Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশের শিকড় থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি


১ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৪:৪৫

রাজনীতির শুদ্ধতম এক মানুষের চলে যাওয়া। চলে যাবেন— সেই আগস্টের ৯ তারিখের পর থেকেই বিদায় বিদায় বলছেন। অবস্থার একটু উন্নতি হয় তো, অবনতি হয়েছে আরও। শেষ বিদায় বলেই দিলেন আগস্টের শেষ দিনটিতে। করোনাকালের সবচেয়ে বড় ক্ষতিগুলোর একটি প্রণব মুখার্জির চলে যাওয়া।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধীদের পরে উপমহাদেশের রাজনীতিতে সেরা ক’জন ব্যক্তিত্বের একজন প্রণব মুখোপাধ্যায়।

আধুনিক ভারতের রাজনীতিতে বাঙালি নেতানেত্রী যারা, দিল্লির নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় থেকেছেন, তাদের মধ্যে সফলতম ও উজ্জ্বলতম নামটা তার। ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর সক্রিয় রাজনীতিতে প্রণববাবুর ভূমিকায় ইতি ঘটে। যা তার পদে তাকে আরও উজ্জ্বল করলেও, দলে নেতৃত্বের সংকট দেখা দিতে থাকে। অভিভাবক ও বটছায়া ছিলেন তিনি ভারতীয় কংগ্রেসে। এরপর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস পথ হারাতে থাকে। যা আজ আরও চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে। প্রণববাবু চলে গেলেন, তার কর্মময় জীবন রেখে। প্রশ্ন হচ্ছে, মহান এই ব্যক্তির শিক্ষা তার দল আদৌ গ্রহণ করতে পেরেছে কি? পারলে কেন প্রধান নেতাই এখনও চূড়ান্ত হচ্ছে না। যে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন প্রিয় স্যার, সেই বলিষ্ঠ-যোগ্য নেতার অভাব বড়ই। সেসব কথা আজ নয়। আজ বাঙালি দাদার বিদায়ের শোকে বিহ্বল আমরা। তাই তাকেই স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে।

প্রণববাবুর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ই ডিসেম্বর। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরের মিরিটি গ্রামে। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী ও কংগ্রেস নেতা। জেলা কংগ্রেস সভাপতি, এআইসিসি সদস্য ও পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদেরও সদস্য ছিলেন। সে দিক থেকে দেখতে গেলে রাজনীতি প্রণবের রক্তে। উত্তরাধিকার সূত্রেই পাওয়া। যদিও সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন রাজনীতির ছায়া মাড়াননি প্রণববাবু। বরং ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর পর্বের পরে মন দেন আইনের শিক্ষায়। তবে আইনজীবীর পেশাকে বেছে নেননি কখনো। ডাক ও তার বিভাগে যোগ দেন, পরে হাওড়ার বাঁকড়া স্কুলে শিক্ষকতা পর্বের পাট চুকিয়ে ১৯৬৩ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমতলার অদূরে বিদ্যানগর কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতায় থিতু হন। সাংবাদিকতাও করেছেন তিনি। কয়েক বছর পর ১৯৬৭ সালে, নির্বাচনী প্রচারণার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে অল্পবিস্তর যাত্রা। বাবার নয়, নিজগুণে প্রশংসা কুড়ান। ১৯৭১-সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম বড় নিয়ামক প্রণববাবুর জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশে। সে সময়ই পড়েন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নজরে। নির্বাচনে জয়, শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভায় প্রবেশ, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীও হন ১৯৮২-তে। কত কত অর্জন। পরিশ্রম ও মেধা তাকে ভারতের সেরা ব্যক্তিত্ব করে তোলে সেসময়ই। বলে রাখা ভালো, প্রণবের সময়ই রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব পান কংগ্রেসের দুইবারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।

দিল্লিজয়ের সঙ্গে সমস্যাতেও পড়েছেন একাধিক প্রণববাবু। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হওয়ার পর কংগ্রেসের অভ্যন্তরে কোণঠাসা হয়ে পড়েন তিনি। রাজীব গান্ধীর সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব থেকে সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি করা হয় প্রণবকে। রাজনীতিতে তখন যা ‘ডিমোশন’ হিসেবে প্রকাশ পায়। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই হাইকমান্ডের সঙ্গে বিতর্কের জেরে দল থেকে বহিষ্কার হন। কারণ হিসেবে ধরা হয়, রাজীবের সঙ্গে সহজে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠছিল না প্রণবের, তারা একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন। যদিও প্রধানমন্ত্রীত্বের শেষ ভাগে রাজীব উপলব্ধি করেন প্রণবের গুরুত্ব। দলে ফিরিয়ে আনেন বাঙালি বাবুকে। সেই থেকে আরও নিবেদিত হয়ে দলে কাজ করেছেন প্রণব। কংগ্রেসের রাজনীতিতে দিন রাত এক করেন। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে মন্ত্রী হিসেবে সফলও হন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে, তাকে সেরা বলা হয় পুরো বিশ্বের মধ্যে। পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবেও অনন্য উচ্চতায় তিনি থাকবেন। ২০০৪-এর লোকসভা ভোটে কেন্দ্রে ভারতীয় জনতা পার্টি-বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোটের‎ (এনডিএ) বিরুদ্ধে রাজ্যওয়ারি পাল্টা নির্বাচনী সমঝোতা গড়ায় মূল কারিগর প্রণববাবুই। সে হিসেবে সোনিয়া গান্ধীর কংগ্রেসকে ইউপিএ-র জোটের (সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট) মাধ্যমে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান এই বাঙালি রাজনীতিবিদ। তারই ধারাবাহিকতায় একুশ শতকে কংগ্রেস সেরা দল হিসেবে ভারত শাসন করে। প্রণব মুখার্জি বুঝতেন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, রাজনীতির গতিপ্রকৃতি। ভারতসহ সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপট ও ভালো-মন্দ নিয়ে বিচার করার ক্ষমতা তার ছিল। তাই তো বাংলাদেশ বারেবারে মূল্যায়ন পেয়েছে তার কাছে।

সুদীর্ঘ কর্মজীবনে বহুবার বিরোধীদের এমনকি, দলের ভেতরেও সমালোচনার শিকার বাঙালি বাবু। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বিদায় নেয়ার পরেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। দমে যাননি। কর্মময় জীবনকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বর্ণাঢ্য অভিজ্ঞতার আলোকে, ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে বই লিখেছেন অন্তত আটটি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসে দিল্লি জয় সহজ ছিল না। কিন্তু শেষ অব্দি হেরে গেলেন করোনার কাছে। হালের রাজনীতির রবীন্দ্রনাথকে হারালাম আমরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম সমাবর্তন। সাল ২০১৩। অনুষ্ঠানে ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হিসেবে বক্তব্য দেন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তার বক্তব্যে ছিল এই বাংলার প্রতি টান। সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বাংলাদেশের জন্য আওয়াজ তুলে গেছেন প্রণববাবু। বিশ্ব জনমত গড়ে তুলতে সোচ্চার ছিলেন। এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ভারতে নির্বাসিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোটবোন শেখ রেহানাকে প্রণব মুখার্জি সবসময় সহযোগিতা করেছেন। খোঁজ-খবর নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিজে তাকে অভিভাবক হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ হারালো অকৃত্রিম বন্ধুকে। তার চলে যাওয়া সত্যিই অপূরণীয় ক্ষতি। তাই তো আমরাও পালন করছি শোক দিবস। ভারতে প্রবীণ রাজনীতিবিদ সংকট। প্রতিবেশীর সম্পর্কগুলোকে গভীরভাবে বোঝেন এমন মানুষের অভাব। বিশেষ করে, বাংলাদেশকে গভীরভাবে, হৃদয় দিয়ে চেনা মানুষের সংখ্যা কমছে দিন দিন। তাই প্রণব হারানোর বেদনা অনেক বড়।

সমাবর্তন বক্তা হয়ে প্রণব বলেছেন, ‘‘আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে এটি একটি আবেগময় সফর। আমার শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে গাঁথা এবং আমি এর ভাষা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মভূত করেছি। আমার স্ত্রীর জন্ম নড়াইলে এবং এখানেই তিনি লেখাপড়া শুরু করেন। আমি বড় হয়েছি আপনাদের মতো একই সাহিত্যিক ও কবিদের লেখা পড়ে। সেসব গান শুনে যা আমাদের উভয় দেশের জনগণ ভালোবাসেন। ঘুরে বেড়িয়েছি একই নদীর তীরে, যা একই রকম গানের জন্ম দেয়। যা আমাদের মনকে একই রকমভাবে ভাবিত করে।’’

প্রণববাবুর সঙ্গে আমাদের রক্তের টান, তার সঙ্গে আমাদের জলবায়ু, হাওয়া, নদীর জলের স্রোতের টান। মুখের ভাষা, বুলির টান। পাতে ওঠা সবজি, ভাত-মাছের টান। অসাম্প্রদায়িক চেতনার টান। সর্বোপরি বাংলা ও বাঙালির টান। তাই তো বলি, বাংলাদেশের শিকড় থেকে ভারতের রাষ্ট্রপতি- এমন আর কখনও আসবেন কি কেউ!

লেখক: টেলিভিশন সাংবাদিক, সাহিত্যিক।

প্রণব মুখার্জি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর