করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন কতদূর?
২৭ জুলাই ২০২০ ২১:৩৪
গোটা পৃথিবী জুড়ে গবেষকগণ প্রায় ১৬৫টিরও বেশি প্রজেক্টে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন, যার মধ্যে ২৭টি ভ্যাকসিন গবেষণাগার পেরিয়ে ইতিমধ্যে হিউম্যান ট্রায়াল পর্যন্ত আসতে পেরেছে। অর্থাৎ মানুষের শরীরের উপর প্রয়োগ করে এই ২৭টি ভ্যাকসিনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। সাধারণত এক একটি ভ্যাকসিন ক্লিনিক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে অনেক বছরের গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ বছরের মধ্যেই করোনাভাইরাসের নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
কোন ভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির প্রথম শর্ত হচ্ছে সে ভাইরাস সম্পর্কে জানতে হবে। ভাইরাসের জেনেটিক কোড কিরকমভাবে তৈরি তা বুঝতে হবে। গত বছরের শুরুতে চীনের হুবই প্রদেশের উহান শহরে অজানা নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হতে থাকলে তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা এ ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করতে থাকেন। ১১ জানুয়ারি চীনের সাংহাই ল্যাবের বিজ্ঞানীরা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রথমবারের মতো নভেল করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করেন। সেখান থেকেই প্রথম জানা যায় প্রচলিত SARS-CoV ভাইরাস যা SARS রোগের জন্য দায়ী ছিলো সেই ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সের সঙ্গে এই নতুন ভাইরাসের সিকোয়েন্সের শতকরা প্রায় ৮৯ ভাগ মিল রয়েছে। তার পরে নানা দেশে, নানা গবেষণাগারে এই ভাইরাসের বিভিন্ন স্ট্রেইনের জিনোম সিকোয়েন্সিং করা হয়েছে। আমাদের দেশে মে মাসে প্রথম জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করা হয়। পরবর্তীতে সারা বিশ্বের মত আমাদের দেশেও জিনোম সিকোয়েন্সিং করে করোনাভাইরাসের বেশ কয়েকটি স্ট্রেইন পাওয়া গিয়েছে।
জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ধার করে সেই জানুয়ারি থেকেই বিজ্ঞানীরা কাজে লেগে পড়েন করোনার ভ্যাকসিন তৈরি করতে। তার পথ ধরে প্রথম হিউম্যান ট্রায়াল শুরু হয় মার্চ মাসে। অনেকগুলো ভ্যাকসিন সফল হওয়ার পথে রয়েছে, কিছু হয়তো ব্যর্থ হবে। কতগুলো আবার নানা ধাপের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বৈতরণী ঠিকমত পার হতে পারবে না। তবে আশা করতে দোষ নেই যে, এর মধ্যে কিছু ভ্যাকসিন ঠিকই মানবদেহে প্রাণঘাতী প্রতিক্রিয়া ছাড়াই যথাযথ অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে।
যেসকল ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত হিউম্যান ট্রায়াল পর্যায়ে পৌঁছেছে সেগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি সহও আর যেসকল আশাজাগানিয়া ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরিতে কোষে অথবা অন্য প্রানীর দেহে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেগুলোর বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হলো।
ভ্যাকসিন অনুমোদন প্রক্রিয়া
মূলত কয়েকটি ধাপের পরীক্ষার শেষে কোন ভ্যাকসিন অনুমোদন দেওয়া হয়। আমাদের দেশে অনেকেই দাবী করেন স্বপ্নে ভ্যাকসিন পাওয়ার কিংবা কিছুটা গুগল সার্চ করে ভ্যাকসিন পেয়ে যাওয়ার। কিন্তু বাস্তবে যেকোনো রোগের ভ্যাকসিন জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করার আগে বেশ কিছু ধাপ পার হতে হয়। এগুলো সম্পর্কে প্রথমে জেনে নেওয়া যাক।
ধাপ-০ প্রাক-ক্লিনিকাল পরীক্ষা:
এই প্রক্রিয়াটি মূলত গবেষণাগারে সম্পন্ন করা হয়। এখানে প্রথমত নানা তাত্ত্বিক আলোচনা এবং তুলনা শেষে বিজ্ঞানীরা তাদের তৈরিকৃত ভ্যাকসিন ইঁদুর, গিনিপিগ, খরগোশ বা বানর এ জাতীয় প্রাণীর উপরে প্রয়োগ করেন। তারপরে ঐ প্রাণীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভ্যাকসিনের সঙ্গে কিভাবে মোকাবিলা করছে তা পর্যবেক্ষণ করেন। গবেষণা করে দেখেন যে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে যে ধরনের ইমিউন রেসপন্স তারা তাত্ত্বিকভাবে চিন্তা করেছিলেন, তা বাস্তবিকই পাচ্ছেন কিনা।
ধাপ-১ সুরক্ষা পরীক্ষা:
এই পর্যায়ে বিজ্ঞানীরা অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দেখেন কতো মাত্রায় ভ্যাকসিনটি দেওয়া হলে এটি কার্যকরভাবে মানবদেহে প্রয়োজনীয় ইমিউন রেসপন্স তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি নানা মাত্রায় ভ্যাকসিনটি মানবদেহে প্রয়োগের মাধ্যমে দেখা হয় কোন মাত্রাটি মানবদেহের জন্য সবচেয়ে বেশি নিরাপদ। এই ধাপ শেষে ধরে নেওয়া যায় ভ্যাকসিনটি নির্দিষ্ট মাত্রায় সবার জন্য নিরাপদ বলে ধরে নেওয়া যায়।
ধাপ-২ মাত্রা ও কার্যকারিতা পরীক্ষা:
এই পর্যায়ে প্রায় শখানেক মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। ভিন্ন ভিন্ন বয়সের মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে ভ্যাকসিন ট্রায়াল দিয়ে দেখা হয় কোন বিশেষ গ্রুপের উপর এর কোন ব্যতিক্রম প্রতিক্রিয়া হয় কি না। সাধারণত একই ভ্যাকসিন ভিন্ন বয়সী বা ভিন্ন জীবনাচরণের মানুষের উপর ভিন্নভাবে প্রভাব ফেলে। তাছাড়া প্রায় সব মানুষের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা একেক ভাবে ভ্যাকসিনের প্রতি কাজ করতে পারে। বিভিন্ন জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের কারণেও, বংশগত রোগের কারণেও একই ভ্যাকসিন ভিন্ন মানুষের উপর ভিন্ন প্রভাব ফেলতে পারে। এই ধাপ শেষ হলে মূলত ভ্যাকসিনটি অধিকাংশ মানুষের জন্য কাজ করবে বলে ধরে নেওয়া হয়।
ধাপ-৩ তুলনামূলক মূল্যায়ন:
এই ধাপে হাজার হাজার মানুষের উপর ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। একই সাথে আরেক গ্রুপ ভলান্টিয়ারদের দেওয়া হয় প্লাসিবো। প্লাসিবো এর মানে হচ্ছে আপনাকে কোন ভ্যাকসিন প্রয়োগ না করেও বলা হবে যে আপনি ভ্যাকসিন পেয়েছেন। সোজা বাংলায় বললে আপনার সাথে এই ভণিতাটুকু করা হবে বিজ্ঞানের স্বার্থে। এরপরে দেখা হবে ভ্যাকসিন প্রাপ্ত মানুষ আর প্লাসিবো প্রাপ্ত মানুষের মধ্যে কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। ভ্যাকসিনটি আসলেই করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর কিনা তা এই ধাপের ট্রায়ালগুলোই নির্ধারণ করবে। অর্থাৎ কোন ভ্যাকসিন ধাপ ৩ সফলভাবে পার করতে পারলেই আমরা বলতে পারবো আমরা করোনার ভ্যাকসিন পেয়ে গেছি।
অনুমোদন:
ধাপ-৩ পার করা ভ্যাকসিন ট্রায়ালের ফলাফল প্রতিটি দেশের নীতিনির্ধারকেরা পুনঃমূল্যায়ন করার পর অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে মহামারিকালিন অবস্থায় কোনো কার্যকর ভ্যাকসিন আনুষ্ঠানিক অনুমোদনের পূর্বেই জরুরি ব্যবহারের অনুমতি পেতে পারে।
সমন্বিত ধাপ:
উন্নত, নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন উৎপাদনের সামগ্রিক প্রক্রিয়াটিকে আর তরান্বিত করার আরেকটি উপায় হলো ভিন্ন ভিন্ন ধাপগুলো একই সঙ্গে পরিচালনা করা। যেমন কিছু কিছু করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন এই মুহূর্তে একই সাথে ধাপ-১ ও ২ এ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রথমবারেই শখানেক মানুষের উপর এই ভ্যাকসিনগুলোর ট্রায়াল দেওয়া হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে এটি কখনোই করা হতো না, কিন্তু এখন সময় মোটেও স্বাভাবিক নয়।
জেনেটিক ভ্যাকসিন
যে ভ্যাকসিনগুলো তৈরিতে করোনাভাইরাসের (বা অন্য কোন ভাইরাসের) এক বা একাধিক জিন ব্যবহার করা হয় সেগুলোকে জেনেটিক ভ্যাকসিন বা জিন ভ্যাকসিন বলা হয়ে থাকে।
মডার্না: [ধাপ-২] আমেরিকান কোম্পানিরগুলোর মধ্যে মডার্নাই প্রথম তাদের ভ্যাকসিন হিউম্যান ট্রায়াল শুরু করতে পেরেছে। এই ভ্যাকসিনটি মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) ব্যবহার করে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করে। ১৪ জুলাই প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দেখা গেছে মডার্নার এই ভ্যাকসিনটির ধাপ-১ এর ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। ধাপ-৩ এর ট্রায়াল শুরু হতে যাচ্ছে ২৭ জুলাই থেকে। ২০২১ এর শুরুতেই তাদের ভ্যাকসিনটির ডোজ তৈরি হয়ে যাবে বলে তারা আশাবাদী।
বায়োন্টেক ফাইজার ফোসুন: [ধাপ-১/২] জার্মান কোম্পানি বায়োন্টেক, আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার এবং চায়নিজ ওষুধ কোম্পানি ফোসুন-ফার্মা এর সাথে যৌথভাবে তাদের mRNA ভ্যাকসিন তৈরি করছে। জুলাই মাসে আমেরিকা ও জার্মানিতে তারা এই ভ্যাকসিনের ধাপ-১/২ ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশ করেছেন। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই ভ্যাকসিনটি যে ভলান্টিয়ারদের শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছিল তারা SARS-CoV-2 বিরুদ্ধে এন্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু তাই নয়, এটি তাদের শরীরে T cells রেসপন্স বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে। তবে কিছু ভলান্টিয়ারের মধ্যে নিদ্রাহীনতা এবং ব্যাথার মতো সামান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
ইম্পেরিয়াল কলেজ: [ধাপ-১/২] ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের গবেষকরা একটি “সেলফ-এমপ্লিফাইয়িং” আরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন, যা মানবদেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে আরও সক্রিয় করতে একটি ভাইরাল প্রোটিনের উৎপাদন বাড়িয়ে তোলে। তারা ১৫ জুন থেকে ধাপ-১/২ এর ট্রায়াল শুরু করেছেন এবং “ভ্যাকইউকোটি গ্লোবাল হেলথ” নামে একটি নতুন সংস্থার মাধ্যমে ভ্যাকসিন তৈরি ও বিতরণ করতে “মর্নিংসাইড ভেনচার” এর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। গবেষকরা আশা করছেন এই ভ্যাকসিনটি কার্যকর কিনা তা এই বছরের শেষ অব্দি তারা জানতে পারবেন।
জাইডাস: [ধাপ-১/২] ভারতীয় ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি জাইডাস ক্যাডিলা একটি ডিএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরি করছে। “ভারত বায়োটেকের” পরে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন তৈরির দৌড়ে প্রবেশকারী ভারতের দ্বিতীয় সংস্থা হিসেবে গত ৩ জুলাই তারা তাদের তৈরি ভ্যাকসিনটির হিউম্যান ট্রায়ালের অনুমোদন পেয়েছেন বলে ঘোষণা দেন।
ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়: [ধাপ-১/২] ৩০ শে জুন, জাপানি জৈবপ্রযুক্তি সংস্থা অ্যানজিস ঘোষণা করেছে যে তারা ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং টাকারা বায়োর সাথে যৌথভাবে একটি ডিএনএ-ভিত্তিক ভ্যাকসিনের নিরাপত্তা পরীক্ষা শুরু করেছে।
আর্কটারাস থেরাপিউটিক্স: [ধাপ-১/২] ক্যালিফোর্নিয়া ভিত্তিক সংস্থা আর্কটারাস থেরাপিউটিক্স এবং সিংগাপুরের ডিউক-এনইউএস মেডিকেল স্কুল মিলিতভাবে একটি এম-আরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনঅণুগুলোর “সেলফ-রেপ্লিকেটিং” ডিজাইনের ফলে প্রাণীর উপর করা পরীক্ষাগুলোতে জোরালো ইমিউন রেসপন্স দেখা গিয়েছে। ২১ জুলাই সিঙ্গাপুর সরকার মানুষের উপর এই ভ্যাকসিনটির ধাপ-১ ও ২ ট্রায়ালের আবেদন অনুমোদন দেয়।
ইনোভিও: [ধাপ-১] ৩০ শে জুন আমেরিকান সংস্থা ইনোভিও ঘোষণা করে যে তাদের ডিএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিনের ধাপ-১ ট্রায়ালের অন্তর্বর্তীকালীন ডেটা তারা পেয়ে গেছেন। প্রাপ্ত ডেটা অনুযায়ী তারা কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুঁজে পাননি বরং ৩৬ জন স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে ৩৪ জনের মধ্যেই এটি প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। তারা এই গ্রীষ্মে ধাপ-২/৩ এর পরীক্ষা শুরু করার পরিকল্পনা করছেন।
কিওরভ্যাক: [ধাপ-১] মার্চ মাসে ট্রাম্প প্রশাসন “কিওরভ্যাক”-কে প্ররোচিত করে এর রিসার্চ জার্মানি থেকে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সরিয়ে নিতে ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। জুনে সংস্থাটি তার এম-আরএনএ ভ্যাকসিনের ধাপ-১ এর ট্রায়াল শুরু করে। সংস্থাটি জানায় যে তাদের জার্মান কেন্দ্রটি বছরে কয়েক মিলিয়ন ভ্যাকসিন ডোজ তৈরি করতে সক্ষম।
জেনেক্সিন: [ধাপ-১] কোরিয়ান সংস্থা “জেনেক্সিন” জুনে তাদের ডিএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিনের সুরক্ষা পরীক্ষা শুরু করে। তারা এই আগস্টে ধাপ-২ পরীক্ষায় যাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।
চায়নিজ একাডেমি অফ মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেস: [ধাপ-১] “একাডেমি অফ মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেস”, “সুজহো অ্যাবোজেন বায়োসাইন্সেস” এবং “ওয়ালভ্যাক্স বায়োটেকনোলজি” এর চীনা গবেষকরা তাদের তৈরি “ARCoV” নামে একটি এম-আরএনএ ভিত্তিক ভ্যাকসিনের মাধ্যমে তাদের দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করতে যাচ্ছেন। জুন মাসের ১৯ তারিখ তারা এই সংক্রান্ত অনুমোদন লাভ করেন। এই গবেষণার শুরুর দিকে, বানরের উপর চালানো ট্রায়ালে তারা ভালো ফলাফল লাভ করেছিলেন বলে তারা বেশ আশাবাদী এই ভ্যাকসিনের ব্যাপারে।
সানোফি: [ধাপ-০] ফ্রান্সের ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থা “সানোফি”, “ট্রান্সলেশন বায়ো” এর সাথে মিলিত হয়ে একটি এম-আরএনএ ভ্যাকসিন তৈরি করছে। গত ২৩জুন তারা ঘোষণা করেন যে আগস্টে তারা ধাপ-১ এর ট্রায়াল শুরুর পরিকল্পনা করছেন। মূলত সানোফির অর্থায়নে ট্রান্সলেশন বায়োর প্রযুক্তি নিয়ে এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হচ্ছে, সানোফি যা বাজারজাত করার একচ্ছত্র অধিকার পাবে।
ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন
যেসকল ভ্যাকসিন করোনাভাইরাসের জিনগুলোকে কোষের ভেতর পৌঁছাতে অন্য একটি ভাইরাসকে বাহক হিসেবে ব্যবহার করে এবং এর মাধ্যমে মানবদেহে রোগপ্রতিরোধমূলক প্রতিক্রিয়ার উদ্দীপনা জাগায় তাদের ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন বলা হয়ে থাকে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি: [ধাপ-২/৩] ব্রিটিশ-সুইডিশ সংস্থা অ্যাস্ট্রাজেনেকা এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ChAdOx1 নামক একটি শিম্পাঞ্জি অ্যাডেনোভাইরাস ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরি করছে। ২০ জুলাই ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ভ্যাকসিনটির ধাপ-১/২ ট্রায়াল নিরাপদ ছিল, এর ফলে কোনো গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি। এটি করোনভাইরাস বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি করার পাশাপশি অন্যান্য ইমিউন রেসপন্স তৈরি করতেও সক্ষম। এই ভ্যাকসিনটি এখন ইংল্যান্ডে ধাপ-২/৩ ট্রায়াল পর্যায়ে রয়েছে। এছাড়া ব্রাজিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকাতেও এর তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পটি অক্টোবরের মধ্যে জরুরি ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে পারবে ধারনা করা যায়। অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে যে তাদের এই ভ্যাকসিন যদি অনুমোদিত হয়, তবে তাদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়াবে দুই বিলিয়ন ডোজ। এই ভ্যাকসিন সফল হওয়ার সম্ভাবনা এতই বেশি, যে এর মধ্যেই আশাবাদী ব্রিটিশ সরকার এই ভ্যাকসিনের প্রায় ৯ কোটি ডোজ কেনার জন্য চুক্তি সম্পন্ন করেছে।
ক্যানসিনো: [ধাপ-২ সীমিত অনুমোদন] চীনা সংস্থা ক্যানসিনো বায়োলজিকস দেশেটির একাডেমি অফ মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্সেস এর জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাথে মিলে Ad5 নামে একটি অ্যাডেনোভাইরাস ভিত্তিক ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। মে মাসে তারা ধাপ-১ এর সুরক্ষা পরীক্ষার আশাব্যঞ্জক ফলাফল প্রকাশ করেছে এবং পরবর্তীতে জুলাই মাসে তারা জানায় যে তাদের ধাপ-২ এর পরীক্ষাগুলোয় দেখা গেছে গবেষণায় শতকরা ৯০ ভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই এই ভ্যাকসিনটি শক্তিশালী ইমিউন রেসপন্স তৈরিতে করতে সক্ষম। অভুতপূর্ব পদক্ষেপ হিসেবে, চীনা সামরিক বাহিনী ২৫ জুন “বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় ওষুধ” হিসেবে এক বছরের জন্য এই ভ্যাকসিনটি অনুমোদন করে।
জনসন অ্যান্ড জনসন্স: [ধাপ-১/২] প্রায় এক দশক আগে, যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনের ‘বেথ ইসরায়েল ডিকনস মেডিকেল সেন্টার’ এর গবেষকরা অ্যাডেনোভাইরাস-২৬ বা সংক্ষেপে Ad26 নামে একটি ভাইরাস থেকে ভ্যাকসিন তৈরির একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন। “জনসন অ্যান্ড জনসন্স” ইবোলা প্রতিরোধের জন্য প্রায় একই ধরনের ভ্যাকসিন তৈরি করেছে যা ইতিমধ্যেই ইউরোপিয় কমিশনের অনুমোদন লাভ করেছে। তারা এখন করোনাভাইরাসের জন্যও ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। ২০২১ সালের মধ্যে এক বিলিয়ন ডোজ উৎপাদনের আশা নিয়ে তারা জুলাই মাসে ধাপ-১/২ এর পরীক্ষা শুরু করেছে। তারা আশাবাদী যে তাদের ধাপ-৩ এর পরীক্ষা তারা সেপ্টেম্বরের মধ্যেই শুরু করতে পারবে।
গ্যামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউ: [ধাপ-১] রাশিয়ান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অংশ “গামালিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট” জুন মাসে তাদের “গ্যাম-কোভিড-ভ্যাক-লিয়ো” নামে একটি ভ্যাকসিনের ধাপ-১ এর পরীক্ষা শুরু করে। তাদের ধাপ-২ এর ট্রায়াল আগস্টের ৩ তারিখ শেষ হবে। এরপরে তারা ধাপ-৩ এর ট্রায়াল এর জন্য রাশিয়ার পাশাপাশি একাধিক মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করেছে। তবে গ্যামালিয়া রিসার্চের টেস্টিং প্রটোকলের গুণগত ঘাটতির ব্যাপারে খোদ রাশিয়ান এসোসিয়েশন অফ মেডিকেল রিসার্চ অর্গানাইজেশন বেশ কিছু অভিযোগ জানিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করেছে। গ্যামালিয়া এর ভ্যাকসিনটি দুইটি অ্যাডেনোভাইরাস, Ad5 এবং Ad26 এর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে। রাশিয়ার অভ্যন্তরে নিজেদের ব্যবহারের জন্য তারা এই বছর অন্তত ৩০ মিলিয়ন ডোজ প্রস্তুত করবেন। অন্যান্য দেশে জন্য আরও ১৭০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করবেন বলে তারা জানান।
নোভারটিস: [ধাপ-০] যুক্তরাষ্ট্রের জিন থেরাপি সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান জোলজেনসমা এর তৈরিকৃত অ্যাভেক্সিস নামক থেরাপির উপর ভিত্তি করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির প্রচেষ্টায় নোভারটিস সংযুক্ত হয়েছে। অ্যাডেনো-এসোসিয়েটেড ভাইরাস নামে একটি ভাইরাস কোরোনাভাইরাসের জিনের অংশ কোষে সরবরাহ করে। এই ভ্যাকসিনের জন্য ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতাল এবং ম্যাসাচুসেটস চোখ কান হাসপাতালে ধাপ-১ এর পরীক্ষা ২০২০ এর শেষের দিকে শুরু হতে চলেছে।
মার্ক-আইএভিআই: [ধাপ-০] আমেরিকান ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট মার্ক মে মাসে ঘোষণা দিয়েছিল যে এটি ভেসিকুলার স্টোমাটাইটিস ভাইরাস ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি করবে। পূর্বে এই একই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা সফলভাবে ইবোলার একমাত্র অনুমোদিত ভ্যাকসিন তৈরি করেছিল। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক এইডস ভ্যাকসিন ইনিশিয়েটিভ IAVI এর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে। এই ভ্যাকসিন তৈরির জন্য তারা মের্ক কোম্পানিটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকেল আডভান্সড রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট অথরিটি থেকে ৩৮ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়-থেমিস-পাস্তর ইনস্টিটিউট: [ধাপ-০] হাম এর ভাইরাস ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরির পদ্ধতির প্রথমে থেমিস কোম্পানিটি কিনে নিয়েছিল পাস্তর ইনস্টিটিউট থেকে। পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ভ্যাকসিন রিসার্চ এবং থেমিসের যৌথ গবেষণায় এখন একই পদ্ধতি ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চলছে। মার্ক এই থেমিস কোম্পানিটিকেও কিনে নিচ্ছে।
ভ্যাক্সার্ট: [ধাপ-০] ভ্যাক্সার্টের সান ফ্রান্সিস্কোর ভ্যাক্সার্ট কোম্পানির ভ্যাকসিনটি করোনভাইরাসের জিন বহন করতে ব্যবহার করছে একটি অ্যাডেনোভাইরাসযুক্ত ওরাল ট্যাবলেট। তারাও মার্কিন সরকারের অপারেশন ওয়ার্প স্পিডের থেকে অনুদান লাভ করেছে এই ট্যাবলেট ভাইরাস তৈরির জন্য। এই স্বীকৃতির ফলস্বরুপ তাদের শেয়ারের দাম রাতারাতি বেড়ে যাওয়ায় অপেক্ষাকৃত অপরিচিত এবং অনভিজ্ঞ এই কোম্পানির মালিকানার অংশীদার হেজ ফান্ডটি শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করেছেন।
প্রোটিন-ভিত্তিক ভ্যাকসিন
করোনাভাইরাসের নিজস্ব প্রোটিন বা নিজস্ব প্রোটিনের অংশবিশেষ ব্যবহার করে যেসকল ভ্যাকসিন ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে, তাদের প্রোটিন-ভিত্তিক ভ্যাকসিন বলা হয়ে থাকে।
আনহুই ঝিফেই লংকম: [ধাপ-২] জুলাই মাসে চীনা সংস্থা ‘আনহুই ঝিফেই লংকম বায়োটেকনলজি এবং চাইনিজ ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোবায়লজি গবেষণায় তৈরি ভাইরাস প্রোটিন ও একটি এডজুভ্যান্ট এর সমন্বয়ে গঠিত ভ্যাকসিন এর ধাপ-২ এর ট্রায়াল শুরু করে। সংস্থাটি “চংকিং ঝিফাই বায়োলজিক্যাল প্রডাক্ট” নামে একটি কোম্পানির অংশ এবং চায়নিজ একাডেমি অব মেডিক্যাল সায়েন্সের সাথে মিলিতভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনের কাজ করছে। ইঁদুর ও রেসাস বানরের উপরে এই ভ্যাকসিনটি প্রয়োগে বেশ ভালো ফলাফল লাভ করেছন বলে ইনস্টিটিউট অফ মাইক্রোবায়োলজি এর গবেষকরা জানিয়েছেন।
নোভাভ্যাক্স: [ধাপ-১/২] মেরিল্যান্ডভিত্তিক “নোভাভ্যাক্স” অতি-আণুবীক্ষণিক কণার সাথে প্রোটিন যুক্ত করার একটি উপায় তৈরি করেছে। তারা এই প্রক্রিয়াটি ব্যবহার করে বিভিন্ন রোগের জন্য ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। সংস্থাটি মে মাসের ২৫ তারিখ তাদের NVX‑CoV2373 নামক কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ধাপ-১/২ এর সম্মিলিত ট্রায়াল শুরু করে। ‘কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশনস CEPI’ এই ভ্যাকসিনটিতে ৩৮৪ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। ক্লিনিকাল ট্রায়াল এবং উৎপাদন করার জন্য এ কোম্পানিটি গত ৬ জুলাই তারিখে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকেও ১.৬ বিলিয়ন ডলার অনুদান লাভ করেছে। যদি ট্রায়াল সফল হয় তবে নোভাভ্যাক্স ২০২১ সালের প্রথম তিন মাসের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবহারের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করার প্রত্যাশা ব্যক্ত করে। এছাড়া ইউরোপ এবং এশিয়ায় অবস্থিত অন্যান্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে বলে জানায়।
ক্লোভার বায়োফর্মাসিউটিক্যালস: [ধাপ-১] ক্লোভার বায়োফর্মাসিউটিক্যালস করোনাভাইরাসের প্রোটিন সংবলিত একটি ভ্যাকসিন SCB-2019 তৈরি করেছে। এই ভ্যাকসিনটি ব্রিটিশ ঔষধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি “জিএসকে” এবং আমেরিকান সংস্থা “ডায়নাভ্যাক্স” নির্মিত এডজুভ্যান্ট প্রোটিনের সাথে সংযোজিত করা হয়েছে। ধাপ-০ এর পরীক্ষায় এক্ষেত্রে বেশ ভালো ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল। গবেষকদের আশা অনুযায়ী ধাপ-১ এর পরীক্ষা আগস্ট মাসে শেষ হবে। একই সাথে তারা ২০২০ সালের মধ্যেই সম্মিলিত ধাপ-২/৩ এর পরীক্ষা শুরু করার ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। CEPI এর বিনিয়োগের ফলে বছরে কয়েক মিলিয়ন ডোজ উৎপাদোন করা যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
মেডিকাগো: [ধাপ-১] সিগারেট প্রস্তুতকারক ‘ফিলিপ মরিস’ এর মালিকানাধীন কানাডাভিত্তিক সংস্থা ‘মেডিকাগো’ তামাক ব্যবহার করে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে। জুনের ১৩ তারিখ তারা তাদের ধাপ-১ এর পরীক্ষা শুরু করে। যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে, কোম্পানিটি অক্টোবরে ধাপ-২/৩ এর ট্রায়াল শুরু করার পরিকল্পনা করছে। উদ্ভিজ্জ প্রোটিনের মাধ্যমে তারা ২০২১ এর মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন তৈরির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়: [ধাপ-১] অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় দ্বারা প্রস্তুতকৃত ভ্যাকসিনটি একটি পরবর্তিত ভাইরাল প্রোটিন কোষে সরবরাহ করে শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। অস্ট্রেলিয়ান বায়োটেকনিক্যাল কোম্পানি সিএসএল এর তৈরি এডজুভ্যান্ট এর সাথে প্রোটিনগুলোর সংমিশ্রণে তৈরি ভ্যাকসিনের ধাপ-১ এর ট্রায়াল শুরু হয় জুলাই মাসের ১৩ তারিখ। এই ধাপের ফলাফল ইতিবাচক হলে সিএসএল পর্যায়ক্রমে পরবর্তী ধাপের ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো পরিচালনা করবে এবং তারা কয়েক মিলিয়ন ডোজ তৈরি করবে এমনটাই তাদের প্রত্যাশা। CEPI এই প্রকল্পের শুরুতেই ৪.৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান প্রদান করেছে। এর বাইরেও এই প্রকল্পটি অস্ট্রেলিয়ার সরকার, কুইন্সল্যান্ড প্রাদেশিক সরকার এবং অন্যান্য দাতাদের থেকে প্রায় ২৫ মিলিয়ন ডলার অনুদান পেয়েছে।
কেন্টাকি বায়োপ্রসেসিং: [ধাপ-১] আরেক সিগারেট প্রস্তুতকারী কর্পোরেশন ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর একটি সহায়ক সংস্থা ‘কেন্টাকি বায়োপ্রসেসিং’ আরেকটি তামাক উদ্ভিদজাত প্রোটিন থেকে ভ্যাকসিন KBP-V001 তৈরির কাজ শুরু করেছে। নিকোটিয়ানা বেন্থামিয়ানা নামক তামাকের একটি প্রজাতিকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে পরিবর্তন করে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করে তারা ভ্যাকসিন তৈরি করতে চাচ্ছে। তারা জুনের ২৫ তারিখ থেকে নেব্রাস্কার মেরিডিয়ান ক্লিনিকাল রিসার্চ সংস্থার সহায়তায় ধাপ-১ এর পরীক্ষা শুরু করেছে। সংস্থাটি ইবোলার জন্য ‘Zmapp’ নামে একটি ঔষধ তৈরি করতে আগে একই কৌশল ব্যবহার করেছিল।
ভ্যাকসাইন: [ধাপ-১] অস্ট্রেলিয়ান সংস্থা “ভ্যাকসাইন” জুলাইয়ে তাদের করোনভাইরাস ভ্যাকসিন COVAX-19 এর প্রথম ধাপের পরীক্ষা শুরু করেছে। তাদের ভ্যাকসিন ভাইরাল প্রোটিনগুলিকে একটি অ্যাডজুভেন্টের সাথে সংযুক্ত করে যা প্রতিরোধক কোষকে উদ্দীপিত করে। ইতিপূর্বে সংস্থাটি ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লু ভাইরাস আবিষ্কৃত হওয়ার তিন মাসের মধ্যেই প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল।
বেইলর কলেজ অফ মেডিসিন: [ধাপ-০] ২০০২ সালে SARS মহামারির পরে, বেইলর কলেজ অব মেডিসিন এর গবেষকরা একটি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ শুরু করেন যাতে নতুন কোন সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব রোধ করা যায়। প্রাথমিক গবেষণায় তারা বেশ ভালো ফলাফল পেয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে মহামারি না থাকায় এই প্রকল্প আর আলোর মুখ দেখে নাই। যেহেতু SARS এবং কোভিড-১৯ এর জন্য দায়ী করোনাভাইরাস প্রায় একইরকম, গবেষকরা তাই টেক্সাস চিলড্রেনস হাসপাতালের সাথে একত্রিত হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পটি পুনরায় শুরু করেছেন।
পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়: [ধাপ-০] পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত পিটকোভ্যাক ভ্যাকসিনটি মূলত একটি স্কিন-প্যাচ যা কার্বোহাইড্রেডের তৈরি ৪০০ টি অতি ক্ষুদ্র সূঁচ দিয়ে তৈরি। ত্বকে লাগানো অবস্থায়, সূঁচগুলি দ্রবীভূত হয় এবং শরীরে ভাইরাস প্রোটিন সরবরাহ করে। ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত তাদের গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে তারা ইঁদুরের উপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে দুই সপ্তাহের মধ্যেই চমৎকার ফল লাভ করেছেন।
সানোফি-জিএসকে: [ধাপ-০] এম-আরএনএ ভ্যাকসিন ছাড়াও, ফার্মাসিউটিক্যাল জায়ান্ট সানোফি ভাইরাল প্রোটিনের উপর ভিত্তি করে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করছে। পোকার কোষে পাওয়া যায় এমন একটি ভাইরাসকে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর মাধ্যমে পরিবর্তন করে তারা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রোটিন উৎপাদন করছে। জিএসকে এই প্রোটিনগুলোর জন্য এডজুভ্যান্ট সরবরাহ করবে। সানোফি জানিয়েছে, ভ্যাকসিনটি ট্রায়ালে সফল হলে তারা বছরে কমপক্ষে ১ বিলিয়ন ডোজ তৈরি করতে পারবে। সেপ্টেম্বর মাসে এই ভ্যাকসিনের সম্মিলিত ধাপ-১/২ ট্রায়াল শুরু হবে।
যখন কোন ভাইরাসকে দুর্বল বা নিষ্ক্রিয় করার পর সেটিকে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করে ইমিউন রেসপন্স তৈরি করা হয়। এই প্রক্রিয়াতে সরাসরি ভাইরাসকে ব্যবহার না করে, ভাইরাসের দুর্বল একটি ফর্ম ব্যবহার করা হয়।
সিনোফার্ম: [ধাপ-৩] রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চীনা সংস্থা সিনোফর্ম গবেষণার মাধ্যমে দেখে যে নিষ্ক্রিয় ভাইরাসের তৈরি একটি ভ্যাকসিন নিরাপদভাবে প্রতিরোধে প্রতিক্রিয়া শুরু করতে পারছে। ধাপ-১/২ এর সমন্বিত ট্রায়ালে ১১২০ জন রোগীর মধ্যে তারা শতকরা ১০০ ভাগ ক্ষেত্রেই ২৮ দিন পর ইমিউনো রেস্পন্স পাওয়া গিয়েছে। এরপর জুলাই মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাতে তারা তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করে। আবু ধাবির স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রথম স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে নিজে এই ভ্যাকসিন ইনজেকশন নেন। এই ট্রায়ালে মোট ১৫,০০০ লোকের অংশগ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে। সিনোফার্মের এই ভ্যাকসিনটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত প্রথম কার্যকরী ভ্যাকসিন হতে পারে।
সিনোভ্যাক: [ধাপ-৩] বেসরকারী চীনা সংস্থা সিনোভাক বায়োটেক “করোনোভ্যাক” নামে একটি নিষ্ক্রিয় ভ্যাকসিনের পরীক্ষা চালাচ্ছে। জুনে সংস্থাটি ঘোষণা দেয় যে ৭৪৩ স্বেচ্ছাসেবীর উপর ধাপ-১/২ এর ট্রায়ালে কোনও মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পাওয়া যায় নি। বরং শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই প্রয়োজনীয় প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছিল। পরবর্তীতে জুলাই মাসে সংস্থাটি ব্রাজিলে তৃতীয় পর্যায়ের একটি ট্রায়াল শুরু করে। এই ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের একটি ট্রায়াল বাংলাদশে ৪২০০ স্বাস্থ্যকর্মীর উপরে সম্পন্ন হতে যাচ্ছে। সংস্থাটি বছরে ১০০ মিলিয়ন ডোজ তৈরি করার জন্য একটি উৎপাদনকেন্দ্রও তৈরি করছে। এই ভ্যাকসিনটিও খুব দ্রুত জনগণের জন্য উন্মুক্ত হতে পারে।
ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল বায়লজি, চায়না: [ধাপ-২] পোলিও এবং হেপাটাইটিস-এ এর ভ্যাকসিন উদ্ভাবনকারী “ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল বায়োলজি এট দ্যা চাইনিজ একাডেমি অব মেডিকাল সায়েন্সেস” এর গবেষকগণ জুন মাসের ১৮ তারিখে একটি নিষ্ক্রিয় ভাইরাস ভ্যাকসিনের ধাপ-২ এর ট্রায়াল শুরু করেছেন।
ভারত বায়োটেক: [ধাপ-১/২] ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিকেল রিসার্চ এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির যৌথ সহযোগিতায়, ভারতীয় সংস্থা “ভারত বায়োটেক” নিষ্ক্রিয় করোনভাইরাসের উপর ভিত্তি করে “কোভাক্সিন” নামে একটি ভ্যাকসিন তৈরি করেছে। জুলাই ১৭ তারিখে শুরু হওয়া ধাপ-১ এর অংশ হিসেবে প্রায় ৫০ জনকে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছিল যে ১৫ আগস্টের মধ্যে ভ্যাকসিনটি প্রস্তুত হয়ে যাবে। তবে সংস্থাটির সিইও সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছেন যে এটি ২০২১ সালের আগে হয়তো জনগণের জন্য উন্মুক্তভাবে পাওয়া যাবে না।
স্টেট কমিশন অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি: [ধাপ-১] ১৮ জুলাই, উত্তর কোরিয়ার “স্টেট কমিশন অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি” তাদের ওয়েবসাইটে ঘোষণা করে যে তারা করোনভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের উপর ভিত্তি করে তৈরি একটি ভ্যাকসিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল শুরু করত্বে যাচ্ছে। তাদের একাডেমি অফ মেডিকেল সায়েন্সেস এর গবেষণায় এই ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে বলে কোরিয়া হেরাল্ড পত্রিকা সংবাদ প্রচার করেছে।
রিপারপাসড ভ্যাকসিন
যে ভ্যাকসিন অন্যান্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, সেটিকে যখন নতুন কোন রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মারডক চিল্ড্রেন্স রিসার্চ ইনস্টিটিউট: [ধাপ-৩] যক্ষ্মার বিরুদ্ধে সুরক্ষা হিসেবে ১৯০০ সালের গোড়ার দিকে “ব্যাসিলাস ক্যালমেট-গেরিন” (বিসিজি) ভ্যাকসিনটি তৈরি করা হয়। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় ১৯৭৯ সাল থেকে বাংলাদেশে ১ বছরের কম বয়সী শিশুদের এই বিসিজি ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। সেই একই ভ্যাকসিন করোনভাইরাস প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে কিনা তা দেখার জন্য অস্ট্রেলিয়ার “মারডোক চিলড্রেন রিসার্চ ইনস্টিটিউট” প্রায় ১০ হাজার মানুষের উপরে ধাপ-৩ এর পরীক্ষা পরিচালনা করছে।
এই লেখায় আমরা দেখাতে চেয়েছি, বর্তমানে ভ্যাকসিনগুলো কী অবস্থায় পরীক্ষার কোন ধাপে রয়েছে। আমাদের যেমন এখনই খুব বেশি আশাবাদী হয়ে যাওয়ার কারণ নেই যে এক-দুই মাসের মধ্যেই আমরা ভ্যাকসিন পেয়ে যাবো আবার একেবারে নিরাশ হওয়ারও দরকার নেই। কেননা বেশ কিছু ভ্যাকসিন বেশ সফলভাবেই তৃতীয় ধাপে চলে এসেছে। এটি শেষ হলেই তারা অনুমোদন পেয়ে যাবে। অর্থাৎ, সব ঠিকঠাক থাকলে বিজ্ঞানের বদৌলতে এ বছরের মধ্যে অথবা আগামী বছরের শুরুর দিকেই আমরা হয়তো করোনাভাইরাসের এক বা একাধিক কার্যকরী ভ্যাকসিন এর সুসংবাদ পেতে যাচ্ছি।
–নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভ্যাকসিন ট্র্যাকার অবলম্বনে
লেখক: গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট, স্কুল অব পাবলিক হেলথ, টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটি
করোনাভাইরাস করোনার ভ্যাকসিন কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ভ্যাকসিন উৎপাদন মহামারি