তাঁর মত করে আমাদের আর কেউ চিনতে পারেনি
৭ মার্চ ২০১৮ ১৭:১৯
বাঙালি নিজেকে চিনতো না। তারা জানতোই না তাদের ক্ষমতার পরিধি কতটা। তারা ভাবতেই পারতো না সব শোষনের বিরুদ্ধে তারাও গর্জে উঠতে পারে। তারা জানতোই না তাদের এভাবে আর ‘দাবায়ে’ রাখা যাবে না।
একটা মানুষ ছিলেন। সত্যিকারের মানুষ। সেই মানুষটাই শুধু জানতেন। তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে এদেশের ছোটখাট গড়নের বাদামি চামড়ার এই নারী পুরুষেরা পারবে অসাধ্যকে সাধন করতে। তারাই পারবে মানুষ থেকে আগুন হয়ে উঠতে। তারা আগুন থেকে বারুদ হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মাঠে ঘাটে শহরে বন্দরে গ্রামে নদীতে। তাই তিনি আর দেরি করলেন না। গর্জে উঠলেন তিনিও। আর একটা আঘাতও প্রত্যাঘাত ছাড়া ফিরে যাবে না। আর সেই প্রত্যাঘাত করবে তার মানুষেরা, তার প্রিয় বাঙালিরা।
সাত মার্চ এলে বঙ্গবন্ধুর ভিতরে গভীর দার্শনিক সত্ত্বাটাকে আবার স্পষ্ট অনুভব করতে পারি। একজন গভীর চিন্তাশীল দার্শনিকের পক্ষেই এই শক্তিটাকে টের পাওয়া সম্ভব, যে শক্তি লুকিয়ে ছিল আস্ত একটা জাতির ভিতরে। যে শক্তি রূপান্তরিত হতে পারে স্বপ্নে এবং শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন দেশকে ছিনিয়ে আনার মধ্যদিয়ে যে স্বপ্ন বাস্তব হয়ে ধরা দেবে, এটা সম্ভব, এবং তা সম্ভব করবে এই কালোকেলো রোগা পটকা লোকগুলোই, এই সরল সুন্দর নারীরাই, কোমল শিশুরাই।
শেখ মুজিবের সবচেয়ে বড় সার্থকতা হয়তো সেখানেই। হয়তো সে কারণেই তিনি জাতির পিতা। কারণ একজন পিতাই সন্তানকে চিনতে পারে। সন্তানের শক্তি ও সামর্থের ওপর আস্থা রাখতে পারে। বিশ্বাস রাখতে পারে। বঙ্গবন্ধু পেরেছিলেন।
যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, যেহেতু বঙ্গবন্ধুকে দেখিনি, তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর জন্মেছি, তাই তাকে নিয়ে লেখা বইপত্র, ইতিহাস আর তাঁর দেয়া ভাষণগুলোই হয়ে ওঠে তাঁকে চেনার মাধ্যম। বঙ্গবন্ধুকে আমি সেভাবেই চিনেছি। এর বাইরে শৈশবে আমার কাছে বঙ্গবন্ধু ছিল একটা ছবি, বসার ঘরের দেয়ালে টাঙানো। আর একটা অবাক ব্যাপার ঘটতো। আমার বাবাকে দেখতাম, নানা প্রসঙ্গে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটা উচ্চারণ করলেই তার দু’চোখের কোন ভিজে যাচ্ছে জলে। গলা ভারি হয়ে যাচ্ছে। বিব্রত তিনি চুপ হয়ে যাচ্ছেন অথবা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছেন। শিশু আমি ভাবতাম, বঙ্গবন্ধু মানে তবে একটা গভীর বেদনা! তাকে হারানোর যন্ত্রণা এদেশের মানুষের বুকের গভীরে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছিল, সেই ক্ষতের জ্বালা তাদের বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।
কেন বঙ্গবন্ধুকে এভাবে ভালবেসেছিল বাঙালি? কেন তাকে এখনো এভাবে ভালবাসে? কেন তাকে না দেখেও তার জন্য গভীর মমতা আর বেদনা ধারণ করে আমাদের প্রজন্ম? তার পরের প্রজন্ম? আরো প্রজন্ম? কীভাবে তিনি যুগ যুগ ধরে বাঙালির বুকের রক্তের ভেতরে ভালবাসার ধারা হয়ে বয়ে চলেছেন?
এভাবে যখন ভাবি, মনে হয়, একাত্তর ছাড়া আর কখনো এত বিশাল ব্যাপ্তিতে জেগে ওঠেনি বাঙালি। এতটা ঐক্যবদ্ধ আর কখনো হতে পারেনি তারা। ঠিক সেরকম নিজেদের শক্তিতে বিশ্বাস রেখে এতটা গর্জেও ওঠেনি কখনো তারা। না একাত্তরের আগে, না পরে। ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানও ছিল একাত্তরের প্রস্ততি। সেইসব গর্জে ওঠার একের পর এক ঘটনার সম্মিলিত সব কাঁপানো ঝড় শেষ পর্যন্ত আছড়ে পড়েছিল একাত্তরে। একাত্তর এই জাতির জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা যে ঘটনার মধ্যদিয়ে বাঙালি নিজের শক্তিমত্তা, নিজের আত্মবিশ্বাসকে ফিরে পেয়েছিল, নিজের ওপর আস্থা রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, নিজের অধিকার আদায়ে সরল সোজা নিতান্ত সাধারণ বাঙালি অকুতোভয় যোদ্ধা হয়ে উঠেছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা মাত্র নয়মাসের যুদ্ধে সে বিজয় এনেছিল। আর এর পুরোটা ঘটিয়ে দিলেন যিনি, তিনি একজন মানুষ, তিনি বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধু না চেনালে বাঙালি নিজেকে চিনতে পারতো কি আদৌ? হয়তো পারতো না। সাত মার্চে বঙ্গবন্ধু ডাক না দিলে, উদ্বুদ্ধ না করলে আমরা হয়তো আজো শোষন আর নীপিড়নেরে ইতিহাসই বয়ে বেড়াতাম। ঠিক যেরকম বয়ে বেড়াচ্ছে আরো অনেক জাতি।
একটা সৌভাগ্যবান জাতি ছিলাম আমরা, যারা বঙ্গবন্ধুকে পেয়েছিল। যাদের জীবনে সাত মার্চের ভাষণ এসেছিল। শোষকের অগ্নিচক্ষু আর বেয়নেটের নিচে দাঁড়িয়ে এভাবে প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে পারেন যে নেতা, সেই নেতা আমরাই পেয়েছিলাম। জেলখানার পাশে নিজের কবর খোড়ার খবর পেয়েও নিজের অবস্থানে অবিচল থাকেন যিনি, সেই বঙ্গবন্ধু আমাদেরই ছিল। ছিল বলেই আজ বাংলাদেশ আমাদের, তিনি ছিলেন বলেই আজ একটা সবুজ পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা রবীন্দ্রনাথের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গাই। আমাদের প্রাণের ভিতরে যে গান বাজে, সেই গানটাকে আমাদের নিজেদের গান করে দিয়ে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
সাত মার্চ আসলে বুঝতে পারি, সে এক সময় ছিল, যখন এক গভীর দার্শনিক নিজের মানুষদের চিনতে পেরেছিলেন, তাদের বুকের ভেতরে থাকা আগুনকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন। সাত মার্চের ভাষণ একটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ, একটি শ্রেষ্ঠ কবিতা।
একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই ভাষণ শোনা এবং বারবার পড়ার সুযোগ থাকা উচিত। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেই যেন প্রতি প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ভাষণটি শোনে এবং পড়ে সেই সুযোগ এবং ব্যবস্থা থাকা উচিত। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর প্রায় সব ভাষণই খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং চিন্তাকর্ষক। সাত মার্চের ভাষণ এদেশের প্রতিটা মানুষের। সব শ্রেণি পেশা ধর্ম বর্ণ গোত্র ও মতাদর্শের মানুষের। যেহেতু বঙ্গবন্ধু সবার, যেহেতু বাংলাদেশ সবার।
শুধু সাত মার্চের আনুষ্ঠানিকতায় এই ভাষণটি কয়েকজন মানুষের কাছে না থেকে ছড়িয়ে পড়ুক সবার কাছে, ছড়িয়ে পড়ুক প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। কারণ, যতবার এই ভাষনের একেকটা শব্দ বাক্য আমাদের কানে প্রবেশ করবে, হৃদয়ে ছড়িয়ে যাবে, ততবার আমরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবো, নিজেদের শক্তিতে জেগে উঠতে পারবো। ঠিক ততবারই আমরা উপলদ্ধি করবো, অনৈক্যের অভিশাপ বহুকাল আমাদের ভোগাচ্ছে; অন্তত মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে আমরা যেন আমাদের চেতনায় এক ও ঐক্যবদ্ধ থাকি।
[এই কলামে উপস্থাপিত মতামত সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব ]
সারাবাংলা/এসএস