যুদ্ধের মাঝে পথচলা
১১ মার্চ ২০১৮ ১৩:০২
ইয়েশিম ইকবাল আর নুহাশ হুমায়ূন দুজনের বাবাকেই আমি চিনি, আপনারাও চেনেন। কিন্তু তাদের দাদা ফয়েজুর রহমানকে আমরা ক’জন চিনি। বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের। হুমায়ূন আহমেদ এবং জাফর ইকবাল অবশ্য তাদের লেখায় শহীদ পিতার স্মৃতিচারণ করেছেন অনেক লেখাতেই। অমন সাহসী পিতার সন্তানেরা এবং পরবর্তী প্রজন্ম যে সে সাহস বুকে ধারন করে আছে, তা মাঝেমধ্যেই অনুভব করি। প্রমাণ পাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং তার আগে আমি সাহসী মানুষ ফয়েজুর রহমানকে কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি আরও কিছু সাহসী মানুষকে। নিজেদের জীবনের বিনিময়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যারা রেখে গেছেন এই দেশ, বাংলাদেশ।
১৯৬৮ সাল। এসএসসি পরীক্ষার পর আমার পিতার নতুন কর্মস্থল পিরোজপুর আসি। ভর্তি হই পিরোজপুর কলেজে। সে সময়ে পিরোজপুর মহকুমা পুলিশ প্রধান ছিলেন ফয়েজুর রহমান। আমার পিতার প্রায় সমবয়সী। সে সময় ওখানে আমাদের একটি বন্ধু সার্কেল গড়ে ওঠে। সাহিত্য, সংস্কৃতি ও নাট্যচর্চা ছিলো আমাদের মূল উদ্দেশ্য। অমর সাহা, জুয়েল আইচ এরকম কয়েকজন সংগঠক ছিলো আমাদের। অমর সাহা নাটক লিখতো, আমরা সেটি মঞ্চস্থ করার উদ্যোগ নিতাম। ফয়েজুর রহমান সাহেব ছিলেন আমাদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তিনি নাটক মঞ্চায়নের ব্যাপারে আমাদের অনেক সহযোগিতা করতেন। আমাদেরকে নানা পরামর্শ দিতেন। একদিন তিনি তাঁর বাসাতে আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে গেলেন। নানারকম গানের সংগ্রহ ছিলো তাঁর, রেকর্ড প্লেয়ারে আমাদের কয়েকটি শোনালেন। তবে যেকথা এখনো মনে আছে সেটা হলো রবীন্দ্রনাথের স্বকন্ঠে গীত কবিতা ও গান। তার সংগ্রহের সে রেকর্ড আমাদের বাজিয়ে শোনালেন। অন্যরকম এক অনুভূতিতে মনটা ভরে গিয়েছিলো।
সে সময় জাফর ইকবাল পড়তো ঢাকা কলেজে, আর হুমায়ূন আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিভিন্ন ছুটিতে তারা পিরোজপুর আসতো। দু ভাই একসাথে ঘুরতে বের হতো। ঈদের সময় একসাথে টুপি পরে ঈদগাহে আসতো। ঈদগাহটি ছিলো তাদের বাসার বেশ কাছে। নামাজের পর কুশল বিনিময় চলতো, তাদের বাসাতেও যেতাম। সেমাই খেয়ে গল্প করতাম ফয়েজুর চাচার সাথে। সে সময় এই দুই ভাইয়ের থেকেও তাদের বাবার সাথেই আন্তরিকতা ছিলো বেশী। চাচীও খুব স্নেহ করতেন।
১৯৭০ এর সেপ্টেম্বরে আমি ও জাফর ইকবাল একই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। দুজনেই সুর্যসেন হলের (তখন জিন্নাহ হল) ছাত্র। কিন্তু হলে রুম পেতে দেরী হবে। হুমায়ুন আহমেদ তখন মহসিন হলে থাকতেন, তার কক্ষে জাফর কিছুদিন ছিলো, আর আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে আমার এক বন্ধুর রুমে।
দেখতে দেখতে মার্চ মাস চলে আসে। ১৯৭১ এর সেই উত্তাল মার্চ। প্রতিদিন মিছিলে যাই। জয় বাংলা, পদ্মা মেঘনা যমুনা… এই সব শ্লোগান শুনি আর সেই সাথে গুলির শব্দ। ১ মার্চ হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু সংবাদ সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন। ছাত্র-জনতার মধ্যে থেকে তাঁর বক্তব্য শুনি। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন সভায় উপস্থিত থাকি। ছাত্রনেতাদের গগণবিদারী শ্লোগানে কন্ঠ মেলাই। এরপর প্রতিদিন এক একটি ইতিহাসের মধ্যদিয়ে হাঁটতে থাকি। ৭ মার্চ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বন্ধুসহ রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হই। তিনি স্বাধীনতার যে কথা উচ্চারণ করেন – ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ তার থেকে বড় আর কোনো ঘোষণা হতে পারেনা। সম্ভবও নয়। আবেগে তাড়িত হই। ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে মওলানা ভাসানীর জনসভা। যথাসময়ে সেখানে উপস্থিত হই। মশিউর রহমান যাদু মিয়ার বক্তব্যের পর ভাসানী তার দরাজ কন্ঠে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘মুজিব আমার ছেলে, তাকে আমি অনেক ভালোবাসি। সাতই মার্চ সে যে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে, তার প্রতি আমার ও আমার দলের শতভাগ সমর্থন ঘোষণা করছি।’ তিনি এই সভা থেকে মুজিবের জন্য দোয়া করেন এবং মুজিবের নেতৃত্বে সবাইকে মুক্তিসংগ্রামে যোগ দেবার আহবান জানান।
এর মধ্যে বন্ধুরা ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছে। সবার মুখে একই কথা, যার যার অনঞ্চলে গিয়ে মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এইসব ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিতে উপস্থিত থাকতে পেরে আমার মাঝে একধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করি।
১০ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা ছাড়ি। পকেটে টাকা পয়সা তেমন একটা নেই। ট্রেনে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাই। সেখানে আমার বড়বোন ছিলেন। তার কাছ থেকে দশটা টাকা চেয়ে নেই। যদি পিরোজপুর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারি তাহলে টাকাটা কাজে লাগবে।
এর দু’দিন পর চাঁদপুর থেকে স্টিমারে পিরোজপুরের পথে যাত্রা করি। সে সময় ঢাকা-খুলনা রুটটি ছিলো ঢাকা থেকে চাঁদপুর, তারপর বরিশাল ঝালকাঠি হয়ে হুলারহাট, তারপর খুলনা। পিরোজপুরের নদীবন্দর হলো হুলারহাট। সে সময়ে শীত তেমন একটা নেই। তবে স্টিমারে রাতটি ছিলো বেশ ঠান্ডা। রাতে স্টিমারের ডেকে এককোণায় দু’হাত মুড়ে বসা অবস্থায় হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে পাই। সংগে কোনো গরম কাপড় নেই। আমার কাছে সোয়েটার আর একটি গরম চাদর ছিলো। আমি চাদরটি হুমায়ূন ভাইকে দেই। তিনি প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে হাসিমুখে সেটি নেন। ভোররাতে হুলারহাটে স্টিমার পৌঁছে। যে যার মতো নেমে যাই। রিকশা করে বাসায় আসতে আসতে সকাল। বাবা, মা, ছোটবোন সবার মুখ দেখে বুঝতে পারি তারা অনেক দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অনেকদিন কোনো খবর পাননি। সবার ভেতর উৎকন্ঠা। এই প্রথম আম্মাকে কাঁদতে দেখি।
দুপুরের পর বাসা হতে বের হবার যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি পিরোজপুর টাউনের অবস্থা দেখার জন্য, সে সময় একজন কনেস্টবল বাসায় এসে সেই চাদরটি দিয়ে যায়, যেটি গত রাতে হুমায়ূন ভাইকে দিয়েছিলাম।
বাসা হতে বের হয়ে এসডিও অফিস পার হতে হতে পিরোজপুরের অবস্থা বুঝে ফেলি। মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ছাত্ররা সবাই জড়ো হয়েছে পিরোজপুর সরকারি স্কুল মাঠে। ট্রেনিং চলছে। লাঠি আর নকল বন্দুক সাথে নিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিং। একদল ট্রেনিং শুরু করেছে, আরেকদল ট্রেনিং এর জন্য নাম লেখাচ্ছে। আমিও নাম লিখিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলাম।
দিনরাত প্রশিক্ষণ চলছে। সে সময় আমাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন পিরোজপুরের আওয়ামী লীগ নেতা ১৯৭০ সালে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য এ্যাডভোকেট এনায়েত হোসেন খান, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মন্ডল, ন্যাপ নেতা আলী হায়দার খান, এ্যাডভোকেট আব্দুল মান্নানসহ আরো অনেকে। একদিন বিকেলে প্রশিক্ষণ শেষে মাঠ থেকে বের হবার সময় কে যেনো পেছন থেকে আমার পিঠে হাত দিয়ে থামালেন। তাকিয়ে দেখি পুলিশ অফিসার ফয়েজুর রহমান আর তার পাশে দাড়িয়ে হাসছেন তরুন ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান। সে সময়ে ফয়েজুর রহমান চাচার বয়স ৫০ বছর আর সাঈফ মিজানুর রহমানের বয়স মাত্র ২৭ । পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে এই দুজনের ভূমিকা ছিলো অসাধারন, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এসবই হচ্ছে ২৫ মার্চ এর আগের কথা।
২৫ মার্চ হতে পাকিস্তান আর্মি যখন সারাদেশে বাঙালি নিধন শুরু করে পিরোজপুরের মুক্তিযাদ্ধারা তখন বালেশ্বর ও কচা নদীর পাড়ে সশস্ত্র পাহাড়া দিতে শুরু করে। কোনো প্রতিরোধ ছাড়া যেনো পাক আর্মি পিরোজপুর দখল করতে না পারে। প্রত্যেক বাড়ি, অফিস, স্কুল, কলেজ সব স্থানে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। পিরোজপুরের অবাঙালি এসডিও এর মাঝে কোনো একসময় পিরোজপুর ত্যাগ করে ঢাকা চলে যান। পিরোজপুরের বেসামরিক প্রশাসন তখন এসডিপিও ফয়েজুর রহমান ও ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমানের হাতে। মনে আছে ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় যখন অপারেশন শুরু হয়, পিরোজপুরে সে খবর সাথে সাথে পৌঁছে যায়। আকাশবাণী কলকাতা হতে ভারী কন্ঠে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় জানাতে থাকেন পাকিস্তানি আর্মি ও বাঙালিদের মধ্যে ‘যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে’ এই খবর। এরমধ্যে মুক্তিযাদ্ধারা পিরোজপুর ট্রেজারি বিল্ডিং ঘেরাও করে। পুলিশ অফিসার ফয়েজুর রহমান ও ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমান ট্রেজারি হতে সব অস্ত্র গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেন। সুশৃঙ্খলভাবে সব কিছু হলো। কারণ যুদ্ধের জন্য কঠিন শৃঙ্খলা দরকার। সকলে লাইনে দাড়িয়ে শপথ গ্রহণ করলো। শপথ পরিচালনা করলেন লেফটেন্যান্ট জিয়া। মধ্য মার্চেই জিয়া পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দেশে চলে আসেন। এসেই পিরোজপুরের সন্তান জিয়া প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নিজের হাতে তুলে নেন।
মে মাস শুরু হতেই জোর গুঞ্জন যেকোনো সময় আর্মি পিরোজপুর দখল করে নেবে। মুক্তিযাদ্ধাদের একটা বড় অংশ তখন সুন্দরবন অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরিতে ব্যস্ত। লেফটেন্যান্ট জিয়ার সাথে তখন আরো কিছু সৈনিক যোগ দিয়েছেন। ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর ও মেজর জলিল পিরোজপুরে মুক্তিযাদ্ধাদের কার্যক্রম দেখে গেছে।
অবশেষে ৪ মে পাকিস্তান আর্মি পিরোজপুরে ঢুকে চারিদিকে ত্রাস সৃস্টি করলো। গ্রামের পর গ্রাম আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। নদী ও খালে লাশ আর লাশ। আমরা তখন নিরাপদ দূরত্বে। খবর পেলাম এসডিপিও ফয়েজুর রহমান ও ম্যজিস্ট্রেট সাঈফ মিজানুর রহমানকে আর্মিরা এরেস্ট করেছে। তারপর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় তাঁদের। কতো নৃশংসভাবে সে কথা আজ আর নাই বললাম।
সারাবাংলা/পিএম