Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ওষুধ ব্যবহারেও কেন মশা মরছে না?


১২ মার্চ ২০২১ ১৩:৫২

মশা নিয়ে আমাদের ভোগান্তি ক্রমশ বাড়ছে। মশা দমনে সিটি কর্পোরেশনগুলো নানা আয়োজন ও উদ্যোগ  গ্রহণ করলেও তেমন সফলতা আসেনি। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও মশা আমাদের প্রচণ্ড বিরক্ত করেছে। এডিস মশা যথারীতি ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। এমনকি এবছর শীতকালেও মশার প্রাদুর্ভাব ছিল উল্লেখ করার মতো (শীতকালে সাধারণত মশার বিস্তার কম হওয়ার কথা), যা এখনও চলমান। মশা দমন কার্যক্রমের দায়িত্বে নিয়োজিত সিটি কর্পোরেশনগুলো জনসচেতনতা বৃদ্ধি, মশার লার্ভা ধ্বংসকরণ, রুটিন করে সকাল-বিকাল কীটনাশক (স্প্রেইং/ফগিং) প্রয়োগ প্রভৃতি কাজ করে আসছে তারপরও মশার প্রাদুর্ভাব কমেনি অথচ প্রতিবছর মশা দমনের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ ঠিকই হচ্ছে। বাসা বাড়িতে ব্যবহৃত মশার কয়েল, এরোসল/স্প্রে কোনো কিছুতেই মশা নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। ওষুধ বা কীটনাশক হচ্ছে মশা দমনের প্রধান হাতিয়ার। সময় ও কার্যকারিতা বিবেচনায় পৃথিবীব্যাপী এর ব্যবহার হয় সবচেয়ে বেশি। যতই বলা হোক না কেনো ওষুধ/কীটনাশকের উত্তম বিকল্প এখনো পাওয়া যায়নি। তাই ওষুধ/কীটনাশক ব্যবহারে সঠিক কর্মপরিকল্পনাসহ বিশেষ মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত ওষুধ/কীটনাশক বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আমাদের খুবই সর্তক হওয়া প্রয়োজন। মশা দমনের জন্য আমাদের দেশে দীর্ঘদিন ধরে একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে। তাই কীটনাশকেও মশা আর মরছে না। তাই পুরাতন ও একই ধরনের কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করে প্রয়োগ তালিকায় নতুন ও কার্যকরী কীটনাশক (লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড) যোগ করতে হবে। কীটনাশক বাছাই করার পূর্বে তা প্রথমে ল্যাবরেটরিতে যথাযথ টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে। মশার লার্ভা দমনে (লার্ভিসাইডিং) বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণ লার্ভিসাইডিং করতে হবে এবং সঠিক, নিরাপদ ও কার্যকরী লার্ভিসাইড ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন দেশে সফলতার সঙ্গে ব্যবহৃত লার্ভিসাইড (বিটিআই তথা বেসিলাস থুরেনজেনিসিস (তরল/পাউডার), স্পাইনোসাদ, গ্রোথ রেগুলেটরস ইত্যাদি) আমাদের দেশেও পরীক্ষামুলকভাবে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

ধারনা করা হয়, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরগুলোতে মশারা অনেকটা ওষুধ/কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে। প্রচলিত কীটনাশকে মশারা এখন আর মরছে না। সকলের একই অভিযোগ—কীটনাশক প্রয়োগেও এখন মশা আর মরতে দেখা যায় না। উল্লেখ্য যে, বছরের পর বছর একই ধরনের কীটনাশক ব্যাবহার, মাত্রারিক্ত বা ভুল ডোজ প্রয়োগে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে গেছে, কারণ মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। প্রতিকুল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্যে তাদের ফিজিওলজিকাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে প্রধানত সাইটোক্রোম পি-৪৫০ মনোঅক্সিজিনেজ এনজাইম তথা পি-৪৫০ জিনকে (কীটনাশক প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে উঠে। কীটনাশক দিয়ে এদের আর সহজে দমন করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ বা অতি ডোজ খুব ভয়ানক হতে পারে। তাই কীটনাশকের ভুল প্রয়োগ বা অতিপ্রয়োগ করা যাবে না। এ ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। মশারা সত্যিই কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে কি-না বা কোন প্রজাতির মশা কোথায় (বিভিন্ন টার্গেট এলাকায়) কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিস্টেন্স রেশিও) কেমন তা গবেষণা করে জানতে হবে এবং এই গবেষণালব্ধ ফলাফলকে কাজে লাগিয়ে সঠিক কীটনাশক বাছাই করতে হবে এবং কীটনাশকের রিকমেন্ডেড ডোজ ঠিক করতে হবে।

তাছাড়া ঔষধ/কীটনাশক প্রয়োগের জন্য যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে, অর্থাৎ স্প্রে-ম্যানদের বিভিন্ন গ্রুপের কীটনাশক সম্পর্কে সম্যক ধারনা থাকতে হবে। মশার জীবনচক্র সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। স্প্রে-ম্যানদের যথাযথ ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ টেকনিশিয়ানে রূপান্তর করতে হবে। স্প্রে-ম্যানরা যেন শুধু শ্রমিক শ্রেণীর লোক না হয়। শ্রমিক দিয়ে মশার কীটনাশক প্রয়োগ করা ঠিক হবে না। আমাদের স্প্রে-ম্যানদের দক্ষতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া স্প্রে-সুপারভাইজার বা স্প্রে-ম্যানদেরকে বিভিন্ন প্রজাতির মশা (এডিস, কিউলেক্স, এনোফিলিস ইত্যাদি) শনাক্তকরণের পাশাপাশি, টার্গেট ও নন-টার্গেট প্রাণী চিনতে হবে এবং এদের রক্ষারও ব্যবস্থা নিতে হবে। মশার লার্ভার বিভিন্ন পর্যায় (ইন্সটার) সম্পর্কে তাদের ধারনা থাকতে হবে। কীটনাশকের (লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড) সঠিক ব্যবহার বিধি তাদেরকে জানতে হবে ও মানতে হবে। কীটনাশক প্রয়োগের জন্য অত্যাধুনিক মেশিন ব্যবহার করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে থার্মাল ফগার মেশিন ছাড়াও উন্নতমানরে মেশিন যেমন আলট্রা লো ভলিউম স্প্রেয়ার (ইউ্এলবি স্প্রেয়ার) ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া কীটনাশক প্রয়োগের সময়ও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। পরিণত মশা মারতে গভীর রাতে বা ভোর সকালে (রাত ১১ টা থেকে ভোর ৬ টার মধ্যে) এডাল্টিসাইড প্রয়োগ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

আবার কীটনাশক (লার্ভিসাইড ও এডাল্টিসাইড) প্রয়োগের পর এটা ঠিকমতো কাজ করছে কি-না, অর্থাৎ লার্ভা বা পরিণত মশা মরছে কি-না তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। মোট কথা কীটনাশকরে কার্যকারিতা মনিটরিং করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কোনো কীটনাশক ঠিকমতো কাজ না করলে তা পরিবর্তন করে নতুন কার্যকরী কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

তাছাড়া আসল কীটনাশক ক্রয় করাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশনগুলো মশা দমনে ব্যবহৃত কীটনাশক ক্রয় করে থাকে। প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কীটনাশক ক্রয় করা হয়। এসব ক্ষেত্রে শক্তিশালী সিন্ডিকেট জড়িত থাকার কথা শুনা যায়। এসব নিয়ে মাঝে মাঝে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখি হয়। তবে যেভাবেই ক্রয় করা হোক না কেন—লক্ষ্য রাখতে হবে কীটনাশক যাতে ভেজাল না হয়। মশা দমন একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পাবলকি হেলথ ইস্যু, তাই এক্ষেত্রে কোনো অবহেলা নয়। নকল কীটনাশক ব্যবহারে সমস্যা আরও প্রকট হয়।

আধুিনক মশা দমন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হলে ওষুধ/কীটনাশকের সফল ও কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করতেই হবে। এর বিকল্প নেই। তাই কীটনাশকে মশা দমনের ক্ষেত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে কাজ করলে কাঙ্ক্ষিত সফলতার দেখা মিলতে পারে।

লেখক: কীটতত্ত্ব বিভাগ, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ভিজিটিং সায়েন্টিস্ট, এনাশটাশিয়া মসকিউটো কন্ট্রোল, ফ্লোরিডা, যুক্তরাষ্ট্র

টপ নিউজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

বাংলাদেশ-ভারত টেস্টে হামলার হুমকি!
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:৩৫

সম্পর্কিত খবর