কেন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেবেন?
৩১ জানুয়ারি ২০২১ ১৪:৩০
সর্বসাধারণের ব্যবহারযোগ্য করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদন হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে প্রথম সারিতেই আছে। অনেকের মধ্যেই ভ্যাকসিন নেওয়া বা দেওয়া নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। একজন জনস্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আমি মনেকরি সুযোগ থাকলে সবাইকেই করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত। কিন্তু আপনার যদি কোনো গুরুতর শারীরিক অসুস্থতা থাকে, তবে আপনার নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করেই ভ্যাকসিন নেবেন। চলুন দেখা যাক কেন আপনার-আমার ভ্যাকসিন নেওয়া উচিত।
এই ভ্যাকসিন নিরাপদ
বর্তমানে যে তিনটি ভ্যাকসিন সকল স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে ও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেওয়া হচ্ছে সেগুলো হচ্ছে— ক) ফাইজার ও বায়োনটেক ভ্যাকসিন; খ) মর্ডানার ভ্যাকসিন এবং গ) অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন। এছাড়াও রাশিয়া-চীনসহ নানা দেশ ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে কিন্তু সেগুলোর কোনোটাই এখনও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্বীকৃত হয়নি। যে তিনটি ভ্যাকসিন সর্বজনস্বীকৃত সেগুলো প্রয়োজনীয় গবেষণার মানদণ্ড মেনে, নানা ধাপ পেরিয়ে তবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। সুতরাং আপনি যদি এই তিন ভ্যাকসিনের যে কোনটি নেওয়ার সুযোগ পান, তবে অবশ্যই ভ্যাকসিন নেবেন। এছাড়াও সামনে জনসন ও জনসনের একটি ভ্যাকসিন আসছে, যেটি ইতিমধ্যে অন্যগুলো থেকেও সার্বিকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অক্সফোর্ড এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন ভারতের নয়
ভারতে প্রস্তুত হচ্ছে বলে অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকের মনে দ্বিধা আছে। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের আচরণ নিয়ে সন্দেহ থাকা অমূলক নয়। কিন্তু করোনা প্রতিরোধে ভ্যাকসিন উৎপাদনে ভারতের যে ভূমিকা তা নিয়ে বিতর্কের তেমন কোনো সুযোগ নেই। করোনাভাইরাস নির্মূল করতে হলে পৃথিবীর সকল মানুষকেই ভ্যাকসিন দেওয়া জরুরি। এখন ৭০০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ ভ্যাকসিন বানানো দরকার তা প্রস্তুত করার সক্ষমতা পৃথিবীর খুব বেশি দেশের নেই। ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউট পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী দেশ। তারা করোনার আগেও পৃথিবীর নিত্য প্রয়োজনীয় ভ্যাকসিনের প্রায় ৮০ ভাগ উৎপাদন করে বিভিন্ন দেশে পাঠায়। অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিনের কারিগরি দিকনির্দেশনা, ফর্মুলা সবই অক্সফোর্ডের। ভারত শুধু উৎপাদনকারী দেশ, এর বেশি কিছু নয়। সুতরাং ভারতকে বিশ্বাস না করলেও এই ভ্যাকসিনকে বিশ্বাস করতে কোনো সমস্যা নেই। যে ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসছে সেটা ভারতের গবেষণাধীন কোনো ভ্যাকসিন নয়, যুক্তরাজ্যের নামকরা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় তৈরি ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন ছাড়া করোনাভাইরাসে মৃত্যু ঠেকানোর বিকল্প নেই বললেই চলে
এটি পরিষ্কার করে উল্লেখ করা দরকার যে, করোনাভাইরাস এমন একটি মহামারির জন্ম দিয়েছে যা পৃথিবীর সকল দেশের, সকল অঞ্চলের, সকল ধর্ম, বর্ণ, গোত্রের মানুষকেই আক্রান্ত করেছে। কোথাও বেশি কোথাও কম। ভ্যাকসিন এখন পর্যন্ত একমাত্র কার্যকরী উপায় যার মাধ্যমে করোনাভাইরাসের আক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ভ্যাকসিন নিলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। কিন্তু ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ভ্যাকসিন নিলে কেউ যদি আক্রান্তও হয়, তবে এই ভ্যাকসিন সেই ভাইরাসকে দুর্বল করে ফেলবে, যা আক্রান্ত ব্যক্তিকে মৃত্যু বা গুরুতর অসুস্থ হওয়া থেকে বাঁচাবে।
করোনাভাইরাস মহামারিতে হার্ড ইমিউনিটি হবে না
জনস্বাস্থ্যের একজন মামুলি ছাত্র হিসেবে সাহস করে একটা বড় কথা বলে ফেলি। সেটা হচ্ছে—করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরু থেকেই আমরা হার্ড ইমিউনিটির কথা বলছিলাম। সাধারণ মানুষের জন্য এটি একটি জটিল ধারণা। কিন্তু মূল বিষয়টি হচ্ছে—যদি একটি নির্দিষ্ট এলাকার ৮০ ভাগ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে যায় তবে বাকি ২০ ভাগের আর এই রোগ হবে না। কারণ–
ক) যারা আক্রান্ত হয়ে যাবে তাদের আর সংক্রমণের ভয় নেই
খ) ৮০ ভাগ মানুষ যদি আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়ে যায় তাহলে বাকি ২০ ভাগ মানুষকে আক্রান্ত করার জন্য আর কেউ ওই এলাকায় বাকি থাকবে না।
কিন্তু এই তত্ত্ব করোনাভাইরাসের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ–
