Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সমাজে একটি শুভ পরিবর্তন ঘটাতে হবে


৬ নভেম্বর ২০২০ ১৮:৫১

মুরুব্বীরা বলেন যারা গুজব ছড়ায় তারা কখনো ভালো মানুষ হতে পারে না। তারা নষ্ট মানুষ। নষ্ট মানুষরাই গুজবের মতো ভয়াবহ বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তারা, অর্থাৎ নষ্ট মানুষেরা গুজব ছড়িয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজের মাঝে জঘন্য রকমের অস্থিরতা সৃষ্টি করে থাকে। গুজব সৃষ্টিকারীরা এমন সব বিষয় নিয়ে গুজব ছড়িয়ে থাকে, যা সমাজ জীবনে ভয়াবহ বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। প্রত্যেক যোগেই প্রত্যেক সমাজে এবং রাষ্ট্রে গুজব সৃষ্টিকারীরা গুজব ছড়িয়ে নিজেদের হীনস্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে পরের ঘরে আগুন দিতেও পিছপা হয়নি। গুজবের পিছনে মানুষ কোনো কিছু না ভেবেই কিংবা সত্য মিথ্যার যাচাই-বাছাই না করে ছুটতে থাকে। একবারও সত্য মিথ্যার যাচাই-বাছাই করার কথা মানুষের মাথায় আসে না। ভাবনায় ছেদ পড়ে তখনই, যখন গুজবের পিছনে ছুটতে গিয়ে একটা অঘটন ঘটিয়ে থাকে।

বিজ্ঞাপন

সরকার যখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে শুরু করল, তখন দেখা যায় এক শ্রেণীর গুজব সৃষ্টিকারী সক্রিয় হয়ে বিপদজনক বিষয় নিয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। গুজব সৃষ্টিকারীরা এই বলে গুজব ছড়াতে থাকে যে, পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের মাথার প্রয়োজন পড়েছে। তাই ছেলে ধরারা কোমলমতি শিশুদের তুলে নিচ্ছে। শিশুদের মাথা পদ্মা সেতুর জন্য ব্যবহার করছে। এই গুজবের পেছনে ছুটতে গিয়ে মানুষ দিশাহারা হয়ে এলাকার নিজস্ব পরিচিতজনদের বাইরে কাউকে দেখলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ছেলে ধরার অপবাদ দিয়ে গণপিটুনি দিতে শুরু করে। এভাবে অনেক মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে বিপদজনক অবস্থায় পড়ে। এমনকি গুজবের জন্য গণপিটুনিতে আক্রান্ত হয়ে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছে। নিশ্চয়ই সকলের জানা আছে কিংবা পত্র-পত্রিকায় দেখতেও পারেন, ঢাকার এক মহিলা তার বাচ্চাকে স্কুলে ভর্তি করার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নিতে গিয়ে কতগুলো অসভ্য-বর্বর মানুষ দ্বারা গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান। শেষে মামলা হয়। আসামিও ধরা পড়ে। এখন ঘটনাটির বিচার শেষের অপেক্ষায় আছে। গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যাওয়া মহিলার বাচ্চাটি বড় হয়ে যখন বুঝবে তার মা তাকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছেন, তখন চরম ধিক্কার থেকে গণপিটুনিতে অংশগ্রহণ করা বর্বর মানুষগুলোসহ এ সমাজকে শুধু অভিশাপ দিয়ে যাবে এবং নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলবে।

বিজ্ঞাপন

মাঝে মধ্যে মনে হয় আমরা এখনো সভ্য সমাজের মানুষ হতে পারিনি। আজকের দিনেও একশ্রেণীর মানুষ হিংস্র অসভ্য ও বর্বর রয়ে গেছে। সভ্য সমাজের সভ্য মানুষ হতে হলে আমাদের মধ্যে অবশ্যই নৈতিকতা কিংবা মূল্যবোধের প্রকাশ ঘটাতে হবে। একটা সভ্য সমাজের মানুষ কখনো একজন মানুষের ওপর হাত তুলতে পারে না। একজন লোক যতোই অপরাধী হোক না কেন তার বিচার করবে আদালত। একজন লোক সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট আদালতে বিচার প্রার্থী হতে পারে। বিচার প্রার্থী হয়ে অপরাধের বিনাশ ঘটানোর জন্যই নৈতিকতার ভিতর থেকে সে অপরাধের মূলোৎপাটন করতে পারে। সমাজে এমন লোকও আছে যারা ধরা পড়া একটা চোর কিংবা ডাকাতের ওপরও হাত তুলতে পারে না। চুরির অপরাধে কাউকে গণপিটুনি দিতে দেখলে তার মন-প্রাণ কেঁদে ওঠে সভ্যতার বিপর্যয় দেখে। এসব কোমল প্রাণ মানুষদেরকে আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর ভদ্রলোকেরা বোকা কিংবা অথর্ব বলে থাকেন। তাই আজ মনে হয় এসব কোমল প্রাণ কিংবা অথর্ব মানুষের সংখ্যা যদি আমাদের সমাজ সংসারে কিংবা রাষ্ট্রের সকল স্তরে বৃদ্ধি পেত, তাহলে একশ্রেণীর মানুষ ছোট ছোট চোরকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলত না এবং রাষ্ট্রের সম্পদ হরণকারী একশ্রেণীর বড় চোরকে কোন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি করতো না। এবং তাতে আমাদের সমাজে একটা শুভ পরিবর্তন ঘটতো।

পদ্মা সেতুর গুজব শেষ হওয়ার পর গুজব সৃষ্টিকারীরা শুরু করল কোভিড-১৯ নিয়ে গুজব ছড়ানো। গুজব সৃষ্টিকারীরা কোভিড-১৯ নিয়ে মিথ্যা ভিত্তিহীন কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলতে শুরু করল। যা মনে আসে গুজব সৃষ্টিকারীরা তাই বলতে লাগলো। গুজব সৃষ্টিকারীরা দেশের মান-সম্মানের কথা না ভেবে এমন কথাও বলতে লাগল যে, যথাযথ কর্তৃপক্ষ করোনা আক্রান্ত রোগীর সঠিক হিসাব বলছে না। কোভিড-১৯ মহামারির প্রথম দিকে গুজব সৃষ্টিকারীরা এই বলে গুজব ছড়াতে লাগলো যে, মুজিববর্ষে বিদেশি অতিথিরা আসবেন বলে কোভিড-১৯ নিয়ে কর্তৃপক্ষ জনগণের সাথে লুকোচুরি খেলছে। যারা এমন গুজব ছড়ায় তারা একবারও ভাবে না যে, তাতে জনগণের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি দেশের ভাবমূর্তিও আন্তর্জাতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

অভিযোগ করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য তথ্য দিয়ে নিয়মিত বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়াতে একটা অন্য ধরনের পরিবেশ সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি দিয়ে কর্তৃপক্ষ একটি বিজ্ঞপ্তিও পাঠিয়েছেন। বলা হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ানোর জন্য অনেক তথ্য হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে সত্যতার ঘাটতি রয়েছে বা অপলাপ হচ্ছে। বলা হচ্ছে নিয়মিত বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য বিভিন্ন মিথ্যা খবর প্রচার করা হচ্ছে। আদালতের রায়ের সমালোচনা করা হচ্ছে। দেশের মাঝে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য মিথ্যা ও অসত্য কথা প্রচার করা হচ্ছে। দেশের মানুষের মাঝে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য যারা নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসত্য তথ্য প্রচার করছেন তারা কি একবার ভাবছেন, তারা কোন আগুন নিয়ে খেলছেন? যে আগুনের শিখায় দেশের মানুষের শুভ ভালো দিকগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

আমাদের প্রত্যেকেরই জেনে রাখা উচিত আমরা যে মতেই বিশ্বাস করি না কেন, দেশ কিন্তু আমাদের সবার। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এমন কোন কাজ করা উচিৎ হবে না, যে কাজের জন্য দেশের মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের এটুকু মনে রাখা উচিত, দলের কিংবা নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করতে গিয়ে দেশবাসীকে যেন তারা বিপদে না ফেলেন। দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে কিংবা সুশীল সমাজের কাছ থেকে এমন কোন কর্মকাণ্ড আমরা জনগণ আশা করি না, যে কর্মকাণ্ডের ফলাফল ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে রাজনৈতিক চিন্তা চেতনার বিচার না করে, যারা প্রকৃত অপরাধী তাদেরকেই আইনের আওতায় এনে বিচার করা। আমাদেরকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, গুজব রটনাকারীরা খুবই নৃসংশ, তারা চরম স্বার্থবাদী, তারা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য এমন কোন কাজ নেই, যা তারা করতে পারে না। একজন কবি যেমন সকল সময় কবিতার ছন্দ খুঁজে বেড়ায়, ঠিক তেমনি একজন নষ্ট গুজব সৃষ্টিকারী গুজবের সূত্র খুঁজে বেড়ায়। এখন গুজব সৃষ্টিকারীরা ধর্ষণকে গুজবের সূত্র হিসাবে হাতে নিয়েছে। ধর্ষণ শব্দটাকেই তার এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যেন এটা এক গুরুত্বহীন শব্দ। এটা নিয়ে গুজব ছড়ানো যায়, এটা নিয়ে কোন নারীর চরিত্র নষ্ট করা যায় এবং এই শব্দটাকে গুজব সৃষ্টিকারীরা এতটাই হালকা করেছে যে, যেন এটা একটা খেলার জিনিস। আশা করি পাঠকরা আমার কথাটার ভিতরের দিকটা বুঝতে পেরেছেন।

আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে, গুজব সৃষ্টিকারীরা সমাজ এবং রাষ্ট্রের শত্রু। তারা, অর্থাৎ গুজব সৃষ্টিকারীরা মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারে কিংবা চরম হিংস্রতায় মেতে উঠতে পারে। তাদের হৃদয় বলতে কিছু নেই। গুজব সৃষ্টিকারীরা তাদের হীনস্বার্থ উদ্ধার করার জন্য যে কোন ধরনের জঘন্য কাজ করতে পারে। এসব গুজব সৃষ্টিকারীদের কাছে আপন স্বজন, ভাই-বন্ধু, সন্তান কোনো বিষয় নয়। গুজব রটনাকারীরা সকল সময় ক্ষতিকারক চিন্তা-ভাবনা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাতে যদি দেশ ও রাষ্ট্রের চরম ক্ষতি হয় তবুও গুজব রটনাকারীরা গুজব ছড়ানো থেকে পিছপা হয় না। তাই দেশবাসীকে খুবই সচেতন থাকতে হবে। কেউ যদি বলে যে, চিলে কান নিয়ে গেছে, আগে নিজের কানে হাত দিয়ে দেখতে হবে নিজের কান কানের জায়গায় আছে কি না।

লেখক: আইনজীবী, কবি ও গল্পকার

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর