Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যেভাবে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে বাংলাদেশ


১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২০:০৫

বাঙালির ভোজন বিলাসিতার পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি রয়েছে। নানাবিধ মসলার সমন্বয়ে রন্ধনশৈলীর উপস্থাপনা যেকোনো মানুষের মন জয় করে নিয়েছে। আমরা দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যে হারে মসলার ব্যবহার করে থাকি বিশ্বের অন্যান্য দেশে তা লক্ষণীয় নয়। আবার খাবারকে রুচিশীল ও মুখরোচক করতে মসলার বিকল্প হয় না। পেঁয়াজকে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা এবং সবজিও বটে। ভাতের সঙ্গে খালি পেঁয়াজ, সালাদ ও ঝাল মুড়িতে কাঁচা পেঁয়াজ এবং আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, ডিম ভর্তা, শুটকি ভর্তা এমনকি ডিম ভাজিতেও এর ব্যবহার সমাদৃত। তাছাড়া অধিক হারে পেঁয়াজ ব্যবহার করে মসলা হিসেবে বেটে পেস্ট বানিয়ে  ব্যবহার তরকারীকে সুস্বাদু ও রসালুতে পরিণত করে। পেঁয়াজ পাতায় বেশি পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে। পাতা সবজি হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া পেঁয়াজের ডাটা ও পাতা ভিটামিন ‘সি’ ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ। পেঁয়াজ ব্যবহৃত খাবার দ্রুত হজম হয় ও রুচিবর্ধক।

বাংলাদেশে সাধারণত চারটি পদ্ধতিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়—

  • জমিতে সরাসরি বীজ বপন করে
  • কন্দ/বাল্ব সরাসরি রোপণ করে
  • বীজতলা থেকে তৈরি চারা সংগ্রহ করে অন্যত্র রোপণ করে
  • বীজ উৎপাদনে ব্যবহৃত পেঁয়াজ সংগ্রহ করে

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কৃষি আবহাওয়া আর বাংলাদেশের কৃষি আবহাওয়া এক নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে যেমন তুরস্ক, ভারত, উজবেকিস্তান, মিশরসহ আরও কিছু দেশে ২-৩ মৌসুমে পেঁয়াজ চাষ হয়। কিন্তু আমাদের দেশে শুধুমাত্র রবি মৌসুমেই পেঁয়াজ চাষ হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে পেঁয়াজের উৎপাদন হয়েছে ২৫.৬০৬ লাখ মেট্রিক টন। সনাতনী পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করায় প্রতিবছর উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্যায়ে মোট উৎপাদনের প্রায় ২৫-৩০ ভাগ পেঁয়াজ বিভিন্ন উপায়ে নষ্ট হয়। সে হিসেবে প্রায় ৬-৭ মেট্রিক টন পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়। চারা পেঁয়াজ সংগ্রহের বা উঠানোর উপযুক্ত সময় হলো ফেব্রুয়ারির শেষ এবং মার্চ মাস। তাছাড়া এ বছর ফেব্রুয়ারির শেষদিকে ও মার্চ মাসে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় নিচু ও মাঝারী নিচু, মাঝারী উঁচু জমিতে পানি জমে যায়। ফলে ভেজা পেঁয়াজ জমি থেকে উত্তোলন করতে হয়। এতে পেঁয়াজে জলীয় অংশের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে সংরক্ষণকালীন পেঁয়াজের একটি বড় অংশ দ্রুত পচে নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে মোট উৎপাদিত পেঁয়াজের পরিমাণ হয় প্রায় ১৮-১৯ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু আমাদের দেশে পেঁয়াজের মোট চাহিদা রয়েছে ২৭-২৮ লাখ মেট্রিক টন। ফলে বর্তমান অর্থবছরে প্রায় ৯ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজের ঘাটতি রয়েছে। গত মৌসুম হতে আসন্ন পেঁয়াজ আবাদের আগেই   প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে।

পেঁয়াজ পচে যাওয়ার ভয়ে চাষিরা ভরা মৌসুমেই কম দামে বিক্রি করেছে। এ কারণে মৌসুম পরবর্তী সময়ে চাহিদার তুলনায় দেশীয় পেঁয়াজ কম পরিমাণে সংরক্ষিত ছিলো। ফলে বর্তমানে দেশীয় পেঁয়াজ কৃষকের কাছে সংরক্ষিত নেই বললেই চলে। কিছু মুনফাভোগীদের নিকট  অল্প পরমাণে পেঁয়াজ সংরক্ষিত আছে এবং তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেশি মুনাফার আশায় হঠাৎ করেই দাম বৃদ্ধি করে বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করেছে একথা শুনেই সিন্ডিকেট তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এ কাজ করছে। একদিকে যেমন কৃষক তার ন্যায্যমূল্য পায়নি অন্যদিকে ভোক্তাও  ন্যায্যমূল্যে এ পণ্যটি ক্রয় করতে ব্যর্থ হচ্ছে। কৃষি-বান্ধব এই সরকারকে বিপদে ফেলতে কিছু ব্যবসায়ী কম দামে বিদেশ হতে পেঁয়াজ ক্রয় করে ভোক্তার নিকট বেশি দামে বিক্রি করছে। এজন্য সরকারের উচিত এই পচনশীল দ্রব্যটি সারাবছর সংরক্ষণের জন্য প্রতিটি জেলায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অধীন হিমাগার করে কৃষকের উৎপাদিত পেঁয়াজের সংরক্ষণ। এবং অমৌসুমে ভোক্তার নিকট ন্যায্যমূল্যে বিতরণ ও পেঁয়াজ চাষিদের তালিকা প্রণনয়পূর্বক প্রণোদনা প্রদান করা। চাহিদাভিত্তিক আবাদ নিশ্চিত করা।

সে হিসেবে শুধুমাত্র রবি মৌসুমে পেঁয়াজ চাষাবাদ করে বাড়তি ৯-১০ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন করা সম্ভাব্য নয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) বর্ষা মৌসুমে পেঁয়াজ আবাদের জন্য ৩টি জাত অবমুক্ত করেছে। সেগুলো হলো বারি পেঁয়াজ-২, বারি পেঁয়াজ-৩, বারি পেঁয়াজ-৫। এই জাতগুলি ফেব্রুয়ারি মাসে বীজতলায় বপন করে মার্চ মাসে মূল জমিতে রোপণ করে জুন-জুলাই মাসে সংগ্রহ করা যায়। আবার জুলাইতে বীজতলায় বপন করে আগস্ট মাসে মূল জমিতে রোপণ করে নভেম্বর মাসে সংগ্রহ করা যায়। এ জন্য বর্ষা মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে হবে। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮১ হেক্টর কিন্তু অর্জিত হয়েছে মাত্র ৪০ হেক্টর এবং গড় ফলন ছিল ৮.৪৪ মে./হে.। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রবি পেঁয়াজ এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজ আবাদের অর্জিত ৬৪ জেলাসমূহের আবাদে সর্বোচ্চ ক্রম অনুসারে নিচের ছকে দেখানো হলো।

২০১৯-২০ অর্থবছরে পেঁয়াজ আবাদের ক্রম অনুযায়ী জেলার তালিকা, গড় ফলন ও উৎপাদন পরিস্থিতি

উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়— রবি মৌসুমে যে জেলাগুলোতে বেশি পেঁয়াজ আবাদ হয় গ্রীষ্মকালে সেখানে কোনো পেঁয়াজ আবাদ হয় না।

কিন্তু এসময় বেশি বৃষ্টিপাত হওয়ায় ও তাপমাত্রা বেশি থাকায় সময়োপযোগী জাত অবমুক্ত করতে হবে। তাহলে সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় বাদ দিয়ে অতিরিক্ত প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে।

আমাদের দেশে সাধারণত পেঁয়াজের স্থানীয় জাত যেমন তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, ঝিটকা বীজ ব্যবহৃত হয়। এগুলো জাতের গড় ফলন ৭-১০ মে.টন/হে.। মেহেরপুর জেলায় ভারতের সুখ সাগর জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়। এর গড় ফলন ৩৫-৪০ মে.টন/হে.। কিন্তু এ জাতের পেঁয়াজের সংরক্ষণ ক্ষমতা কম থাকায় জাতটি কৃষক পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোর মধ্যে লালতীর সিড লিমিটেডের কয়েকটি পেঁয়াজের জাত যেমন লালতীর কিং, লালতীর হাইব্রিড এবং লালতীর-২০ জাত রয়েছে। এগুলোর ফলন ১২-১৫ মে.টন/হে.। এদের সংরক্ষণ ক্ষমতা দেশি জাতের সংরক্ষণ ক্ষমতার চাইতে কম। এ কারণে এই উন্নত জাতগুলো যথাযথভাবে সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয়করণ হচ্ছে না। তবে অনেকাংশেই এই জাতগুলো সম্প্রসারণ হচ্ছে।

গত ১০ বছরে পেঁয়াজের মোট আবাদকৃত জমি, উৎপাদন ও গড় ফলনের তথ্য

গত ৫ বছরে সর্বোচ্চ পেঁয়াজ আবাদকৃত জেলার নাম, আবাদকৃত জমির তথ্য

গত ১০ বছরে পেঁয়াজের আবাদি জমি প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১১.৪৩ মেট্রিক টন। সে হিসেবে পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে বর্তমান ফলনে প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমির আবাদ সম্প্রসারণ করতে হবে। এই ৮০ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে কমপক্ষে ৩০-৩৫ হাজার হেক্টর পেঁয়াজের আবাদ গ্রীষ্মকালে সম্প্রসারণ করতে হবে। বাকী ৪৫-৫০ হেক্টর জমির আবাদ রবি মৌসুমে করতে হবে। এজন্য কমপক্ষে আরও ৭-৮ বছর অপেক্ষা করতে হবে। রবি মৌসুমে পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ করতে হলে অন্য ডাল/তেল জাতীয় ফসলের আবাদ হ্রাস না করে বিকল্প অন্যান্য ব্যবস্থা করতে হবে।

পেঁয়াজ উচ্চমূল্যের মসলাজাতীয় ফসল। সাধারণত স্থানভেদে ১ একর পেঁয়াজ আবাদ করতে প্রায় ৫৫ হাজার টাকা খরচ হয়।  সংগ্রহোত্তর মৌসুমে ১ একর পেঁয়াজ থেকে প্রায় ৮০-৮৫ হাজার টাকা পাওয়া যায়। তবে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা গেলে  অমৌসুমে আরও বেশি মুনাফা সংগ্রহ করা যায়। পেঁয়াজ সংরক্ষণ ব্যবস্থা উন্নত হলে চাষিরা চাষে উৎসাহিত হবে। সে ক্ষেত্রে কৃষকরা সংরক্ষণের মাধ্যমে উচ্চ মূল্য পাবে এবং আবাদের পরিমাণ বাড়াতে উৎসাহী হবে।

সংরক্ষণ পদ্ধতি
পেঁয়াজ ভালো করে শুকানোর পর গুদামজাত করতে হবে। গুদামঘর ঠাণ্ডা ও বায়ু চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থাযুক্ত হতে হবে। মাঝে মাঝে গুদাম ঘর পরীক্ষা করে পচা  ও রোগাক্রান্ত পেঁয়াজ বেছে সরিয়ে ফেলতে হবে। ঠাণ্ডা গুদামঘরে তাপমাত্রা হতে হবে ৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং ৬৪ শতাংশ আর্দ্রতাযুক্ত। কাঁচা পেঁয়াজ কাগজের ব্যাগে ছিদ্র করে রেখে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। তবে পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য আধুনিক উন্নত পদ্ধতি হলো ‘জিরো এনার্জি স্টোরেজ’ পদ্ধতি। মূলত বাঁশ ও কাঠ দিয়ে ওই স্টোরেজ তৈরি করা হয়। দু’পাশের অংশে এক ধরনের ওষুধ দিয়ে শোধন করে নেওয়া হয়। তার পরেই সেখানে পেঁয়াজ রাখা হয়। সেক্ষেত্রে পেঁয়াজ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যাবে এবং পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না।

সুপারিশ

  • আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ ও সংরক্ষণ করতে হবে
  • সংগ্রহোত্তর ও সংরক্ষণকালীন অপচয় ৫ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে হবে
  • উৎপাদন/ভরা মৌসুমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে
  • রবি পেঁয়াজের পাশাপাশি বর্ষা মৌসুমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ সম্প্রসারণ ও জনপ্রিয় করতে হবে
  • উন্নত ও ভালো গুণাগুণসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করতে হবে
  • ব্যবসায়ীদেরকে ন্যায্যমূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে

লেখক: বিসিএস (কৃষি), কন্ট্রোল রুম, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর

টপ নিউজ পেঁয়াজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

আইভরি কোস্টে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৩
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৩:৪০

সম্পর্কিত খবর