প্রিয়ভাষিণীর স্মৃতি থেকে: গাছের গুঁড়িতে পান নারীর অবয়ব শিশুর মুখ
৯ মার্চ ২০১৮ ১২:৩৩
আতিকা রোমা, ফ্রিল্যান্স রাইটার
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে খচিত এক নাম। একজন আপাদমস্তক সৃজনশীল ও রুচিশীল মানুষ, একজন অনন্য সাধারণ শিল্পী। যাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। কিন্তু এই শিল্পী স্বত্বা বা একজন মুক্তিযোদ্ধার পরিচয়ের বাইরেও যে মানুষটি, তার ছিটেফোঁটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আজ তার প্রয়াণে সেসব টুকরো স্মৃতির কিছু কিছু লিখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পন করতে চাই। তবে তাঁর জন্য এই প্রয়াসটুকু তিনি জানতে পারলে ভীষণ আনন্দিত হতেন।
আমার সাথে ওনার পরিচয় আমার আপা নিশাত জাহান রানার মাধ্যমে। আপা এবং উনি খুব কম করে হলেও ৩৫ বছরের বন্ধু, ঘনিষ্টজন। আপার বন্ধু হওয়া স্বত্বেও আমি ওনাকে আপা না বলে খালা বলেই ডেকেছি। ওনাকে প্রথম দেখায় ঠিক বোন মনে হয়নি, অনেকেরই তা হয় না, সে জন্য অনেকেই ওনাকে মা বা আম্মা বলেও ডাকেন। আমি মা না বলে খালা বলে ডেকেছি।
সেই প্রথম থেকেই উনি আমাকে খুব কাছে টেনে নিয়েছিলেন। এটার অন্যতম কারণ হতে পারে আপার প্রতি ওনার গভীর ভালোবাসা ও আস্থা। আপা যেহেতু আমাকে খুব স্নেহ করেন, তাই উনিও সেই একই আচরণ করেছেন। তাছাড়া স্বভাবগত ভাবেই উনি মানুষকে ভালোবাসতেন, তাই সেই ভালোবাসার ভাগ আমিও পেয়েছিলাম ওনার কাছ থেকে।
আমি স্কুটি চালাই গত প্রায় দশ বছর ধরে। উনি খুব খুশী হতেন আমার স্বাধীন ভাবে চলাফেরা দেখে। কিন্তু কয়েক দফা এক্সিডেন্ট করায় এরপর আর ভালভাবে স্কুটি চালানটা নিতে পারতেন না। “স্কুটি” শব্দটি আমার জীবনে দু’জন মানুষ কোনদিনই ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারলেন না। একজন আমার মা, যিনি বলেন সাইকেল আর একজন ফেরদৌসী খালা। উনি বলতেন ফ্রুটি। এই ফ্রুটি চালানো নিয়ে তার আপত্তি আমার প্রতি গভীর ভালোবাসার যায়গা থেকেই।
যখন ধানমন্ডিতে থাকতেন, আপাও সেসময় ধানমন্ডিতে থাকতেন। আপার বাসায় রাতে স্কুটি রাখা যেত না, সে জন্য ফেরদৌসী খালার বাসায় রাখতাম। একদিন খেয়াল করলাম তার বাড়ির উঠনে স্কুটি থাকলে টেনশনেই উনি সারা রাত ঘুমান না। একটা মাছিরও উপায় নেই স্কুটিতে এসে বসবে। উনি সারাক্ষণ সজাগ। তাই একদিন রাগ করে বলেছিলাম, আর আপনার বাসায় স্কুটি রাখব না, আপনি ঘুমান না, এটা ঠিক না।
কত কত সন্ধ্যায় আপা, আমি, ফেরদৌসী খালা এবং বিয়ার খালু ওনার বাসার বারান্দায় মুড়ি মাখা আর আদা চা খেতে খেতে আড্ডা দিয়েছি। আমার ভূমিকা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়া শ্রোতারই ছিল। মূল বক্তা ফেরদৌসী খালা, সাথে আপা এবং বিয়ার খালু। আমি শুধু মাঝে মাঝে একাধিকবার শোনা কয়েকটি গল্প শোনার অনুরোধ জানাতাম এবং তিনি প্রচণ্ড উৎসাহে সেই গল্পগুলি আবার বলতেন। যতবারই শুনতাম মনে হত নতুন করে শুনছি, সে এক অন্যরকম মুগ্ধতা। গল্পগুলো শুধু ঘটনার বর্ণনা নয়, সাথে বাড়তি প্রাপ্তি ছিল ঘটনা অনুযায়ী এক্সপ্রেশন। আমার খুব পছন্দের একটি গল্প যা আমি ওনার কাছ থেকে অনেকবার শুনেছি তা বলছি-
১৯৭১ সাল পরবর্তী সময়। রাজেশ্বরী দি তখন বেশ ছোট। খালা, খালু, ওনাদের তিন ছেলে তিতাস ভাই, তাপস ভাই, তূর্য ভাই এবং রাজেশ্বরী দি-কে নিয়ে ওনারা সিলেট অঞ্চলের দিকে বেড়াতে গেছেন। খালু তখন সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি এক গেস্ট হাউজে ওনাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। খালু বেশ আনন্দিত থাকার ব্যবস্থা দেখে এবং গেস্ট হাউজ সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল কথা বলে ফেলেছেন খালাকে। দুপুরের রান্নার কাজ চলছে রান্নাঘরে। কিন্তু খাবার তৈরি হতে বেশ কিছুটা সময় লাগবে। এর মধ্যে হালকা খাবারের ব্যবস্থা হচ্ছে, খালু জানিয়েছেন। হালকা খাবার এলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। খাবার হিসেবে যা এলো তার একটা দারুণ বর্ণনা খালা দিতেন এবং বর্ণনার সময়টুকুতে ওনার উচ্ছ্বাসটুকু আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করত। ঘটনা হল বিশাল বড় একটা প্লেটে পাহাড়ের মত উঁচু করে এক প্লেট টোস্ট বিস্কুট এবং প্লেটের দুই পাশে ৪টি কাঁটা চামচ। সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে সাহেবি কায়দায় নাস্তা পরিবেশন। এই ঘটনা যতবার শুনেছি, সবাই হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিয়েছি এবং ততবারই বিয়ার খালুর চেহারাটা দেখার মত হত। উনি একটু লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে হাসতেন।
আপা ধানমন্ডিতে থাকার সময় আমি যখনই ধানমন্ডির বাসায় থাকতাম, স্কুটি রাখতে বা এমনিতেই শুধু আড্ডা দেয়ার জন্য আপার সাথে ফেরদৌসী খালার বাসায় যেতাম। একবার ঐ বাসায় পৌঁছানোর পরই কি যেন হল, শুনলাম আমি, আপা আর ফেরদৌসী খালা বাইরে যাচ্ছি। আপার গাড়ি ততোক্ষণে চলে গেছে। তাই বেশ অনেকটা রাতেই একটা সিএনজি নিয়ে আমরা রওনা হলাম। প্রথমে শাহবাগে গিয়ে চা খেলাম। তারপর নিউমার্কেটে গেলাম, সম্ভবত আপার কিছু একটা কেনার ছিল। আমি আর ফেরদৌসী খালা এক সাথে থাকলেই রাজ্যের পচা খাবার খুব আগ্রহ করে খেতাম। তো আপা কিছু একটা কেনার জন্য দোকানে ঢুকেছেন, এর মধ্যে উনি ভুনা আলুর মাখা দেখে বললেন “খাবি”? বললাম আপা বকা দিতে পারে আর খাবারটা তেমন সুবিধার মনে হচ্ছে না। বলল, আচ্ছা রানা আসুক, ওকে বলেই খাব। তখন খাবিতো? বললাম “হু”। আপা আসলেন, তাঁকে জানান হল সেই ভয়াবহ রকমের হলুদ হলুদ রঙের আলু ভুনা আমরা খেতে চাই। আপা বিস্ময় লুকিয়ে বললেন “এটা খেলে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।” খালা আমার দিকে তাকিয়ে তার পক্ষে রায় দেয়ার জন্য বলল, “কিরে খাবি না?” আমি খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম, নিশ্চই খাব। চলেন দুইজনের জন্য অর্ডার দেই। পরে আমাদের দু’জনার জন্য সেই টকটকে হলুদ আলু ভুনা এলো। মুখে দিয়ে বুঝলাম দেখতে খারাপ হলেও খেতে তেমন খারাপ না। দু’জন বেশ আয়েস করে খেলাম। এরপর ঝালমুড়ি, বাদাম ভাজা সবই খাওয়া হল।
তুমুল আড্ডায় সিঙ্গারা আর চা খেতে আমরা ভালোবাসতাম। সিঙ্গারার ভেতর বাদাম থাকলে আমি এবং ফেরদৌসী খালা দু’জনেই ভীষণ বিরক্ত হতাম এবং আমাদের দুজনেরই মনে হত কে সেই বেরসিক যে সিঙ্গারার ভেতর বাদাম ভরে দিয়েছে? এবং যথারীতি আমরা দু’জনেই সিঙ্গারার ভেতর থেকে পোকা বাছার মত বাদাম বেছে ফেলে দিতাম।
প্রায় প্রতিবছরই দূর্গা পুজায় আপা আলোকচিত্রী সাইদা খানম এবং ফেরদৌসী খালাকে নিয়ে প্রতিমা দেখতে যেতেন। সাথে আমিও যেতাম। ফেরদৌসী খালা ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রতিমা দেখতেই বেশি পছন্দ করতেন। একবার নবমীর দিন অনেক ভীর ঠেলে আমরা ভেতরে পৌঁছালাম। উনি গভীর মনোযোগ দিয়ে প্রতিমা দেখছেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা সেখান থেকে চলে আসি। লোকজন ওনার সাথে ছবি তোলার জন্য ভীর করতে থাকে। বাইরে এসেই খুব আনন্দ নিয়ে বিভিন্ন খাবার যেগুলো বিক্রি হয় তা নিয়ে উল্লসিত হয়ে পরেন। আমার আর ওনার খাবারের পছন্দগুলো বেশ মিলত এবং রাজ্যের পচা পচা খাবারের প্রতি আমাদের আগ্রহ একই মাত্রার ছিল। আমি ঠোঙা ভরে নারিকেল আর গুড় দিয়ে চিড়া মাখা এনে দিলাম, খেয়ে খুব খুশী হলেন। শৈশবের স্মৃতির সাথে মিশে গেলেন যেন। সেই আনন্দমাখা মুখভঙ্গি আমাকে দারুণ ভাবে মুগ্ধ করেছিল সেদিন।
ধানমন্ডির বাসায় অনেক বেশি যাওয়া হত। কখনও স্কুটি রাখতে বা কখনও আপার ফিরতে দেরি হবে জন্য ওখানে অপেক্ষা করতে বা কখনও শুধুই আড্ডা দিতে। দরোজা দিয়ে ঢোকার পরই খুব কম করে হলেও আড়াই ঘন্টার জন্য আটকে যেতাম। যেদিন হয়ত ভেবেছি কিছুক্ষণ থেকেই চলে আসব, যখন উঠতাম দেখা যেত তিন ঘন্টা কিভাবে যেন কেটে গেছে। উনি বারান্দায় বসে ওনার লোকদের নির্দেশনা দিতেন (তখন নিজে হাতে আর খোঁদাই-এর কাজ করতে পারতেন না) কিভাবে কি করবে। সেখানেই গিয়ে বেশিরভাগ মানুষ বসত। একদিন সন্ধ্যায় আমি গেছি ঐ বাসায়। একটা গাছের গুঁড়ি ওনার সামনে। আমি আর খালাই শুধু সেখানে। এর মধ্যে আমরা চা আর মুড়ি মাখা খেতে খেতে অনেক বিষয় নিয়ে গল্প করতে করতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরেছি। হঠাৎ হাসতে হাসতে উনি একবারে চুপ হয়ে গেলেন। অনেকটা পিনপতন নিরবতা বলতে যা বোঝায়, সেরকম। হুট করে এমন হওয়ায় আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম, কি হল বুঝতে পারছিলাম না। উনি এক দৃষ্টিতে গাছের গুড়িটার দিকে খুব মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছেন। কিছুক্ষণ পর বললেন দেখ ঐখানে একটা নারীর অবয়ব, মুখোমুখি একটি শিশুও আছে। আমি তাকালাম গুঁড়িটার দিকে। কিন্তু কোথায় নারীর অবয়ব বা মুখোমুখি একটি শিশু উনি দেখলেন, আমি তার কিছুই দেখতে পেলাম না। আমি যে দেখতে পাচ্ছি না তা উনি বুঝলেন এবং চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে গুঁড়িটায় আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করে যখন দেখালেন, ঠিক তখনই আমি দেখতে পেলাম যা উনি বলেছিলেন। মুগ্ধ হয়ে গেলাম দুটি কারণে, প্রথমত একজন শিল্পীর চোখ দিয়ে একটি শিল্পকে দেখতে পাওয়া এবং দ্বিতীয়ত, একই সাথে শিল্পী ও শিল্পকে দেখা।
