‘জয়বাংলা বলতে মনরে আমার’
১৬ মার্চ ২০১৮ ১৪:০২
“শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের সময়ও কলেমা পাঠের সঙ্গে ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করব আমি” –বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হ্যাঁ, একাত্তরের অগ্নিঝরা মার্চে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের ব্যাখ্যা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বীরের বেশে গর্ব করে বাঙালি হিসেবে ঠিক এভাবেই ‘জয়বাংলা’-র ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের রুদ্রধ্বনি শিহরণ জাগা স্লোগান ‘জয়বাংলা’! সারা পৃথিবী কাঁপানো ঝাঁজালো স্লোগান ‘জয়বাংলা’।
‘জয়বাংলা’ শুধু একটি এবং একটি স্লোগানে দেহে শিহরণ জাগে, হৃদয় আন্দোলিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই হৃদয়গ্রাহী শ্রুতিমধুর স্লোগানে শরীরে একটা অলৌকিক শক্তি এসে যায় এবং বীর বাঙালির টগবগে রক্তে এক অজানা কাঁপন ধরিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধের রুদ্রধ্বনি ‘জয়বাংলা’ ছিল অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণের প্রণোদনা। মহান মুক্তিযুদ্ধের শক্তির প্রতীক- দেশপ্রেম প্রকাশের প্রতীক ‘জয়বাংলা’ যা’ মুক্তিযোদ্ধাদের এনে দিতো অদম্য শক্তি। ‘জয়বাংলা’ বীর বাঙালির প্রাণের স্লোগান- যা বাঙালির প্রাণে নতুন স্পন্দন যোগাতো। ‘জয়বাংলা’ হলো প্রাণের ধ্বনি, হৃদয়ের ধ্বনি, মুক্তির ধ্বনি, যুদ্ধ জয়ের ধ্বনি, সুদীপ্ত সাহসের ধ্বনি। ‘জয়বাংলা’ হলো অগ্রগতির পাথেয়, জয়ের শক্তি। ‘জয়বাংলা’ হলো গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের হৃদয়ের স্লোগান, চেতনার স্লোগান, মাটির স্লোগান। ‘জয়বাংলা’ হলো মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মার ধ্বনি।
এই ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিজের জীবনকে হাসি মুখে বাংলা মায়ের জন্য উৎসর্গ করে দিতেন মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়ে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত করে আমরা বাঙালিরা হানাদার বর্বর নিরপিশাচ, গণহত্যাকারী নারীধর্ষক মরুপশু কুখ্যাত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটা অবিশ্বাস্য অলৌকিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম এবং দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধের পর এই ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়েই ১৬ ডিসেম্বর ’৭১ পাপাশ্রয়ী গণধিক্কৃত নারী ধর্ষণকারী কাপুরুষ ‘জিন্দাবাদধারী’ হানাদার পাকিস্তানিদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ-এর মাধ্যমে হিংস্র শ্বাপদের ভয়াল থাবার নখর-দন্তের বিষাক্ত ছোবল থেকে সেদিন শহীদের রক্তে ভেজা সবুজ বাংলার পবিত্র মাটি মিত্র ও মুক্তিবাহিনী উদ্ধার করে ‘চাঁনতারা মার্কা বেইমান পতাকা’-কে চিরদিনের জন্য নামিয়ে বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সম্বলিত ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়িয়ে দেয়।
‘জয়বাংলা’ শুধু একটি মামুলি স্লোগান নয়- বাংলার সবুজ মাঠ, নদী, বন-বনানী তথা টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ার দিগন্ত কাঁপানো এই অগ্নিঝরা স্লোগান বাঙালির মহান মুক্তিযুদ্ধের শানিত অস্ত্রও- বাংলার বাঘের গর্জনের মতো একাত্তরের রণহুঙ্কার এই ‘জয়বাংলা’ স্লোগান শুনে জিন্দাবাদওয়ালা নরপশু পাকিস্তানিরা এবং তাদের এ দেশীয় দোসর স্বাধীনতা বিরোধীরা থরথর করে কাঁপতো এবং তাদের পরিধেয় বস্ত্র নষ্ট করে ফেলতো। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে ‘জয়বাংলা’র অনুসারী বনাম কুখ্যাত ‘জিন্দাবাদ’ ওয়ালাদের মধ্যে- যেখানে অলৌকিক শক্তিধর ‘জয়বাংলা’র কাছে গণহত্যাকারী নারীধর্ষক ‘জিন্দাবাদধারী’দের বাংলার পবিত্র মাটিতে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ-এর মাধ্যমে শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল।
‘জয়বাংলা’ ছিল মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান, বাঙালির স্লোগান, যুদ্ধে যাবার স্লোগান, যুদ্ধে বিজয়ের স্লোগান- অথচ বীর বাঙালির একাত্তরের রণহুঙ্কার এই ‘জয়বাংলা’ অনেকদিন কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল- আসলে কি হারিয়ে গিয়েছিল? না, হারিয়ে যায়নি- মুক্তিযুদ্ধের এই স্লোগানকে ইচ্ছে করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল- স্বাধীনতার এতো বছর ধরে সে স্লোগান আমরা হৃদয়ে অত্যন্ত যত্ন করে ধারণ করে রেখেছি। ২০১৩-তে এসে তরুণ প্রজন্মের নিরস্ত্র মুক্তিযোদ্ধারা শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের মাধ্যমে একাত্তরের রণহুঙ্কার এই ‘জয়বাংলা’কে আবার ফিরিয়ে এনে বিস্ময়কর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তারা সারা বাংলাদেশের গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে- নতুন প্রজন্মের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো একাত্তরের রণাঙ্গনের স্লোগান ‘জয়বাংলা’। পূর্বপুরুষের রক্তের মধ্য দিয়ে এ প্রজন্মের দেহে ও হৃদয়ে ‘জয়বাংলা’ স্লোগান এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত রয়েছে- সেটাই প্রমাণ হলো এবং ‘জয়বাংলা’ আজ বাঙালি জাতির তথা বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে- ‘জয়বাংলা’ আবার মুক্তি পেল এবং মনে হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্নিকণ্ঠে নিঃসৃত অমোঘ স্লোগান ‘জয়বাংলা’ আবারো অগ্নিগর্ভ হয়ে ফিরে এসেছে সারা বাংলায়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তথা এদেশের স্বাধীনতার শত্রু ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে কর্মসূচি এবং মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ স্লোগান ১৬ কোটি বাঙালিকে বিপুলভাবে আন্দোলিত করেছে- যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত বাঙালির প্রাণে নবজাগরণের উদ্ভব ঘটিয়েছে। এরই মধ্যে ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের আওয়াজ পৌঁছে গেছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। তাই আজ ’৭১ এর মতো প্রাণ ফিরে নূতন ভাবে জেগে উঠেছে ‘জয়বাংলা’- এতো বছর পর ‘জয়বাংলা’র বীরের বেশে প্রত্যাবর্তন! কী যে আনন্দ বাংলার ঘরে ঘরে! এই অনুভূতি আজ কীভাবে প্রকাশ করবো! মনে হচ্ছে এই কালজয়ী স্লোগান ‘জয়বাংলা’ হঠাৎ করে স্বর্গ থেকে নেমে এসেছে। ‘জয়বাংলা’ ১৬ কোটি বাঙালি তথা বিশ্বের ৩০ কোটি বাঙালিও যেন সাথে সাথে আজ জেগে উঠলো এক নূতন শক্তিতে- পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই এই বীরের জাতি তথা ‘জয়বাংলা’র বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার।
কাজী নজরুল ইসলাম ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।” ৭ মার্চ ’৭১ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ ‘জয়বাংলা’ স্লোগান দিয়েই সমাপ্ত করেছিলেন। ২৭ মার্চ ’৭১ সন্ধ্যায় মেজর জিয়াউর রহমান কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করার শেষে ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা সংগীত ছিল- ‘জয়বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি দিয়ে এবং অনুষ্ঠান সমাপ্তি ঘোষণা করা হতো ‘জয়বাংলা’ উচ্চারণ করে। ‘জয়বাংলা’ স্লোগান-এর মাধ্যমে আমরা বাঙালিরা পেয়েছি একটি মানচিত্র- একটি লালসবুজ পতাকা- একটি জাতীয় সংগীত- অর্থাৎ ‘জয়বাংলা’ আমাদের আত্মপরিচয়- জাতীয় ঐক্যের প্রতীক- এককথায় বাংলাদেশের পরিচয়ই হলো ‘জয়বাংলা’।
মহান মুক্তিযুদ্ধকে যারা বিশ্বাস করে না- তারা ‘জয়বাংলা’-কে বিশ্বাস করে না। যারা বাংলাদেশের মানচিত্রকে বিশ্বাস করে না- যারা বাংলাদেশের লালসবুজ পবিত্র পতাকাকে বিশ্বাস করে না- যারা বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতকে বিশ্বাস করে না- তারা ‘জয়বাংলা’কেও বিশ্বাস করে না। যারা ‘জয়বাংলা’কে বিশ্বাস করে না- তারা ‘চাঁনতারা মার্কা বেইমান পতাকা’র অনুসারী- যারা ‘জয়বাংলা’কে বিশ্বাস করে না, বা ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান দিতে ভয় পায়- তারা বাঙালি না- তারা ‘জিন্দাবাদওয়ালা’ পাকিস্তানিদের চেয়েও বেশি খাঁটি পাকিস্তানি এবং তারা রাজাকার পর্যায়ভুক্ত। যারা এই ‘জয়বাংলা’-কে বিশ্বাস করে না বা মেনে নিতে পারছে না- সিকান্দার আবু জাফর-এর ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতার ভাষায় বলবো- “তুমি আমার জলস্থলের মাদুর থেকে নামো,/ তুমি বাংলা ছাড়ো।।”
অনেক বছর পর রক্ত দিয়ে কেনা হারিয়ে যাওয়া প্রিয় ‘জয়বাংলা’ স্লোগান আমার দুঃখিনী বাংলা মায়ের বুকে আবার ফিরে এসেছে- তাই ‘জয়বাংলা’কে হারিয়ে এতোদিন আমার বাংলা মা নিরবে নিভৃতে অনেক কেঁদেছে- কাঁদতে কাঁদতে তাঁর ‘শুকায়ে গিয়াছে আঁখি জল’। তাই চিরভাস্বর ‘জয়বাংলা’কে আমরা আর হারাতে চাই না এবং আমার বাংলা মাকে আর কাঁদাতে চাই না। পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই বাঙালির এই অলৌকিক শক্তিধর ‘জয়বাংলা’কে ছিনিয়ে নেওয়ার।
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা কোনোদিন ‘জয়বাংলা’ ছাড়া কোনো ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেইনি- কিন্তু আমার বাংলা মায়ের রক্তে কেনা ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে বাদ দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চরমভাবে অপমানিত করে সেই পরাজিত হানাদারদের দেশ পাকিস্তান থেকে আমদানিকৃত ‘জিন্দাবাদ’ তথা ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়েছিল অনেকদিন। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান- গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের কথায় এবং অংশুমান রায়ের সুরে সুরে বলবো- “জয়বাংলা বলতে মনরে আমার এখনো কেন ভাবো,/ আমার হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাবো,/ অন্ধকারে পুবাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।।”
লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
[এই কলামে উপস্থাপিত সকল মত লেখকের নিজের]