Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু কি কারো কোনো ক্ষতি করেছিলেন!


৩ আগস্ট ২০২০ ১২:০০

গিন্নিসহ বেরিয়েছি, শহরেই। কিছুটা কাজে কিছুটা কাজহীন সময় ব্যায়েরও উদ্দেশ্য। জানুয়ারি মাস, ‘করোনা’র যা কিছু করার তা তখন কেবল শুরু করেছে সুদূর চীনে, এদেশে আমরা তখন চীনাদের সাপ-ব্যাঙ-বাদুড় খাওয়ার নানান কাণ্ডকারখানা নিয়ে মজা করা আর মজা পাওয়ায় ব্যস্ত। আপদ কিংবা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখার প্রশ্ন সুদূর পরাহত। কাজেই নিরাপদেই রিকশা ভ্রমণে প্রিয়জনের গায়ে গা মিলিয়ে কাছাকাছি থাকবার সুযোগ হেলায় হারাতে চাইনি। বেশ দ্রুতই প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিক কাজ শেষ হয়ে গেল, তাই তিন চাকার যানে চালক ও চালিত তিন মানব-মানবীর নিশ্চিন্ত যাত্রা। কি যেন একটা ভালো লাগা ভাবও কাজ করছিলো মনে, পরিচিত শহরেই চারপাশ রসিয়ে রসিয়ে দেখছি।

হঠাৎই গিন্নির নির্দেশে রিকশা থামলো, চেহারায় অবাক আর বোকাভাব নিয়ে তাকাতেই গিন্নির দ্বিতীয় নির্দেশ ‘নামো’। বলে নিজেই রওনা দিল। দ্রুত রিকশাভাড়া মিটিয়ে মহাজনের পথ অনুসরণ (মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করেছেন গমন…)। এক অপ্রশস্ত গলির অল্প ভিতরে অতি ছোট একটি ঘরে গিন্নি নক করতেই একজন বয়স্ক (আমার থেকে বয়সে কিছুটা বেশি) ভদ্রলোক দরজা খুলে প্রবেশের আমন্ত্রণ জানালেন। অনুসরণ করে (উপায় নাই গোলাম হোসেন), বসলাম। ঘরটা তেমন বড় না। চারপাশ দেখতে দেখতেই সামান্য দ্বিমুখী আলোচনায় বুঝে গেলাম এই বয়স্ক ভদ্রলোক জ্যোতিষী এবং গিন্নি মাঝেমধ্যেই তাকে হাত দেখান। হাত দেখাদেখিতে আজন্ম মেয়েদের যতটা আগ্রহ এবং ‘দুঃখজনকভাবে’ আমার ততটাই উল্টো। গিন্নি আর জ্যোতিষী দুজন আলাপ করছে নানান বিষয়ে।

যাক বাবা আমি অন্ততঃ এখানে গিনিপিগ হচ্ছি না ভেবে যেই আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিতে যাচ্ছি অমনি নির্দেশ, ‘তোমার ডান হাতটা ওনাকে দাও তো’। মানে কি? মহাভারতে পড়েছি একলব্য তার গুরুকে আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলো, আমার কি এখানে ডান হাতটা কেটে দিতে হবে? প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে একবার গিন্নির দিকে একবার প্যান্ট শার্ট পরা আধুনিক জ্যোতিষী বাবার দিকে তাকাতেই গিন্নি, ‘ডান হাতটা ওনাকে দেখাও’। আমি নিজে একবার ভালো করে দেখে নিলাম নিজের হাতটাকেই (নাহ্, কোনও পরিবর্তন হয়নি তো, আগের মতোই আছে) তারপর বাড়িয়ে দিলাম ধীরে ধীরে। জ্যোতিষী টানছেন, কাত করছেন, ঘষছেন, ঘুরাচ্ছেন, আতস কাঁচ দিয়ে দেখছেন আর নানান কথা শুধাচ্ছেন। আমি ‘হুম’, ‘না’, ‘উঁহু’ এসব শব্দ দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। শুনছি সব কথাই, বেশ তো, মন্দ লাগছে না। গিন্নির সামনে দু’চারটে প্রশংসা কার না ভালো লাগে। মিনিট তিন-চার হচ্ছে নানান রঙের কথা বলে চলেছেন। হঠাৎই একটু থামলেন। আতস কাঁচটা আরও একটু গভীরভাবে একটা স্থানে স্থির করলেন। বাহ্, বেশ পেশাদার জ্যোতিষ বটে। ক্যামেরার ভাষায় আতস কাঁচটিকে জুম করে, জুমব্যাক করে, টিল-আপ, টিল-ডাউন করে দেখছেন। চোখ সরিয়ে গিন্নির দিকে নজর বুলিয়ে তার আগ্রহের বর্ধিষ্ণু গতি লক্ষ্য করলাম। জ্যোতিষীও এমন স্থির দৃষ্টিতে আতস কাঁচের ভিতরে তাকিয়ে আছেন, তার চোখে সূর্যের আলো আর তাপ থাকলে এতক্ষণ হাত আগুনে পুড়ে ছাই। দৃষ্টি স্থির রেখে কিন্তু মনোযোগ কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে জ্যোতিষ এবার ছোট্ট করে একটু কাশলেন।

আচ্ছা, আপনার শত্রু আছে কেমন?
থতমত খেয়ে উপস্থিত দুজনের দিকেই তাকালাম। হঠাৎ এ আবার কি প্রসঙ্গ। একেবারে ‘শত্রু’! কি বলবো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। আমতা আমতা করে বললাম, না-আ। শত্রু-উ মানে শত্রু কেন থাকবে, কারো সাথে ঝগড়া করি না বা করার প্রয়োজনও হয় না, আমি তো কারো ক্ষতি করি না কখনো। শত্রু কেন তৈরী হবে?
বঙ্গবন্ধু কি কারো কোন ক্ষতি করেছিলেন?
কথাটা বলেই আতস কাঁচে জোতিষীর চোখের দৃষ্টি আরও গভীর হল, মনোযোগের চিহ্নস্বরূপ কপালে আবার একটু ভাঁজ পড়ল। তারপর আমার চোখে চোখ স্থির করে বললো, ‘আপনার জীবনে একটা অপঘাতের চিহ্ন আছে। আপনার বলয়ের কেউ, কাছেরই কেউ আপনার জীবনের উপর বড় হুমকি তৈরি করতে পারে। তাই বলতেছি কি বাকি জীবনে একটু বেশি সচেতন থাকবেন প্লিজ। চারপাশে সবাইকেই সম্পূর্ণ বিশ্বাস করবেন না।’

গিন্নির চোখে মুখে শঙ্কা ছেয়ে যাচ্ছে, এখুনি যেন খারাপ কিছু ঘটে যাবে আমার জীবনে। জ্যোতিষ ভদ্রলোক শান্তভাবে নানান কথা বলেই যাচ্ছেন আমার দিকে চেয়ে, আমিও মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছি তারই দিকে কিন্তু কানে যাচ্ছে না কিছুই। মস্তিষ্কজুড়ে গড়ে ওঠা সমস্ত ভাবনাগুলো জ্যোতিষীর বলা ঐ শব্দগুচ্ছ নিয়ে বারবার জিগ্স পাজল খেলছে। ‘অর্থাৎ কিনা, আমার অপঘাতে মৃত্যুও হতে পারে। এবং অতি ঘনিষ্ঠজনদের কেউই আমাকে…’ কথাগুলো কেন বললেন তিনি? কেন? মস্তিষ্কে নিউরনদের তীব্রগতিতে ছোটাছুটি টের পাচ্ছি। খুঁজছে, কার্যকারণ খুঁজছে…

হঠাৎই মনে হলে জ্যোতিষীর শেষ কথাটা ‘বঙ্গবন্ধু কি কারো কোনো ক্ষতি করেছিলেন?’
সত্যিই তো। আমাদের জাতির পিতা আমাদের বঙ্গবন্ধু, একটা স্বাধীন দেশ দিলেন যিনি, উনি সারাজীবনে কারোরই কোন ধরনের ক্ষতি তো করেনইনি বরং নিজের জীবন-যৌবন-সংসার সব কিছুকে মৃত্যুর হাতে সঁপে দিয়ে শুধুই আমাদের কথা ভেবেছেন আর কেবলই কষ্ট পেয়েছেন। খন্দকার মুশতাক, মেজর ডালিমসহ পিশাচগুলো (নামগুলো উচ্চারণ করতেও ঘৃনা হয়)- এদেরকে তো বঙ্গবন্ধু তাদের যোগ্যতার চেয়েও অনেক কাছে আপন জায়গায় স্থান দিয়েছিলেন। অনেক ছবিতে দেখেছি, নানান পত্রিকায় পড়েছি মুশতাককে তিনি প্রায় সময়ই পাশে পাশে রাখতেন। এই মুশতাক খুনি মেজর ডালিমসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর বাসায় পর্যন্ত নিয়মিত পরমাত্মীয়ের মতো গিয়েছে, তার ভালোবাসা আদর গ্রহন করেছে জাতির পিতার, বঙ্গমাতার অতি আপন প্রিয়জন আর প্রিয় সন্তানদের মতই। বঙ্গবন্ধুর বাৎসল্য- স্নেহ এই খুনিরাও পেয়েছে। এমনকি পিতা নানা অপরাধের পরও সামান্য তিরস্কারও কখনো করেননি কাউকে। আগলে রেখেছেন বরং। তার বিনিময় এতো নির্মম, জঘণ্য প্রতিদান!

