Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভ্লাদিমির পুতিন; অপ্রতিরোধ্য নেতা নাকি নতুন জার


২৮ জুলাই ২০২০ ১৮:২৯

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির (কমিটি ফর স্টেট সিকিউরিটি) একজন এজেন্ট ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। সোভিয়েত রাশিয়ার শেষ দিনগুলোতে পূর্ব জার্মানিতে সোভিয়েত কর্তৃত্ব বজায়ের জন্য তিনিই গোয়েন্দাগিরি করেছিলেন। অতঃপর কেজিবিতে থাকাকালীন সময়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন দেখেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ার নেতৃত্বশূন্যতা গভীরভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন কেজিবির এই এজেন্ট। এরপরই তিনি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন। নিজ শহর লেনিনগার্ড তথা সেন্টপিটার্সবার্গের তৎকালীন মেয়র আনাতোলি সোবচাকের হাত ধরে শুরু করেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।

বিজ্ঞাপন

গোয়েন্দাগিরির মতোই সেন্টপিটার্সবার্গ থেকে মস্কোর রাজনীতিতে আসেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই ধাপে ধাপে নিজের কব্জায় নিয়ে নেন। ১৯৯৯ সালে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিনের হাত ধরে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হন পুতিন। ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর হঠাৎ পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ইয়েলতসিন। সাংবিধানিকভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পুতিন। অতঃপর ২০০০ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করে পুরোপুরি প্রেসিডেন্ট বনে যান তিনি।

বিজ্ঞাপন

কেজিবির এজেন্ট থেকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট; এরপর শুরু হয় আধিপত্য বিস্তারের নীতি। এরপর থেকে আজ অবধি রাশিয়ার সর্বময় ক্ষমতাধর নেতা তিনিই। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে কখনও প্রেসিডেন্ট কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাশিয়ার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন।

২০০০ সালে প্রথমবার যখন পুতিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ছিলো চার বছর এবং সংবিধানের নিয়মানুসারে কোনো ব্যক্তি পরপর দুইবারের বেশি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচনে দাঁড়াতে পরতেন না। ফলে দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হতে সাংবিধানিক কোনো বাধার মুখোমুখি পুতিন হননি। প্রথম মেয়াদ শেষে অনায়াসে ২০০৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় প্রেসিডেন্ট হন পুতিন। দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয় ২০০৮ সালে। বিপত্তিটা ঠিক তখনই বাধে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষে পুনরায় লড়তে পারছেন না তিনি। ঠিক তখনই তিনি কৌশলী রাজনীতির প্রথম খেলাটা খেলেন। পুতিন তার রাজনৈতিক অনুগত দিমিত্রি মেদভেদেভকে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড় করালেন। আর তিনি হলেন মেদভেদেভের মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রী। মেদভেদেভ রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়েও ক্ষমতার বলয়ের শীর্ষবিন্দুতে ছিলেন পুতিন। এভাবে শেষ হল প্রধানমন্ত্রী পদে থেকে রাজনীতির কলকাঠি নাড়ানোর ৪ বছর। সময় এলো ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের। এবার আর পুতিনের প্রেসিডেন্ট পদে দাঁড়াতে কোনো সাংবিধানিক বাধা রইলো না।

অপরদিকে এতদিনে পুতিনের রাজনৈতিক পিরামিড তৈরি হয়ে গেছে। সুতরাং তিনি আবার প্রেসিডেন্ট। অবশ্য তার আগে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে কৌশলী রাজনীতির দ্বিতীয় খেলা খেলেন পুতিন। সংবিধান সংশোধন করে প্রেসিডেন্টের মেয়াদ ৪ বছর থেকে বাড়িয়ে করলেন ৬ বছর। অর্থাৎ পুনরায় দুই মেয়াদে টানা ১২ বছরের জন্য রাশিয়ার সর্বোচ্চ কর্ণধার। ২০১২ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তৃতীয় মেয়াদ শেষ হলে ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয় লাভের মাধ্যমে পুতিন চতুর্থবার (২০১২ সাল হতে টানা দ্বিতীয়বার) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন। তার মেয়াদ শেষ হবে ২০২৪ সালে।

তীক্ষ্ণ ও সুদূরপ্রসারী বুদ্ধিসম্পন্ন এই রাজনীতিবিদ ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট মেয়াদ শেষ হবার আগেই কৌশলী রাজনীতির তৃতীয় খেলাটা খেললেন। যেহেতু দেশটির বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী এর পর তিনি প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচন করতে পারতেন না, ফলে ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে তিনি সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় সংবিধান সংশোধনের ওপর সাতদিন ব্যাপী রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছে গণভোট যা শেষ হয়েছে চলতি মাসেই।

দেশটির নির্বাচন কমিশন ঘোষিত ফলাফলে দেখা গেছে, ৭৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ ভোটার সংবিধান সংশোধনের পক্ষে এবং ২১ দশমিক ২৬ শতাংশ বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। মোট ভোটার উপস্থিত ছিলো ৬৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ। গত ৩ জুলাই সংশোধিত সংবিধানে স্বাক্ষর করেন পুতিন এবং ৪ জুলাই হতে সংশোধিত নতুন সংবিধান কার্যকর হয় (রয়টার্স)। ভোটে সংবিধান সংশোধনের ওপর রায় আসায়, পুতিন আরও দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বৈধতা পাচ্ছেন। অর্থাৎ ২০২৪ সালের পর আবারও নির্বাচনে জয়লাভ করলে আরও ১২ বছর (২০৩৬ সাল পর্যন্ত) প্রেসিডেন্ট পদে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন তিনি। মোটকথা আজীবন প্রেসিডেন্ট পদে থাকার পথ সুগম হলো পুতিনের।

পুতিন যেভাবে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছেন
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর রাশিয়া নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে। কেজিবি এজেন্ট পুতিন বিষয়টি খুব ভালোভাবে ঠাহর করতে পেরেছিলো। এ কারণে তিনি ২০০০ সালে ক্ষমতায় আরোহণের পর অভ্যন্তরীনভাবে রাশিয়াকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রক্রিয়া হাতে নেন। এটি করতে গিয়ে তিনি খুব দ্রুত গণমাধ্যমকে নিজের আওতায় নিয়ে আসেন। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউজের তথ্য অনুসারে, রাশিয়ার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা একেবারে তলানিতে। নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম পুতিনকে রাশিয়ার রাজনীতিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে।

দ্বিতীয়ত, রাজতন্ত্রে পরিচালিত রুশ সাম্রাজ্যের মানচিত্র ছিলো গোটা বিশ্বব্যাপী। তিনটি মহাদেশ (ইউরেশিয়া, উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো রুশ সাম্রাজ্য। আধিপত্য বিস্তার আর রাজ্য দখলই ছিলো রুশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস। রুশরা মনে করেন, রাশিয়ার পুরনো সাম্রাজ্য ও প্রতিপত্তি পুনরুদ্ধারের নায়ক হলেন পুতিন। তিনি রুশদের মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিয়েছেন, রুশ জাতীয়তাবাদ চেতনাকে নতুনভাবে জাগ্রত করেছেন ( নিউস্টেটসম্যান সাময়িকী)। ২০১৪ সালে রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার সংযোগ রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী চেতনাকে আরও উসকে দেয় এবং পুতিন হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য।

তৃতীয়ত, পুতিন কেবল দেশকে অভ্যন্তরীণভাবে ঐক্যবদ্ধ করেই ক্ষান্ত হননি বরং রাশিয়াকে বিশ্ব রাজনীতিতে সম্মানজনক চেয়ার এনে দিয়েছেন। তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেননি। এক্ষেত্রে সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও বহির্বিশ্বের সাথে টেক্কা দিয়ে রাশিয়ার অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষা খাতকে পূর্ণগঠন করেছেন পুতিন। সেই সাথে ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টি পুতিনকে বিশ্ব নেতৃত্বেও সামনের কাতারে নিয়ে আসে।

পুতিন কি রাশিয়ার নয়া জার
রাশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে জার শব্দটির ব্যবহার নতুন নয়। জার হচ্ছে অত্যন্ত ক্ষমতাশালী রাজাদের উপাধি। রাশিয়ায় জার শাসনের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন তৃতীয় ইভান যিনি ১৫৪৭ সালে নিজেকে জার হিসেবে ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের মাধ্যমে জার শাসকের পতন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক শাসনের গোড়াপত্তন হয়েছিলো। অনেকে পুতিনের শাসনব্যবস্থাকে জার শাসনের পুনরাবৃত্তি হিসেবেই দেখতে চাইছেন। পুতিনের সাংবিধানিক সংশোধনকে কেন্দ্র করে সারাবিশ্বের শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলো নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে, পুতিন কি তবে রাশিয়ার নয়া জার?

এ প্রশ্নটির উত্তর জানতে হলে, রাশিয়ার জার রাজাদের শাসনব্যবস্থা ও পুতিনের শাসনব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনা দাঁড় করানো জরুরী। রুশ সাম্রাজ্যের জার শাসকগণ সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রতি অনেক বেশী মনোযোগী ছিলেন। এক এক জারের শাসনামলে রুশ সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি ছিলো এক এক রকম। কখনও বা সামরিক সুব্যবস্থাপনা, সাম্রাজ্য বিস্তার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে জার শাসকেরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছিলো, কখনও আবার যুদ্ধ, হানাহানি, অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও অনৈতিকতার কারণে জার শাসকের পতন ঘটেছে।

অপরদিকে পুতিন ২০০০ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি রুশ জাতীয়তাবাদী নীতির পুনর্জন্ম ঘটানোর সাথে সাথে অত্যন্ত সুকৌশলে যেটি করেছেন তা হলো তার ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য সংবিধান সংশোধন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কৌশলী রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছেন। পুতিন রাশিয়ার শাসনব্যবস্থায় এক ধরনের পিরামিড তৈরি করেছেন যেখানে রাষ্ট্রের আইন শাসন ও বিচার বিভাগ পুতিনের নির্দেশনার বাইরে নয়। রাজনীতিতে ক্ষমতা বৈধকরণে পুতিন বরাবরই রাষ্ট্রের কাঠামো, আইন ও সংবিধানকে নিজের ইচ্ছার আদলে সাজিয়েছেন। ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করণে তার নেওয়া পদক্ষেপসমূহ ছিলো গণতন্ত্রের মোড়কে ঢাকা। রাশিয়ার জনগণ আপাতদৃষ্টিতে এটিকে প্রশ্নের আওতায় আনতে পারেনি কিংবা প্রশ্নের আওতায় আনার আগেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে।

বর্তমানে করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্ব যখন প্রায় টালমাটাল, দিন দিন যখন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে তখনও থেমে নেই পুতিনের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার অভিলাষ। করোনাকালীন সংকটের মধ্যেই পুতিন তার দেশে আয়োজন করেছেন সংবিধান সংশোধনের ওপর গণভোট। গণভোটের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে পুতিন পুনরায় দেশ শাসনের সুযোগকে বৈধ করে নিয়েছেন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, রুশ সাম্রাজ্যের জার শাসক ও আধুনিক রাশিয়ার শাসক পুতিনের রাজনৈতিক কলাকৌশলে যথেষ্ট ভিন্নতা রয়েছে। এক্ষেত্রে পুতিনকে নয়া জার বলা যায় কি না সে প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। তবে যুগোপযোগী ভিন্ন রাজনৈতিক সুকৌশলই পুতিনকে আধুনিক রাশিয়ার অপ্রতিরোধ্য শাসক হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে। তাই পুতিনকে নয়া জার না বলা হলেও, রাশিয়ার কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির নব্য রূপকার বলা যেতেই পারে।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর