্দিরা গান্ধি সরকারের সাহায্য ও সমর্থনের বিষয়ে নিশ্চিত হতে শেখ মুজিবুর রহমান অতি গোপনে ভারতে প্রতিনিধি পাঠিয়েছিলেন। যে ঘটনা প্রবাহের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা পাওয়া যায় মুসা সাদিকের লেখা ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান’ নিবন্ধে। নিবন্ধটি বাংলা অ্যাকাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘বাঙলা ও বাঙালির ইতহাস, চতুর্থ খ-, দ্বিতীয় পর্ব’ (২০১২)’তে সংকলিত হয়েছে। তাতে মুসা সাদিক উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ তাঁর বিশস্ত দুই রাজনৈতিক সহচর রুহুল কুদ্দুস সিএসপি (আগড়তলা ষড়যন্ত্র মালার আসামী) ও নুরউদ্দীন আহমদ (আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ) দিল্লী পাঠিয়েছিলেন। যারা কলকাতা হয়ে লন্ডনস্থ ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে দিল্লীর সাথে যোগাযোগ করেন। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের এই দুই প্রতিনিধির সাথে প্রভাবশালী মন্ত্রী দূর্গা প্রসাদ ধরের বৈঠক হয়। এরপর আলোচনা হয় ভারতের নীতি নির্ধারক সাউথ ব্লকের অনেক শীর্ষ কর্তাদের সাথে। রুহুল কুদ্দুস ও নুরউদ্দীন ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি ও শেখ মুজিবের অবস্থান ব্যাখ্যা করেন। কামনা করেন কাঙ্খিত সহযোগিতা। দিল্লীর ডিফেন্স কলোনীর এক বাড়িতে একদিন খুব ভোরে রুহুল কুদ্দুস ও নুরউদ্দীন পি.এন. হাকসারের মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধির সংক্ষিপ্ত বার্তা পান, ‘We wish doctors will take care of your health and to your A.L. family’. এই বার্তা নিয়ে ১৭ই মার্চ খুলনা হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন রুহুল কুদ্দুস ও নুরউদ্দীন। দ্রুত ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুকে তারা এই বার্তা জানান। যার ভিত্তিতে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে মনস্থির করে ফেলেন শেখ মুজিবুর রহমান। উল্লেখ্য ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান অনেক যুব নেতাকে কলকাতার একটি বাড়ির ঠিকনা দিয়েছিলেন। কলকাতা শহরতলীর এই বাড়িটি ছিল চিত্তরঞ্জন সুতারের। যার মাধ্যমে ভারতীয় শীর্ষ নেতৃত্ব ও গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর সাথে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেতাদের। অনেক সমালোচক বলে থাকেন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাননি! তাদের জন্য এই ঘটনাপ্রবাহ এক বড় জবাব। একজন শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীনতা চাননি, তিনি এই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছেন অত্যন্ত দূরদর্শিতা ও প্রজ্ঞার সাথে। যার আরও এক নজীর ২৫ মার্চে ক্র্যাকডাউনের পর স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা। যে ঘোষণাতে শেখ মুজিব বলেছিলেন ‘… দখলদার বাহিনীর একজন সেনা বাংলার মাটিতে থাকা পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে’। যার ভিত্তিতেই ৯ মাসেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালি জাতি পেয়েছে একটি মানচিত্র, একটি লাল-সবুজের পাতাকা। যে পতাকার লাল সবুজের বুননে মিশে আছে শেখ মুজিবুর রহমান। যে ভূখন্ডের প্রতি ধূলিকণাতে মিশে আছে শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর মমতা আর দেশের জন্য ভালোবাসা।

লেখক- সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সহায়ক গ্রন্থ:
আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৬), আওয়ামী লীগ: উত্থান পর্ব। ঢাকা: প্রথমা।
আহমদ, মহিউদ্দিন (২০১৭) আওয়ামী লীগ: যুদ্ধ দিনের কথা ১৯৭১। ঢাকা: প্রথমা।
বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস (২০১২), চতুর্থ খ-, তৃতীয় পর্ব, ঢাকা: বাংলা একাডেমী।
মুরশিদ, গোলাম (২০১০), মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর। ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন।
পেয়ারা, শামসুদ্দিন (২০১৯) আমি সিরাজুল আলল খান। ঢাকা: মাওলা ব্রাদার্স।
প্রথম আলো, ৭ই মার্চ ২০১৭।

আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের ৭২ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর