Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ত্রিপুরায় বাম শক্তির পতন ও আমাদের কাগুজে বাম সংকট


৮ মার্চ ২০১৮ ১৭:২২

ত্রিপুরায় বাম দূর্গের পতন হয়েছে। রাজ্যটিতে দীর্ঘ ২৫ বছরের ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) সিপিএম শাসনের ইতি ঘটিয়ে গদিতে বসেছে বিজেপি জোট। পশ্চিমবঙ্গের পর ত্রিপুরা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় এখন কেবলমাত্র কেরালাতেই শাসনক্ষমতায় আছে বামশক্তি। যে ভারতবর্ষ একসময় বামপন্থী রাজনীতি বিকাশের অন্যতম সূতিকাগার ছিলো সেখানেই বামরাজনীতির সূর্য আজ অস্তমিত প্রায়। তবে এটাও স্বীকার করতে হবে যে নব্বই দশকের পর থেকে সারাবিশ্বে যখন পুঁজিবাদী শাসকগোষ্ঠীর জয়জয়কার চলছে সে সময়ে টানা ২৫ বছর একটি রাজ্যে ক্ষমতায় থাকাটাও চাট্টিখানি কথা নয়। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের পতনের সাথে সাথে অনেকেই ত্রিপুরাতেও বামদের পতন অবশ্যম্ভাবী মনে করেছিলেন। কিন্তু তারপরও আরো দুই মেয়াদে ত্রিপুরায় সরকার চালিয়েছে সিপিএম।

বিজ্ঞাপন

ত্রিপুরা কিংবা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের তথা বামপন্থীদের এমন সফলতার মূল্য রহস্য কি ছিলো? একই সাথে অবধারিত ভাবে আরেকটি প্রশ্ন এসে যায়। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দুইটি ভারতীয় অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় দীর্ঘ সময় ধরে বামশক্তির ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও কেন বাংলাদেশে বামদলগুলো কোন প্রভাব বলয় তৈরি করতে পারলো না? কেন সময়ের সাথে সাথে তারা ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে এখন অনেকটাই কাগুজে দল ও সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

উপরের প্রশ্নের হয়তো একেকজনের কাছে একেক রকম। তবে আমার কাছে মূল কারণ হলো উদাহরণ হয়ে উঠার মতো যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব। পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মতো ক্যারিশমাটিক নেতা ছিলেন। ত্রিপুরায় আছেন মানিক সরকার। উনারা শুধু তাত্ত্বিক কথাবার্তাতেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না বরং সেই আদর্শগুলো নিজেরা ধারন করে নিজেদেরকে উদাহরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

সময়ের পরিক্রমায় হয়তো তাদের ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়েছে, কিন্তু একজন সত্যিকারের বামনেতা হিসেবে উনাদের আপোষহীন চরিত্র উনারা ধরে রেখেছিলেন। আর এখানেই উনাদের সাথে বাংলাদেশের বামদলগুলোর নেতাদের পার্থক্য। মূলত আমাদের দেশে তেমন কোন আইকনিক বাম নেতাই তৈরি হয়নি এবং যারা ছিলেন তারাও মুখে যতোই আদর্শবাদী কথা বলুন না কেন, নিজেদের জীবনেই তা ধারন করতে পারেন নি।

সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে মানিক সরকারের জীবনাচারের কথাই ধরা যাক। দীর্ঘ দুই দশক ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এবারের বিধানসভা নির্বাচনের আগে যখন মনোনয়ন পত্র জমা দিলেন সেখানে দেখা গেল উনার ব্যাংকে আছে সাকুল্যে আড়াই হাজার টাকার মতো, নগদ ছিলো হাজার দেড়েক টাকা। শুনতে অবিশ্বাস্য হলেও এটিই সত্য। এমনকি এটি যে সত্য তা মানিকসরকারের ঘোরতর বিরোধীরাও স্বীকার করেন। এতোটাই সাধারণ জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন মানিক সরকার। তাইতো নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা বিপ্লব কুমার নির্বাচিত হবার পর প্রথমেই মানিক সরকারের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিয়ে এসেছেন। আপাত উগ্রপন্থী দল হিসেবে পরিচিত বিজেপির একজন নেতার কাছ থেকেও এমন সম্মান পাওয়াটা সহজ ব্যাপার না।

এতোটুকুতেই অবাক হয়ে গিয়েছেন? আশ্চর্য হবার মতো তথ্য দেয়ার তো এখনো বাকি। আগামীকাল নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিবেন বিপ্লব কুমার। তার আগেই মানিক সরকার ও পাঞ্চলি ভট্টাচার্য্য দম্পতি ছেড়ে যাবেন দীর্ঘদিনের আবাসস্থল মুখ্যমন্ত্রীর বাংলো। কোথায় উঠবেন জানেন? সিপিএম পার্টি অফিসের গেস্ট হাউজে।  কেননা দীর্ঘ বিশ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকা মানিক সরকারের নিজের কোন বাড়ি নেই। উনার বাবার যে ভিটে ছিলো তা অনেক আগেই পার্টির জন্য দান করে দিয়েছেন। আপাতত তাই বাস্তুহারা সদ্য সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার। বাধ্য হয়েই নিজের সম্পদ হিসেবে থাকা কিছু বই নিয়ে আপাতত পার্টি অফিসেই মাথা গুঁজবেন তিনি। মানিক সরকারের স্ত্রী পাঞ্চলি ভট্টাচার্য্য জীবনে কখনো সরকারি গাড়ি ব্যবহার করেন নি।  নেননি পাইক পেয়াদার বহর। রিকশায় চড়ে নিজে বাজার করতেন, নিজেই ঘর গৃহস্থালী সামলাতেন, সামাজিক সংগঠনে সময় দিতেন।

অর্থাৎ মানিক সরকারের মতো বাম নেতারা আদর্শের কথা, সাম্যের কথা শুধু মুখে বলেন নি। দৈনন্দিন নিত্য জীবনাচারে সেই আদর্শের রুপায়ন ঘটিয়েছিলেন। আর এভাবেই তারা মানুষজনের মনে বিশ্বাস তৈরি করতে পেরেছিলেন, আস্থাশীল হতে পেরেছিলেন। মানুষজন তাই দীর্ঘ সময় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না পেলেও ভরসা করে সিপিএমকে ভোট দিয়েছে। সিপিএম নেতাদের উপর সাধারণ জনগনের এই বিশ্বাসটা অন্তত ছিলো যে, তারা মুখে যা বলে মনেও তাই ধারন করেন। আর এখানেই মার খেয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের বাম নেতারা।

বাংলাদেশের বামদলগুলোর অধিকাংশ নেতাদের মুখের কথা এবং মনের কথার বিস্তর ফারাক। মজার ব্যাপার হলো এই ফারাক তাদের কর্মকান্ডে এতোটাই দৃশ্যমান যে, উনাদের মুখের আদর্শের কথা এখন আর তাই মানুষের মনে কোন ধরনের প্রভাব ফেলে না। উনারা যে সাম্যের কথা বলেন, যে শ্রেণীসংগ্রামের কথা বলেন সেটা তারা নিজেরাই ধারন করেন না, পালন করেন না। যে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম সেই পুঁজিবাদের ধারক বাহকদের সাথেই তাদের দহরম মহরম সম্পর্ক। এদেশের শীর্ষ বামনেতাদের অনেকেই এসি গাড়ি ছাড়া চলতে পারেন না, বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত। তাদের ভাষায় পুঁজিবাদের ধারক কর্পোরেট বেনিয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর সুযোগ সুবিধা নিতেও তাদের কখনো পিছপা হতে দেখা যায়না। পশ্চিমা দূতাবাসগুলোতে তো তাদের হরদম যাতায়াত। সুযোগ পেলে ঘুরে আসেন ‘চিরশত্রু’ স্যাম চাচার দেশ মার্কিন মুল্লুকেও।

সেই সাথে আছে তাদের নিজেদের দ্বিধাবিভক্তি। কেউ রাশিয়াপন্থী তো কেউ চীনপন্থী। ভারতের সিপিএমের দলীয় কোন্দলে এদেশের বামদলের বিভক্ত হয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে। ক্রমাগত ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে তারা এখন নিজেরাই বিলীন হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে আছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে বামদলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও বর্তমানে তাই একটা বামসংগঠনেরও দেশের তৃণমূল পর্যন্ত সাংগঠনিক ভিত্তি নেই।

কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। এদেশের বামনেতারা মনে হয় এই লাইনটির  সাথে পরিচিত নন। তারা নিজেরা যা বলেন তা করেন না, যা করেন তা আবার বলেন না।  আফসোসের কথা হলো এদেশের বাম নেতারা কেউ মার্ক্সপন্থী হয়েছেন, কেউবা লেনিনপন্থী, কিন্তু তাদের কেউই বাংলাদেশপন্থী হননি। এদেশের মাটি মানুষের কথা ভেবে, এদেশের জনগণের প্রয়োজন মতো তাদের রাজনীতি করতে পারেননি। আর পারেননি বলেই তারা জনবিচ্ছিন্ন। একথা তারা হয়তো প্রকাশ্যে স্বীকার করেন না, কিন্তু বোধকরি সত্যটা তারা নিজেরাও জানেন। অন্ধ হলেই তো আর প্রলয় নাচন বন্ধ হয় না।

  • আমিনুল হক পলাশ, সাবেক ছাত্রনেতা

সারাবাংলা/এসবি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর