কৃষিতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব রাখবে করোনা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৮:৪৭
২০২০ সাল বাংলাদেশের জন্য দুঃসময় বয়ে নিয়ে এসেছে। সারা পৃথিবীর ন্যায় এদেশেও নভেল করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় পৌনে ৩ কোটি মানুষ। মারা গিয়েছেন ৯ লাখের বেশি। বাংলাদেশেও সংখ্যাদ্বয় নিতান্তই কম নয়। সোয়া ৩ লাখ আক্রান্তের বিপরীতে এখানে মৃতের সংখ্যা সাড়ে ৪ হাজারেরও বেশি। কেবলমাত্র করোনাভাইরাসই নয়, এ বছর বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যা। করোনার প্রভাবে সারা দেশে যখন স্থবির অবস্থা বিদ্যমান তখন ২০-২১ মে উপকূলীয় দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত করে। মূলত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপর এই ঘূর্ণিঝড়ের মূল আঘাত পড়লেও বাংলাদেশেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। এই ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি পরিমাপ ও প্রভাব কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা শুরু হয়। দীর্ঘস্থায়ী এ বন্যায় বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে এ বছর কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নাও হতে পারে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ এ বছরের মার্চ মাস থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এপ্রিলের শুরুর দিকে করোনাভাইরাসের প্রভাব ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত না হলেও মে-জুন থেকে সারাদেশে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। যদিও করোনাভাইরাসের প্রকোপের শুরুর দিকেই গত আমন মৌসুমের ফসল তুলে ফেলা সম্ভব হয়। সরকারি তথ্য মতে গত আমন মৌসুমে দেশের ৪৭ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৭ হেক্টর জমিতে ধানে চাষ হয়েছে। তবে মোট উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ সম্পর্কে তারা কোনো সুস্পষ্ট তথ্য প্রদান করেনি। বাংলাদেশের খাদ্য ও অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, বিগত মৌসুমে দেশে কাঙ্ক্ষিত খাদ্য উৎপাদন হয়নি।
চলতি মৌসুমে আউশ ও রোপা আমনের উৎপাদন কমে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশে দীর্ঘদিন যাবত লকডাউন কার্যকর ছিল। সরকার লকডাউনের ব্যাপারে সুস্পষ্ট বক্তব্য না দিলেও কার্যত দীর্ঘদিন বাংলাদেশে দোকানপাট বন্ধ ছিল। তখন মাঠে ঘাটে কাজের ক্ষেত্রেও স্থবিরতা পরিলক্ষিত হয়েছে। পাশাপাশি দীর্ঘ প্রায় ২ মাস যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকার কারণে পরিযায়ী শ্রমিকের কর্মক্ষেত্রে আসার সুযোগ ছিল না। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের কৃষিক্ষেত্রে একটি বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে করোনাভাইরাস। তাই আসন্ন মৌসুমে আমাদের চাল, ডাল, মৌসুমি সবজি এবং মৎস্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশের পাশাপাশি আমাদের প্রতিবেশী ভারত, চীন প্রভৃতি দেশও করোনা মোকাবিলা করছে। বিশেষত ভারতে দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের ফলে সে দেশেও কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমাদের আমদানি করে খাদ্য চাহিদা পূরণ করাও কঠিন হয়ে পড়বে। এ অবস্থায় আমাদের আসন্ন মৌসুমের উৎপাদিত ফসল সুষ্ঠুভাবে সংগ্রহ করা এবং সরকারি তত্ত্বাবধানে তা মজুতের ব্যবস্থা করা জরুরি। একই সাথে কৃষক যেন ন্যায্য মূল্য পায় তাও নিশ্চিত করা জরুরি। অন্যথায় খাদ্যের মজুদ মধ্যসত্ত্বভোগীদের কবলে পড়লে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হবে, দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে।
মে মাসের ২০-২১ তারিখে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে আম্পান নামক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এই ঘূর্ণিঝড়ের ফলে মোট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সরকার ঘোষণা করেনি। তবে ঘূর্ণিঝড়ের পরপরই সরকার প্রকাশিত প্রাথমিক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এর ফলে দেশে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা সমপরিমাণ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ২০০টির বেশি ব্রিজ-কালভার্ট, কয়েকশ কিলোমিটার বাঁধ ও সড়কপথ, ৩০ হাজারের মতো ঘরবাড়ি, অসংখ্য গাছপালা এবং ২ শতাধিক স্থানীয় সরকার কার্যালয়। তবে আম্পানের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশের কৃষিখাত। প্রায় ২ লাখ হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে যার মধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর বোরোর ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানের বাঁধ ভেঙে ফসলের জমিতে পানি চলে এসেছে। কোথাও আবার ঘূর্ণিবায়ুর প্রভাবে পুকুর ও জলাশয়ে চাষকৃত মাছ ভেসে গিয়েছে। ফলে সার্বিকভাবে আম্পানের প্রভাবে বাংলাদেশের কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা ও সাতক্ষীরা জেলায় অসংখ্য মাছের ঘের ভেসে যায়। পাশাপাশি বিভিন্ন জেলায় আউশের বীজতলা, মুগডাল, মরিচ, তরমুজ, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল বিনষ্ট হয়েছে। ঝড়ের ফলে বিভিন্ন জেলায় মরে যায় খামারের মুরগি। আম্পানের কারণে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঝিনাইদহ জেলায় আমের বাগানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
করোনাভাইরাস সংকটে বাংলাদেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস ওঠার দশা তখন এ বছর জুনের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা শুরু হয়। হিমালয়ের বরফগলা পানি ও ভারি বৃষ্টিপাত থেকে সৃষ্ট জলরাশির প্রভাবে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, রংপুর, সুনামগঞ্জ, সিলেট, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, জামালপুর, ফরিদপুর, শরিয়তপুর, মাদারীপুর, ফেনি, ঢাকাসহ ৩৩টি জেলা বন্যার পানিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য তলিয়ে যায়। জাতিসংঘের কো-অর্ডিনেশন অফ হিম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে, এবারের বন্যা ১৯৮৮ সালের পর সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে বন্যার পানি কিছুটা নামতে শুরু করলেও এরই মধ্যে দেশের কৃষিখাতের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে এই মৌসুমি বন্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, বন্যার পানি নেমে গেলেও এর ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ২০২১ সালের মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।
চলতি বছরের বন্যা আগস্ট মাসের শেষার্ধ পর্যন্ত স্থায়ী হওয়ায় মূলত ধান উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বন্যার ফলে রোপা আমনের চারা বিনষ্ট হয়ে যাওয়ায় এবং চারা রোপণে দেরি হওয়ায় ফলন কমে যেতে পারে। পাশাপাশি বন্যার পানি বেগুন, বরবটি, চিচিঙ্গা, টমেটো, মুগডাল, কচু, তরমুজ প্রভৃতি ফসলের ক্ষতি করেছে। বন্যায় কৃষি অবকাঠামো বিনষ্ট হয়েছে। লাখ লাখ হাঁস-মুরগি মারা গিয়েছে। চাষের মাছ ভেসে গিয়েছে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, চলমান বন্যায় বাংলাদেশে ৫ লাখের অধিক পরিবার ঘরবাড়ি হারিয়েছে। ১৯৮৮ সালের পর বাংলাদেশ জুড়ে এমন বিস্তৃত ও প্রলয়ঙ্করী বন্যা আর দেখা যায়নি।
২০২০ সাল বাংলাদেশের জন্য প্রকৃতপক্ষেই একটি দুর্যোগের বছর। নভেল করোনাভাইরাস, ঘূর্ণিঝড় আম্পান এবং মৌসুমি বন্যায় এবার বাংলাদেশের কৃষিখাত ব্যাপকভাবে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সার্বিকভাবে আসন্ন দিনগুলোতে বিশেষজ্ঞরা খাদ্য সংকটের আশঙ্কা করছেন। এমন অবস্থায় একমাত্র পরিকল্পিত উপায়ে খাদ্যশস্য সংগ্রহ ও সরকারিভাবে মজুতকরণ এবং সুষ্ঠু বণ্টন প্রক্রিয়ায় আসন্ন দিনগুলোতে দেশের মানুষকে খাদ্যাভাব থেকে রক্ষা করতে পারে।
লেখক: প্রবাসী শিক্ষার্থী