যেকোনো ধর্ষণের শাস্তি চাই দ্রুত ফাঁসি
৬ অক্টোবর ২০২০ ১৪:৫৩
একাধিক মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। নাম বলবো না তাদের। তারা মানুষ। তারা নারী। তাদের বেশিরভাগই মানসিক যন্ত্রণায় পার করছেন দিন। চারদিকে ধর্ষণ যেভাবে বেড়েছে, তাতে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন তারা। খুব কষ্ট পাচ্ছেন। রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা-ধিক্কার-মন খারাপ। শঙ্কায় আছেন নিজেদের নিয়েও।
পরিস্থিতি এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, স্বামীর সঙ্গেও নারীরা নিরাপদ নয়। যে বাড়িকে বলা হয়, প্রার্থনার ঘর থেকেও নিরাপদ, সেখানেও নিরাপত্তা নেই। কী সমতল কী পাহাড়- হিংস্র ধর্ষকের থাবা যেকোনো বাংলাদেশি নারীর জন্য এখন এক আতঙ্ক। ধর্ম-জাত-পাতহীনভাবে বাদ নেই কেউ। এই অভিশাপ দিন দিন আরও জোরালো হচ্ছে। সিলেটের এমসি কলেজ, খাগড়াছড়ি শহর কিংবা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ— সাম্প্রতিক সময়ের ধর্ষণের একটা প্রতীক মাত্র। এই ঘটনাগুলো ছাড়াও জেলায় জেলায় প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ধর্ষণকাণ্ড। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যার অনেকগুলোর সঙ্গে জড়িত। এমনকি নতুন করে সিলেটে পাঁচ সন্তানের জননীকেও ছাড়া হয়নি। এ ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক লীগ নেতা।
ক্ষমতা আছে, ধর্ষণ করবেন, এ কেমন মানসিকতা। তাহলে ক্ষমতা কি বর্বর হতে শেখায়? প্রভাব কি অসম্মান করতে শেখায়? দাপট কি নারীকে বেইজ্জত করার জন্য? আমি বিস্মিত, পাই না ভেবে কিছু। শুধু জানি সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এর একটা কঠিন পথ আমাদের বের করতে হবে। জনগণকে হতে হবে এক। পাশাপাশি খেয়াল রাখতে হবে নির্যাতনের শিকার নারীর মানসিক অবস্থার দিকে।
ধর্ষণের আইন নিয়ে নতুন করে ভাবার আছে। ধর্ষণের একমাত্র সাজা ফাঁসি হওয়া উচিত। আইন অনুযায়ী, যদি কোনো পুরুষ নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। সঙ্গে হতে পারে কিছু অর্থদণ্ড। আর ধর্ষণের কারণে যদি নারীর মৃত্যু হয়, তাহলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু যেকোনো ধর্ষণের বিচারেই মৃত্যুদণ্ড হওয়া বাঞ্ছনীয়। এতে ধর্ষণ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না। এছাড়া ধর্ষণ মামলার বিচার হওয়া প্রয়োজন দ্রুত। কার্যকরও হতে হবে দ্রুততার সঙ্গে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে লকডাউনের সময়ে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ায় ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। অনেকটা বাংলাদেশের মতো। আর তাই ধর্ষণ নিয়ে কঠোর হতে বাধ্য হয়েছে দেশটির একটি রাজ্য। প্রণয়ন করা হয়েছে নতুন আইন। এতে ধর্ষণের দায়ে কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে শাস্তি হিসেবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাকে নপুংসক (খোজাকরণ) করে দেয়া হবে। সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডও থাকছে (Castration and Death)।
সেখানকার কর্তৃপক্ষ বুঝেছে, ধর্ষণের মতো ভয়ানক অপরাধ থেকে নারী-শিশুদের বাঁচাতে এমন কঠিন শাস্তি বিধানের কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদেরও খোজাকরণ বা লিঙ্গ কেটে দেওয়ার পদ্ধতি আইনে সংযুক্ত করার দাবি রয়েছে বিভিন্ন মহলে। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডও প্রয়োজন। প্রশ্রয়দাতাদেরও বিচার করতে হবে। তাই আইন নিয়ে ভাবার কথা বললাম। সাজা এমন হয় যেন, একজন ধর্ষক তার প্রকৃত শিক্ষা পেয়েই মরবে। আর অন্য যারা এমন চিন্তা করেন, তারা কল্পনাতেও এটি ভাববেন না। সমাজে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরবে। নারীরা পাবে সুন্দর প্রকৃতি। নিরাপদ হবে সবার চলাফেরা। বাড়বে স্বাধীনতা। দূর হবে বৈষম্য।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে রয়েছে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। বিশ্বের মধ্যে যা বিরল। বিরল বলছি এই অর্থে যে, আমরা শিক্ষিত ও উন্নত রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করছি, কিন্তু বিচারহীনতার পরিসংখ্যান উপরের দিকে। দেখা যাচ্ছে, আন্দোলন বা বড় ধরনের আওয়াজ না উঠলে বিচার প্রক্রিয়া খুব ধীর গতিতে চলে। সেটা গ্রেফতার থেকে শুরু করে বিচার কাজ শুরু করা পর্যন্ত। এ থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। কেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে হবে? তার আগে কেন আসামি গ্রেফতার হয় না? পুলিশ কেন উদাস থাকবে প্রথমে? আর গ্রেফতার হলেও কেন আসামি সহজে জামিন পায়? প্রচলিত আইনের প্রয়োগেই হতে পারে সুষ্ঠু বিচার, কিন্তু এর প্রয়োগে সমস্যা কেন পরতে পরতে? কী কী সংশোধন প্রয়োজন? ধর্ষণের আসামির জামিন অযোগ্য হওয়া উচিত। তাছাড়া সাক্ষীর নিরাপত্তাও আমরা দিতে পারি না। পাশাপাশি দুর্বল সাক্ষী তৈরি হয়। এতে ধর্ষক পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। এমনকি সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালাস পাওয়ার নজিরও অনেক। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৯০ শতাংশ আসামিই খালাস পেয়ে যান। দায়সারা ভাব রয়েছে প্রসিকিউশনে। রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি (পিপি) কেন আরও সচেতন হন না? তড়িৎ কেন তারা কাজ করেন না? এসব নিয়ে কতশত প্রশ্ন- উত্তর দেবে কে? এখন সময় এসেছে এসব বিষয় স্পষ্ট করার। আইন ও বিচার বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করতে না পারলে সংকটের সমাধান দেখি না।
করোনাভাইরাসের কারণে গেলো কয়েক মাস সবকিছু সীমিত আকারে চলার পর, যখন সব খুলে দেওয়া হলো, হুট করে বাড়ল ধর্ষণ। তাই বসে থাকার সুযোগ নেই কর্তৃপক্ষের। বিচার দ্রুত করতে হবে। এমনকি যারা ক্ষমতায় (সরকারি দলের সমর্থক ছাত্র ও অঙ্গ সংগঠন) তারাই যখন ধর্ষকের ভূমিকায়, তখন বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। এই সন্দেহ দূর করতে হবে। সরকারকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিতে হবে যে, বাংলাদেশের বড় বড় সব রায় ও তা কার্যকর এই আওয়ামী লীগের আমলে হয়েছে, তাহলে কেন ধর্ষণের রায় জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর হবে না? ধর্ষকদের বিচারের আওতায় আনতে আলাদা ট্রাইব্যুনালও গঠন করা যেতে পারে।
ধর্ষণ থামানো না গেলে একটি রাষ্ট্রের পঙ্গু হতে বেশি সময় লাগে না। ধর্ষণের শিকার নারীর জীবন হয়ে পড়ে লণ্ডভণ্ড। সারা জীবন বয়ে বেড়ান মানসিক ক্ষত। আর যারা মনের বলে উঠে দাঁড়ান তারা কী করে পুরুষ জাতকে ক্ষমা করবেন! একজন সুস্থ মা দিতে না পারলে সুস্থ সন্তান ও আগামী কী করে আমরা আশা করি! আমরা সমাজে বৈষম্য দূর করার কথা বলি। একদিকে ধর্ষণ করে নারীর মনোবল ভেঙে ফেলবো, অন্যদিকে বৈষম্য দূর করতে উদ্যোগ নেবো- তা কোনো দিন হতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পহেলা অক্টোবর জাতিসংঘের ভার্চুয়াল ভাষণে বলেছেন, বাংলাদেশে নারী-পুরুষের অধিকার সমান। দক্ষিণ এশিয়ার যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠ অবস্থানে। এমনকি বিশ্বেও আমাদের অবস্থান অনেক উপরের সারিতে। কিন্তু কথা হলো, ধর্ষণ বন্ধ না হলে এই ক্ষমতায়নের সুফল আসবে কী করে। সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্নীতি যেমন বন্ধ করা প্রয়োজন, তেমনি ধর্ষণও বন্ধ করা জরুরি। শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে ধর্ষণের ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী নিজে একজন নারী। তিনিই ভালো বোঝেন, আরেক নারীর কান্না। এক্ষেত্রে তার আরও কঠোর হওয়ার সময় এসেছে, বিশেষ করে নিজ দলের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে। সরকারের একাধিক মন্ত্রী ইতিমধ্যে বলেছেনও ছাড় না দেওয়ার কথা। কিন্তু আমরা চাই, দৃষ্টান্তমূলক বিচার— ফাঁসি।
ভারতে গড়ে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি করে ধর্ষণ হয়, প্রায়ই যা নিয়ে সমালোচনা করি আমরা। তুলি প্রশ্ন। অথচ নিজের দেশের দিকে কি তাকিয়ে দেখছি? সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশে ধর্ষণের একটা ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছে সারা ভারত। ফাঁসির দাবিতে বিভিন্ন রাজ্যের রাস্তায় লাখ লাখ প্রতিবাদী মানুষ। অথচ বাংলাদেশে একের পর এক ধর্ষণের পরও আমরা ক’জন করেছি প্রতিবাদ? ক’জন নেমেছি রাস্তায়? ধর্ষণ রোধে শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, রাজপথে নেমে প্রতিবাদ করতে হবে। তীব্র প্রতিবাদ। বাম, প্রগতিশীল জোট কিংবা সচেতন মহলের একাংশ নয়, প্রত্যেক নাগরিকের একান্ত দায়িত্ব ধর্ষকের বিচারের দাবিতে একজোট হওয়া। নিজের মা, বোন অথবা আত্মীয় ধর্ষণের শিকার হবেন, আর তখন আপনি আওয়াজ তুলবেন— সে অপেক্ষা করলে পরবর্তী ভিকটিম আপনারা কেউ হবেন না, তা কি আপনি বুকে হাত রেখে বলতে পারেন?
লেখক: লেখক, সাংবাদিক