৭৫এর ১৫ই আগস্টে খুনি পিশাচগুলি তার পরিবারের সদস্যদের নির্দয়ভাবে হত্যা করার পরেও জাতির পিতা বলেই মৃত্যুর আগে অধিকারবোধে, বাৎসল্যে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘কি চাস তোরা?’ আর তার উত্তর খুনির নির্দয় ব্রাশফায়ার!
মেজর জিয়া। বঙ্গবন্ধুর বাসায় সপরিবারে কতবার গিয়েছেন, কি ভালোবেসেছিলেন তাকে বঙ্গবন্ধু! যোগ্যতম না হওয়ার পরও এই সেনাকর্মকর্তাকে সম্মানিত করেছেন, উচ্চপদে বসিয়েছিলেন। অথচ সেই জিয়া এবং তার স্ত্রী খুনিদের সঙ্গে নিয়ে কি নোংরা খেলাটাই না খেললেন। উপকারীর প্রতিদান বোধহয় এই হয়!

রাতে বাসায় ফিরে মনে হলো, জ্যোতিষীর আশঙ্কার কারণ মেলাতে পেরেছি। আমার জন্মতারিখ ১৭ই মার্চ। একই দিনে জন্ম, বাঙ্গালি জাতির মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুরও। জ্যোতিষী কি সেখান থেকে মিলিয়ে কিছু বলতে চাইছেন! যেহেতু জাতির পিতাকে মেরেছে তার বিশ্বাসী কাছের মানুষগুলোই। হায় রে, জন্ম তারিখ এক বলে এ কি তুলনা! কোথায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম একজন আর কোথায় আমি অবশিষ্ট ৭০০ কোটির মধ্যে এক।

ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় একবারই গিয়েছিলাম, দ্বিতীয়বার যাবার কষ্ট সইবার মতো সাহস আমার হয়নি কখনো। জাতির পিতার জন্মতারিখে জন্ম নেওয়া এই আমি আর এক পৃথিবীসম সাহসী অথচ কোমলতম বুকের পাটা এক জিনিস নয়। একই ১৭ই মার্চে জন্ম নিয়েছি বলে জ্যোতিষীর কাছে কিংবা স্ত্রীর কাছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুর মতো মৃত্যুর আশঙ্কাটাই কত গুরুত্বপূর্ণ। আর ভেতরে ভেতরে কতো ছোট হয়ে যাচ্ছি আমি, টের পাচ্ছি কত শূণ্য, কত ব্যর্থ আমি। জন্মতারিখ মিলের সাথে তাঁর অসম সাহসী ব্যক্তিত্ব, দুনিয়া কাঁপানো নেতৃত্ব, কোমল আর স্পর্শকাতর হৃদয়, অটবীর মতো আশ্রয়, হিমালয়সম উচ্চতা, মহান পিতৃত্ব কিছুই ধারণ করতে পারিনি নিজ জীবনে। নীলকন্ঠ হয়ে সমস্ত গরল নিজ বক্ষে ধারন করে জাতিকে যিনি দিতে পারেন অমৃত- এমনি শত মানবিক গুণের ছিটেফোঁটাও কি ধারণ করতে পেরেছি নিজের মধ্যে! না; পারি নি। কেবল জন্মতারিখ মিলের অহংকারে ধিক!

আমার অপঘাতে হবু মৃত্যুর সম্ভাবনার সাথে আর এক দেবোপম পুরুষের মৃত্যুর সাথে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা সেই মহাপুরুষকে ছোট করা, যে যোগ্যতা আমাদের কারোরই নেই। বরং আমার অপরাধী মন আমাকে প্রতিনিয়ত ধিক্কার দিচ্ছে, ‘তুই-ই হত্যা করেছিস তাকে তার উপকারের প্রতিদানে’। এই আফসোস এই ধিক্কার গোটা জাতির আত্মকথনে নিয়তই বাজে। হঠাৎই সম্বিত ফিরে পাই কানে আসা জোতিষীর হাসিমাখা স্তুতিবাক্যে, ‘তবে আপনার ভাগ্যটা দারুণ ভালো, এ রকম একজন মহাপুরুষের জন্মতিথিতে আপনার জন্ম’।

বেশ তো, না হয় ১৫ আগষ্টের কষ্টগুলো বুকে নিয়ে বাকি জীবন অন্ততঃ ১৭ই মার্চ-এর গর্বটুকু নিয়ে বেঁচে থাকি। ব্যর্থ মানুষের জীবনে এই তো অনেক বড় প্রাপ্তি।

১৫ আগস্ট ১৭ মার্চ জ্যোতিষ পঙ্কজ বণিক বঙ্গবন্ধু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর