ডিসেম্বর পার হলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ যেনো ভুলে না যাই
২৭ ডিসেম্বর ২০২০ ১৯:০৫
স্বাধীনতার ৫০ বছরের কাছাকাছি আমরা। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে আমাদের যা অর্জন তা কিছুক্ষেত্রে সুখকর হলেও অনেক জায়গায় আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যে তেইশ বছর যুক্ত ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান; সে সময়ে ন্যূনতম মানবাধিকারটুকুও পায়নি এই অঞ্চলের মানুষ। আজ স্বাধীনতার অর্ধশতকে পা দেওয়া একটি রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কতটুকু পূর্ণ মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছে, তাও বিরাট একটি প্রশ্নের সম্মুখে। ডিসেম্বর আসে ডিসেম্বর যায়, এভাবে গোটা অর্ধশতক নেহায়েত কম সময় নয়। ডিসেম্বর এলে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধা জানানোর একটি উপলক্ষ তৈরি হয় দেশে—আবার কোনো রকম ১৬ ডিসেম্বর পার হলেই সব গাম্ভীর্য যেনো উবে যায়।
লেখক ও চিন্তক আহমদ ছফা একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন তার হারানো লেখা গ্রন্থে এই শিরোনামে—‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথায় জন্মায়’। তিনি একাত্তরে তার এলাকায় ঘটে যাওয়া একটি হত্যাকাণ্ডের কথা বলেছেন। গ্রামের হাট থেকে বাবা-ছেলে ফিরছিলেন, পথে তাদের দু’জনকে খুন করা হয়। যে খুন করেছে, জানা যায় সে নিহত দু’জনের মধ্যে একজনের ভাগ্নে।
ভাগ্নেটি মামা ও মামাত ভাইয়ের উপর ক্ষোভ নিয়ে জমি-দখল করার পরিকল্পনা করে রাজাকার-বাহিনীতে ভর্তি হয়। মামা আর মামাত ভাই মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করছে, এখনে তার পূর্ব পরিকল্পিত খুন করার জন্য সুযোগ কাজে লাগিয়েছে ভাগ্নে।
আহমদ ছফার উল্লেখ করা ঘটনার মতো হুবহু বিপরীতভাবে ক্ষমতার কাছাকাছি বিচরণের জন্য অনেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে একটা সিঁড়ি হিসেবে নিয়েছে। ডিসেম্বর এলেই ঢাকাসহ সব শহরের মোড় দখল করে বিলবোর্ড টাঙানো—যে উনারা বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। বিভিন্ন পয়েন্টে রাস্তা দখল করে বিলবোর্ড টাঙানোতে কতই-বা এমন পয়সা খরচ? ডিসেম্বর এলে রেকর্ডারের বিজয়ের সঙ্গীত বাজিয়ে সাচ্চা দেশপ্রেমিক। আহমদ ছফা প্রশ্ন রেখেছিলেন, এদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জন্মায় কোথায়।
আজ জাতীয় দিবসগুলোতে সরকারি দফতরের বাইরে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি জানিয়ে যে ব্যানার টাঙিয়ে দেওয়া হয়, এটা যেনো একটি রুটিন কাজের দায়িত্ব থেকে করতে হচ্ছে। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পার হলেই সব জলীয়বাষ্পের মতো উধাও। অথচ অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানে নানা প্রকল্পের নামে রাষ্ট্রীয় টাকা নয় ছয় করা হচ্ছে। বারবার একের পর এক গণমাধ্যমে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের ব্যয়ের যে হিসাব দেখানো হচ্ছে, তাতে বাস্তবতার মিল নেই। যারা যুগপৎভাবে বিজয়ের মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় আবার প্রকল্প এলে দুর্নীতি করে, এটা কেমন দেশপ্রেম ভক্তি? এটা তো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মাত্রাহীনভাবে উপহাস ৷
বিজয়ের মাস এলে মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, আর প্রকল্প এলে রাষ্ট্রীয় টাকা নিয়ে দুর্নীতি। কেন এমন দ্বিমুখী আচরণ? তাহলে মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ এবং দেশের প্রতি আমরা সম্মান দেখাচ্ছি কোন জায়গায়।
একাত্তর নামটা শুনলে চোখে ভেসে উঠে, রাস্তাঘাটে জলাশয়ে শহরে নগরে গ্রামে বধ্যভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অগণিত লাশ। একাত্তর যেমন গৌরবের, তেমনই একাত্তরের শোকগাঁথা ইতিহাসও আছে। পৃথিবীর গণহত্যার ইতিহাসে টানা নয় মাস ধরে হত্যাযজ্ঞ কোনো মামুলি বিষয় নয়। মুক্তিযোদ্ধাদের লাখো প্রাণের আত্মত্যাগ ছিলো বলেই একাত্তর গৌরবান্বিত। এখন আমরা ডিসেম্বর এলে যে বিজয় দিবস পালন করছি, তা কি কেবল উৎসব প্রদর্শনের জন্য? বিজয়ের উৎসব আমাদের সেই শোকগাঁথা ইতিহাস সামনে এনে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়াচ্ছে নাকি তা স্রেফ উৎসব পালনের দিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে ।
আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি যেখানে সংস্কৃতি খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। একটা আচার-সংস্কৃতি দ্রুত পাল্টে যেতে এখন খুব বেশি সময়ের দরকার পড়ে না। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে কিছুদিন পরপর একেকটা দিবসের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছি আমরা। এমন কিছু দিবসের কথা এক দশক আগেও কেউ জানতো না।
ডিসেম্বর এলেই লাল-সবুজ পতাকার রঙয়ের সঙ্গে মিলিয়ে, পাঞ্জাবি শাড়ি ফতুয়া গায়ে জড়ানোর শালসহ নানা ধরণের পোশাক সামগ্রীর চাহিদা তৈরি হচ্ছে দেশে। বিজয়ের উৎসব হোক, কিন্তু পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতিদিনকার নানা দিবসের মতো যদি একটা উৎসব পালনের দিন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা জাতির জন্য অশনি সংকেত।
আমরা অন্যান্য দিবসের মতো বিজয় দিবসকে, শ্রদ্ধায় নয় বরং কেবল প্রদর্শনের জন্য উদযাপন করার যে অভ্যাস তৈরি করে ফেলছি— তারই উদাহরণ দেখা গেছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের পতাকা বিকৃতির মাধ্যমে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে, বিজয় দিবসের ব্যানারে শহিদ মিনারের ছবি। একটা ব্যানার যিনি তৈরি করেছেন, তিনি অজ্ঞতাবশত ভুল করতে পারেন। নতুন করে একটা ব্যানার বানাতে কত সময় লাগে, দেখেও না দেখার মতো করে— যারা ভুলটা দেখেও সেটা সামনে এনে ছবি তুলেছেন তারা তো কঠিন অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন ৷ কোনোভাবে উনারা যা পেয়েছেন তা নিয়ে চালিয়ে দিয়েছেন, ফটোসেশনই তো মুখ্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন অবস্থা হলে গোটা জাতি কোন কক্ষপথে আছে তা প্রশ্নের দাবি রাখে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই হাল হলে জাতিকে সুগঠিতভাবে বিকশিত করার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। দেশটাকে যেনো সবসময় ভালোবাসি, কেবল একদিনের আনুষ্ঠানিক উদযাপন করে নয় মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের চেতনা বছরজুড়ে ধারণ করলে দুর্নীতিসহ সব অপরাধ কমে যাবে। বিকৃতিও ঘটবে না। আমরা এমন বাংলাদেশই চাই।
লেখক: সংবাদকর্মী ও নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়