থিওরি অব সিমুলেশন ও করোনাক্রান্তি
২২ আগস্ট ২০২০ ২২:০৮
পৃথিবী নামক সিনেপ্লেক্সের ইতিহাসে সবচেয়ে সুপারহিট সিনেমা চলছে এখন। সিনেমার নাম করোনাক্রান্তি, অভিনয়ে আছি আমরা সবাই। আসলে সিনেমাতো সেই বিগব্যাং থেকেই শুরু। করোনাক্রান্তি হলো সিনেমার ভিতরে সিনেমা, আখ্যানের ভিতরে উপাখ্যান। চীনের উহান নগরী থেকে শুরু হওয়া সেই সিনেমার দৃশ্যপটে এখন বাংলাদেশ। আসল দৃশ্যপটের শুরু এপ্রিলের ১০ তারিখ থেকে; যেদিন দেখলাম শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার এক বৃদ্ধ মাতা তার ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন সৎকার করবেন বলে; কিন্তু মায়ের আহাজাড়িতে সাড়া দিচ্ছেনা কেউ; এমনকি ভাইবোনেরাও না! এরপর ১৪ এপ্রিল পর্দায় আসলো টাঙ্গাইলের সখীপুরের ছবি। দেখলাম, করোনার লক্ষণ থাকায় ছেলেমেয়েরা কিভাবে মাকে ফেলে আসলো বনের ভিতরে।
এমন দৃশ্য যখন একটার পর একটা আসতেই থাকল তখন ভাবলাম এইসব অমানবিক দৃশ্য দিয়ে কি বোঝানো হচ্ছে? হয়তো বোঝানো হচ্ছে ‘দ্যাখো তোমরা মানবজাতি অথচ অভিনয় করছো অমানবিক চরিত্রে’। আবার পাশাপাশি দেখানো হলো মানবিকতা কাকে বলে তাও। করোনার ভয়কে তুচ্ছ করে করোনাক্রান্তিতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করল পুলিশ; এখনও করছে। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই তাদের দিয়েই দেখানো হচ্ছে মানবিকতার উদাহরণ। শুরুর দিকে করোনার ভয়ে যখন ডাক্তাররাও দূরে দূরে থাকছিল; এমনকি আপনজনেরাও রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলোনা বা নিজেদের মৃত ব্যাক্তির ধারে কাছে যাচ্ছিলোনা; সেই দুর্দিনে সব করেছে পুলিশ। এরইমধ্যে, সিনেমায় টান টান উত্তেজনা আনার জন্য নির্মাতা ক্যামেরা নিয়ে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটায়; দেখালেন ‘আই কান্ট ব্রেথ’ নামের বর্ণবাদবিরোধী প্লট। শেষান্তে দেখানো হল পুলিশদের হাঁটুগেড়ে মাফ চাওয়া এবং বিক্ষোভরত সাদা-কালো মানুষদের করোনার ভয় উপেক্ষা করে দৌড়ে এসে সেই পুলিশদের জড়িয়ে ধরে কান্নার দৃশ্য। আচ্ছা কাঁদতে কাঁদতে কি বলছিলো ওরা? সম্ভবতঃ বলছিলো- উই আর হিউম্যান, উই আর হিউম্যান। পর্দায় এইসব দৃশ্য দেখে আড়ষ্ট হয়ে কাঁদেননি আপনারা?
আরও আছে! মনে নেই! কিভাবে বন্ধ হয়ে গেলো মন্দির, মসজিদসহ সব ধর্মশালা কিংবা কাবাঘরসহ সব তীর্থস্থান! এরপর ভারতের কেরালা রাজ্যে গর্ভবতী হাতির সাথে মানুষের নির্মমতা; বাংলাদেশের মাদারীপুরে বিষ মিশিয়ে বানর হত্যার করুণ দৃশ্য; নাটোরে একসাথে দুইশো শামুখখোল পাখি মেরে খেয়ে ফেলা কিংবা চালচোর থেকে শুরু করে অসুর শাহেদ-সাবরিনা পর্যন্ত, এসব কি কম সিনেমাটিক! ইতিহাস বলে, পৃথিবীর মানুষ এমন টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সিনেমায় আর অভিনয় করেনি কখনও। এবার সবাই যেন উপলদ্ধি করে যাচ্ছে আরে এতো পাতানো খেলা! বানানো সিনেমা!
আসলে তো তা-ই!
অক্সফোর্ড দার্শনিক নিক বোস্ট্রমের সিমুলেশন তত্ত্বতো তাই বলছে। ঐ তত্ত্ব মতে- হতে পারে পৃথিবীতে মানুষের পুরো জীবনপ্রণালীই একটা কম্পিউটার গেম এর সিমুলেশন বা ভান। হয়তো মহাবিশ্বের কোথাও মানুষের চেয়ে উন্নত বুদ্ধিমত্তার কোন সভ্যতা তাদের আওতায় থাকা অতিমাত্রার শক্তি ও মানসম্পন্ন কোন সুপার কম্পিউটারে চালিত ভিডিও গেমসের মাধ্যমে পুরো পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষদের জীবনযাপন ও গতিবিধি নিয়ন্ত্রন করছে যার কিছুই আমরা জানিনা। হলিউড মুভি ‘ম্যাট্রিক্স’ এ সিমুলেশন থিওরির ব্যবহারিক রূপের কিছুটা আসে। ম্যাট্রিএক্সের প্রধান দুই চরিত্র হল নিও ও গ্রীকদেবতা মরফিউজ। আমরা দেখি মরফিউজের কথানুযায়ী নিও’র চলার মধ্য দিয়ে কিভাবে বাস্তব জগৎ ও সুপার কম্পিউটার চালিত সিমুলেটেড জীবনের পার্থক্য বের হয়ে আসে।
বিজ্ঞানী আইনষ্টাইন যখন সফলতার তুঙ্গে তখন তাঁর সঙ্গে কাজ করতেন পদার্থবিদ জন হুইলার। জন হুইলারের সুরেও সিমুলেশন থিওরির সমর্থন পাওয়া যায়। তাঁর মতে– নিউটনিয়ান যুগে পদার্থবিদ্যাকে বলা হতো অস্তিত্বশীল বস্তুর বিজ্ঞান, কিন্তু এখন এইসব অস্তিত্বশীল পদার্থকে ঘিরে থাকা সম্ভাবনাও এর পরিধিভুক্ত, যেমন-কোয়ান্টাম ফিজিক্স। তাঁর একটা ভাষ্য হলো– “ইট ফ্রম বিট” যাকে বাংলায় বলা যায়- তথ্য থেকেই অস্তিত্ব।
আরেকটা কথা। সাড়ে চার বিলিয়ন বছরের পুরানো পৃথিবীতে হোমোসেপিয়ান গোত্রের মানুষেরা আসে ১৩০ হাজার বছর আগে। এ বিশাল সময়ের সিংহভাগই পড়ে ছিল অনাবাদি। চার্লস ব্যাবেজ এর হাত ধরে এখানে কম্পিউটার আসে মাত্র সেদিন। এত দেরি কেন? যারা পৃথিবীকে নিয়ে সিমুলেশনের খেলাটা খেলছেন তারা কি তবে এমন বহু গ্রহে এমনটা করছেন? আর তাই বুঝি ভুলে গিয়েছিলেন আমাদের কথা?
গতরাতে যেসব কাজগুলো করবো বলে ভেবে রেখেছিলাম, আজ তার একটাও হয়নি। সারাদিন কাটলো গান গেয়ে গেয়ে। তাঁর মানে কি আমার পুরো দিনটা অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করলো? আর এখন আমি যে বাসাটায় থাকি তাঁর সামনে-পিছনে অনেক গাছগাছালি। করোনাকালে ছাদে উঠা বেড়ে গেছে। ছাদে উঠে পিছনের গাছগাছালি দেখি; গ্রামীণ শৈশবকে টেনে আনি। ইদানীং এমনসব পাখি দেখি যা আগে কখনোই দেখিনি, কোত্থেকে আসে এরা? কে পাঠাচ্ছে ওদের?
ঘরেও আমার দুইটা পাখি আছে। তিনা ও তোনি। এখন ওরাই আমার সব।
ঈদের আগের ঘটনা। মুরগি কিনতে দোকানে গেলাম। যে মুরগিটা আমি পছন্দ করলাম, ও আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে থাকলো যেন বলছিলো আমি যদি তোমার তিনা-তোনি হতাম তবে কি করতে? আমার বুক ধ্বক করে উঠেলো। মনে হলো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি এই শেষ! আর কোনোদিন মুরগি কিনবোনা। এর একটু পরই দেখলাম ট্রাকভর্তি গরু যাচ্ছে। কি অদ্ভূত! মুরগি কাটবো বলে এত কষ্ট যখন মনে এলো তখনই দেখলাম ট্রাক ভর্তি গরু যাদের সবাইকে জবাই করা হবে শীঘ্রই। আচ্ছা এই ঘটনাগুলোর সব কি সিমুলেটেড? আমি কি কোন সুপার কম্পিউটারের ভিতরে? তাহলে করোনাকালে যা ঘটলো এবং যা ঘটছে তাঁর সবই কি সিমুলেটেড? আর, এর আগে-পরের পৃথিবী?
লেখক- প্রধান নির্বাহি, ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি ফোরাম
করোনা করোনাক্রান্তি থিওরি অব সিমুলেশন রাশেদ রাফি সিমুলেশন থিওরি