বেশীর ভাগ সময়ই বাইরে কোন অনুষ্ঠানে যেতে হলে আপা তা ব্যবস্থা করে দিতেন বা আপাই সাথে করে নিয়ে যেতেন। কখনও কখনও আপা না গেলে আমাকে পাঠাতেন ফেরদৌসী খালার সাথে। একবার শিল্পকলা একাডেমিতে একটি অনুষ্ঠানে আমি আর ফেরদৌসী খালা গেলাম। সিএনজি অটোরিক্সায় যাতায়াত করতে ওনার বেশী ভাল লাগত। কারণ নাকি চারদিক থেকে ভাল ভাবে বাতাস চলাচল করে। তো উনি আর আমি যাচ্ছি। পুরোটা পথ উনি একটার পর একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইলেন। খুব দরদ দিয়ে, আন্তরিকভাবে উনি গাইতেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত ছিল ওনার সবচেয়ে পছন্দ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উনি ভেতরে ধারণ করতেন।
“নিন্দিত নন্দন” প্রকাশ হওয়ার পর আমার জন্য একটা কপি রেখে দিয়েছিলেন। একদিন বাসায় ডাকলেন। বিকেল বেলা গেলাম। বইটা হাতে দিয়ে বললেন বাসায় গিয়ে দেখিস। বাসায় এসে দেখি তাতে লিখেছেন “তোকে কোনদিন ভুলব না”। ফোন করে বললাম আমি কি কোথাও চলে যাচ্ছি যে ভুলবেন না?
বললেন আর কিচ্ছু লিখতে ইচ্ছে হল না, এটাই ইচ্ছে হল, তোর কি খারাপ লেগেছে? হেসে বললাম না, যা লিখবেন সেটাই আশীর্বাদ।
বেশির ভাগ সময়ই মুখোমুখি বসে আমাদের গল্প করা হত না। কারন উনি আমাকে গায়ের কাছে নিয়ে বসাতেন আর দীর্ঘক্ষণ আমার হাত ধরে বসে টুক টুক করে গল্প করতেন, আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম।
গত শুক্রবার (২ মার্চ) দেখা করতে গেলাম বাড়িতে। যথারীতি হাত ধরে বসে রইলেন। দুজন মিলে সিঙ্গারা আর চা খেলাম। এবারই প্রথম ভীষণ হতাশ দেখেছিলাম। বললেন আমার কেন এমন হল বলত? কোথায় গেল আমার সাজসজ্জা, কোথায় গেল আমার টিপ আর কোথায় বা গেল আমার গলার মালা। বললাম সাজেন না কেন? অসুবিধাতো নেই। মনের মত সাজেন। একদিন আবার বেড়াতে যাব আমরা, খুব আনন্দ হবে। হাসলেন, বললেন আর মনে হয় কোথায় যাওয়া হবে না। ভেতরটা ধক করে উঠেছিল।
পরের দিন পায়ে আবার অপারেশন হল। ফুলেশ্বরী দি মোবাইল ফোনে ম্যাসেজ পাঠালেন “অপারেশন ভাল হয়েছে, চিন্তা কোরো না, মা ঠিক আছে।” নিশ্চিন্তই ছিলাম সংবাদটা পেয়ে।
৬ মার্চ বিকালে অফিস ফেরত দেখা করতে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সময়টুকু জীবন থেকে চুরি হয়ে গেল। আপনি শুরু করলেন এক নবযাত্রা।
আপনাকে ঘিরে হাজারও স্মৃতিরা খুব যত্নে তোলা থাকবে। নিশ্চয়ই এই নবযাত্রা শুভ হবে। নিশ্চয়ই সকল না পাওয়াগুলো, কষ্টগুলো এবার আরো শক্তিশালীভাবে আপনি জয় করবেন। কাছেই থাকব আগের মত ভালোবাসাবাসি দিয়ে।
সারাবাংলা/এমএম