গোটা বাংলাদেশই কি ধর্ষণের উর্বর ভূমি?
৬ অক্টোবর ২০২০ ০১:২৯
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি— এই চরণে দেশের প্রতি যেমন মায়া, মমতা,ভালবাসা আর দরদ রয়েছে তেমনি সকল মানুষের প্রতি সবার মায়া, মমতা, ভালবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ। কিন্তু এই শব্দগুলো আজ হারিয়ে গিয়েছে। ম্লান হয়েছে সবকিছু। প্রতিহিংসা, ক্রোধ, হানাহানি আর নৃশংসতা নতুন মাত্রায় রূপ নিয়েছে। প্রতিমুহূর্তে বাড়ছে ধর্ষণের সংখ্যা। কিন্তু কেন? নারীর প্রতি এতো নৃশংসতা কেন?
নারী মানে মা, বোন, স্ত্রী,সন্তান ইত্যাদি। যে মা দীর্ঘ ১০টি মাস প্রসব বেদনা সহ্য করে পৃথিবীতে নতুন অতিথির আগমন ঘটায়, সেই মাকেই কিনা ধর্ষণের শিকার পরিচয় বহন করতে হয়। কিন্তু আমি বলব, যে ধর্ষক তার কোনো পরিচয় নেই। সে মানুষ নয় সে নরপশু। তার পরিচয় সে ধর্ষক সে কুলাঙ্গার। এটাই তার একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত।
এই তো কদিন আগে ঘটলো সিলেটে ধর্ষণের ঘটনা। যার রেশ এখনো কাটেনি। স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিলেন স্ত্রী। এরপরের ঘটনা সবার জানা। একবার ভেবেছেন কি— স্বামীর সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ, এর চেয়ে বেদনার আর কী হতে পারে? হয়তো শকুনের দলগুলো যখন স্ত্রীকে খুবলে খুবলে খাচ্ছে, স্বামীর তখন তিলে তিলে মৃত্যু হচ্ছে। সেই ঘটনায় কিছু নরপিশাচ গ্রেফতার হয়েছে। হয়তো তারাও বাঁচতে নতুন কোনো জাল বুনছে।
এবার আসি রোববারের ঘটনায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই ভিডিও দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। একটি নারীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন মিলে হায়েনার মতো খুবলে খাচ্ছে। ওরা যেন হিংস্র পশুর চেয়ে ক্ষুধার্ত। ঘটনাটি নোয়াখালীর। এটাই কি আমার বাংলাদেশ। এটাই কি আমার জন্মভূমি। এটাই কি আমার চিরচেনা ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটারের ভূখণ্ড। যে দেশের জন্য ৩০ লাখ প্রাণ অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলো, ২ লাখ মা-বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছিল। তাহলে কি তারা ভুল করেছিলো দেশকে সোনার বাংলায় রূপ দিতে চেয়ে?
দেশকে স্বাধীন করতে যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিল, তাদের দেশপ্রেমের উপহার হিসেবে দিচ্ছি ধর্ষণ? তাহলে গোটা বাংলাদেশই কী ধর্ষণের উর্বরভূমি?
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮৮৯ জন নারী। ধর্ষণের পরে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। এছাড়া ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যা ২০১৮ সালে প্রায় অর্ধেক—৭৩২ জন। এছাড়া ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী। আর ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ জন নারী।
এতো গেল কেবল যেসব ঘটনা সামনে এসেছে সেসব ঘটনার পরিসংখ্যান। আর যারা সম্মান আর বেঁচে থাকার তাগিদে কিংবা ভয়ে প্রকাশ করেন না সেসব ঘটনা হয়তো অধরাই থেকে যায়। এভাবে হয়তো প্রতিদিন কোনো না কোনো স্বপ্নের অপমৃত্যু হচ্ছে। ধ্বংস হচ্ছে নারীর ভবিষ্যত।
এই লেখা যখন লিখছি তখন আপনাদের একটু পিছনের দিকে নিয়ে যেতে চাই, আপনাদের হয়তো মনে আছে ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাসরঘর সাজিয়ে প্রতি রাতে একজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হতো। এভাবে শতক ধর্ষণ পূরণ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে মিষ্টি বিতরণ করে উল্লাস করেছিলো তখনকার ক্ষমতাসীন দলের জসিমউদ্দীন মানিক। এরও একটা বিচার হয়েছিলো, তবে ফাঁসি হয়নি!
দিবালোকে রামদা দিয়ে রাস্তায় প্রকাশ্যে খাদিজাকে কুপিয়ে তার মাথা কয়েকভাগ করে সিলেটের বদরুল। হয়তো ভুলে গিয়েছেন সেই ঘটনা। খাদিজার ভাগ্য ভালো মরতে মরতেও তিনি বেঁচে গিয়েছেন। তবে বদরুলেরও একটা বিচার হয়েছে কিন্তু খুব বেশি শাস্তি হয়নি। ২০১৮ সালে বরিশালের বানারিপাড়ায় মা-মেয়েকে একসাথে ধর্ষণ করে মাথা নেড়া করে দেয় প্রভাবশালী তুফান। তুফানেরও একটা বিচার হয়েছে তবে ফাঁসি হয়নি।
২০১৬ সালের ২০ মার্চের ঘটনা নিশ্চয় মনে আছে আপনাদের। তখন দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিলো। তনুকে ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। সেই ঘটনায় এখনো কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তবে জাতি আশাবাদী তনু হত্যার বিচার হবে। ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৮ নোয়াখালীর সুবর্ণচরে দিনেরবেলা যুবতি মেয়ের সামনে তার মাকে দল বেধে ধর্ষণ করা হয়। হয়তো এটাও ভুলে গিয়েছেন? শুধু কি ধর্ষণ তখন প্রহারও করা হয়। ধর্ষক রুহুল আমীনের ফাঁসির দাবিতে তখন উত্তাল গোটা দেশ কিন্তু ফাঁসি হয়নি। ৩ বছরের শিশুর যৌনাঙ্গ ব্লেড দিয়ে কেটে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। মিডিয়া যা ফলাও করে প্রচার করে। সেই ধর্ষকও গ্রেফতার হয়। তবে ফাঁসি কিন্তু হয়নি।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের বিভিন্ন সাজা রয়েছে যেমন, আমেরিকাতে ধর্ষণের সাজা ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, রাশিয়া- ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, চীনে কোনো ট্রায়াল নেই, মেডিকেল পরীক্ষার পর মৃত্যুদণ্ড। পোল্যান্ডে হিংস্র বুনো শুয়োরের খাঁচায় ফেলে মৃত্যুদণ্ড। মধ্যপ্রাচ্য আরব দুনিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত পাথর ছুড়ে মৃত্যু, ফাঁসি, হাত-পা কাটা, যৌনাঙ্গ কেটে অতি দ্রুততার সাথে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া। সৌদি আরবে শুক্রবার জুম্মা শেষে জনসম্মুখে শিরশ্ছেদ। দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০ বছরের কারাদণ্ড। মঙ্গোলিয়ায় ধর্ষিতার পরিবারের হাত দিয়ে মৃত্যুদণ্ড। আফগানিস্তান ৪ দিনের ভিতর গুলি করে হত্যা, মালয়শিয়ায় মৃত্যুদণ্ড।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই, প্রতিদিন জানা-অজানা কতো মা-বোন ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তার হিসাবটা কি রাখা হচ্ছে? ধর্ষণের পরে ধর্ষকের বিচারের দাবিতে দেশ উত্তাল হয়। এরপর ধর্ষক জেলেও যায় কিন্তু সময়ের আবর্তনে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হলেই অদৃশ্য ক্ষমতার দাপটে ধর্ষকরা পার পেয়ে যায়। শুধু দরকার উপযুক্ত শাস্তি। এমন শাস্তি, যা দেখে প্রকম্পিত হবে গোটা দেশ। তাহলেই নারীর প্রতি বদলাবে দৃষ্টিভঙ্গি। বাড়বে নারীর প্রতি মমত্ববোধ, আর দেশের মাটি হবে কলঙ্কমুক্ত।
লেখক: সাংবাদিক, সারাবাংলা ডটনেট