ক) করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় হয়নি, সারাবিশ্বে হয়েছে। সুতরাং আপনি কোনো একটি নির্দিষ্ট এলাকাকে আলাদা করে তাদের সংরক্ষিত রাখতে পারবেন না। বর্তমান বৈশ্বিক যোগাযোগের যুগে এক এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় যাবেই। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট এলাকা বা জনগোষ্ঠী আলাদা করে হার্ড ইমিউনিটি অর্জন করা যাবে না।
খ) করোনাভাইরাসে আপনি একবার আক্রান্ত হলেই যে সেটি আর হবে না এমনটি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবে না। এখন পর্যন্ত তথ্য-উপাত্ত দেখে মনে হচ্ছে যে, যারা একবার আক্রান্ত হয়, তাদের দ্বিতীয়বার এই সংক্রমণ হয় না, কিন্তু এটি নিশ্চিত করে বলার জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত আমাদের হাতে নেই।
সুতরাং হার্ডইমিউনিটি হয়ে যাবে, ভ্যাকসিনের দরকার নেই– এটি ভ্রান্ত ধারণা।
মাস্ক পরা, হাত-ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থা, দীর্ঘমেয়াদী নয়
মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা অনেক ভাইরাস থেকে মুক্ত থাকার জন্যই ভালো এবং ক্ষণস্থায়ী ব্যবস্থা। কিন্তু এই তিনটির নিয়মিত বাস্তবায়ন বছরের পর বছর ধরে বজায় রাখা সম্ভব নয়। এছাড়াও মাস্কের ধরণ ও তার বর্তমান যে ব্যবহার দেখা যাচ্ছে, তা করোনার মতো ভাইরাস প্রতিরোধে কতটা কার্যকরী তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। হাত ধোয়া সবসময়ই ভালো অভ্যাস, কিন্তু করোনাভাইরাস অনেক সময়েই সরাসরি বাতাসে ভেসে ছড়ায় এবং ফলশ্রুতিতে হাত নিয়মিত ধুলেও নানা উপায়ে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রবলভাবে থেকে যায়। সার্বিক বিবেচনায় মানুষের পক্ষে মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে এই ভাইরাস ঠেকানো দীর্ঘমেয়াদী সম্ভব হবে না। এছাড়া দীর্ঘদিনের জন্য শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাও সম্ভব নয়। এগুলো সবই ছিল ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগের পদক্ষেপ। এখন যেহেতু ভ্যাকসিন চলে এসেছে, করোনা থেকে মুক্ত থাকার জন্য তা নেওয়াই একমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। তবে যতদিন পর্যন্ত করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী নির্মূল না হবে, ততদিন পর্যন্ত মাস্ক পরা, হাত ধোয়া ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস জারি রাখলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে। কিন্তু ভ্যাকসিন না নিয়ে শুধু এই তিনটি ধাপ অনুসরণ করলে একসময় না একসময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শতভাগ।
একবার করোনা হয়ে গেলেও ভ্যাকসিন নিতে হবে
অনেকে ভাবতে পারেন, একবার করোনা হয়ে গেলে আর কখনও হবে না, তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার দরকার নেই। এখন তথ্য প্রমাণের দিকে তাকালে দেখা যায় একবার করোনা হয়ে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে তার আবার করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি। কিন্তু এর চাইতে দীর্ঘমেয়াদে কী হয় তার গ্রহণযোগ্য তথ্য গবেষকদের কাছে নেই। অর্থাৎ একবার করোনা হলেও পরবর্তীতে আপনার আবার করোনা হতে পারে। ভ্যাকসিন নিয়ে নিলে পরবর্তীতে আবার করোনা হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়, এমনকি যদি আবার হয়ও, তবুও তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা এই ভ্যাকসিন উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে দেবে। একবার হয়ে গেছে ভেবে পরবর্তীতে আবার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়ার চেয়ে ভ্যাকসিন নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে সুস্থ থাকার সিদ্ধান্তই হবে সঠিক ও কার্যকর।
ভ্যাকসিন নেবেন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, অন্যের জন্য
ভ্যাকসিন নিলে একজন ব্যক্তি শুধু নিজেই মৃত্যু ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকবেন তা নয়, বরং তিনি তার পরিবার, প্রতিবেশী ও আশেপাশের সবাইকে আক্রান্ত হওয়া থেকে বাঁচাবেন। সুতরাং এটি আসলে একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব।
উপরে ব্যবহার করা কোনো তথ্যই মনগড়া নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি, জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টোসহ নানা স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে লেখা। বাংলাদেশ ভ্যাকসিন আনার ক্ষেত্রে বড় ধরণের কূটনৈতিক সফলতা দেখিয়েছে। এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভ্যাকসিন অগ্রিম কিনে নেওয়া কানাডার চেয়েও বাংলাদেশে ভ্যাকসিন দেওয়া মানুষের সংখ্যা আগামী কয়েকমাসে বেশি হবে। সুতরাং আপনি যদি সুযোগ পান তবে অবশ্যই এই ভ্যাকসিন নেবেন। তবে ভ্যাকসিন নেওয়ার বা না নেওয়ার সিদ্ধান্ত আপনার নিজের। একজন জনস্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে আমি মনে করি এটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপদ। কিন্তু বাকিটা আপনার বিবেচনা। সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন।
অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন করোনাভাইরাস ভ্যাকসিন সেরাম ইনস্টিটিউট