ইসলামের বৈদেশিক রাষ্ট্রীয় নীতির বিষয়ে কি অন্ধকারে হেফাজত ইসলাম?
৩১ মার্চ ২০২১ ২০:১৯
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে অতিথি হয়ে আসাকে ‘উছিলা’ বানিয়ে মূলত হেফাজতে ইসলাম তাদের পেশীশক্তির জোর দেখাতে চেয়েছিল। তবে তারা নিজেদের সামর্থ্য ও শক্তির বিচার সেভাবে করতে পারেনি। তারা বুঝতে পারেনি যে, আল্লামা শাহ আহমদ শফীর হেফাজতে ইসলাম আর জুনায়েদ বাবুনগীর হেফাজতে ইসলাম কিন্তু একই সক্ষমতার ইসলামিক সংগঠন নয়। সক্ষমতা বলতে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, একটি রাষ্ট্রে বসবাস করে সে রাষ্ট্রের নীতিকে অনুধাবন করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকেই বুঝানো হচ্ছে।
কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের রাষ্ট্র-স্বীকৃত সনদ দিয়ে তাদের ‘ভালো রাখার’ দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। যদিও তারা এর যোগ্য কখনই নয়। কারণ তাদের চিন্তায়, বিবেকে মেধার চেয়ে হুজুর তোষামোদিই প্রাধান্য পায়। তাদের হুজুরেরা এলমে দ্বীনের চর্চা বিসর্জন দিয়ে নেমেছে হেফাজতে ইসলামের নামে এখন রাজনৈতিক ফায়দা এবং ক্ষমতাবৃন্তের স্বাদ আস্বাদনে। যাদের পেছনে হাঁটছে কওমি মাদ্রাসার কোমলপ্রাণ শিক্ষার্থীরা। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের উত্তরসূরির তকমা মুছে তারা এই দেশে ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডামুখী হওয়ার মধ্যেই আত্মতৃপ্তি খুঁজতে নেমেছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
ইসলামপন্থী এই মেধাবী মুখগুলো পবিত্র কোরআনের জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বের বিপরীতে সময়ে সময়ে নামছে সহিংসতার আমেজ নিয়ে। যাদের কণ্ঠে সুললিত ধ্বনিতে শুনতে পাওয়ার কথা পবিত্র কোরআনের আয়াত, সহিহ হাদিসের ব্যাখ্যা, তাদের কণ্ঠে শুনতে পাওয়া যায় চতুর কিছু রাজনৈতিক এতিমদের শিখানো বেফাঁস বুলি! তাদের দেখা যায় অশ্লীল ভাষায় কখনও জুতা, কখনো লাঠি হাতে মিছিল করতে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে আসা বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদিকে অসম্মানিত করতে রাস্তায় নামা হেফাজতে ইসলাম আজ ‘বোকাদের’ সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি নিয়েছে। দ্বীন ইসলামের আকিদা অনুসরণের নামে, ইসলামের হেফাজত করার নাম নিয়ে যে সংগঠন আল্লামা শাহ আহমদ শফি সুদৃঢ় করেছেন সে সংগঠন তার লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে। কারণ ইসলাম কখনোই তার শত্রুর বিরুদ্ধেও এভাবে কদর্যপূর্ণ বক্তব্য কিংবা আচরণ সমর্থন করে না। নরেন্দ্র মোদিকে যদি তারা ইসলামের শত্রুও মনে করে তবুও তার বিরুদ্ধে এমন ঘৃণ্য ও সহিংস আচরণ প্রদর্শন ইসলামের আকিদা পরিপন্থী।
ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্যই শুধু নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য পবিত্র কোরআনকে আল্লাহ গাইডলাইন হিসেবে পাঠিয়েছেন। সেই কোরআনের সূরা হুজরাতের ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ইমানদারগণ! এক কওম (জাতি) যেন অন্য কওমকে বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। আর নারীরাও যেন অন্য নারীদের বিদ্রূপ না করে। হতে পারে তারাই এদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরকে বিদ্রূপ করো না এবং পরস্পরকে খারাপ নামে ডেকো না।’
সূরা ফোরকানের ৬৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহর আসল বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সঙ্গে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়; তোমাদের সালাম’।
সূরা ফুসসিলাতের ৩৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সেই নেকি (ভালো কাজ) দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভালো। তাহলে দেখবে যার সঙ্গে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গেছে’।
অথচ এই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের দিচ্ছে সম্ভবত আল্লাহর কোরআনের এসব আয়াতের উল্টো শিক্ষা। আমরা নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে এই মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মুখে শুনতে পেলাম অসম্মানের বুলি। যা আমাদের ব্যথিত করেছে।
আজকে যদি ধরেই নিই, নরেন্দ্র মোদি তার দেশে ইসলামবিরোধী হিসেবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন, তবুও ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের উত্তরসূরি খ্যাত কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কিভাবে কোরআনের আয়াতের বিপরীতে গিয়ে ‘শত্রু’র বিরুদ্ধে নোংরা পন্থায় নোংরা আচরণ প্রদর্শন করবে? নরেন্দ্র মোদির কর্মকাণ্ডের কথিত সমালোচনা করতে গিয়ে দুই রাষ্ট্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট করা কি ইসলামের রাষ্ট্রীয় নীতি হতে পারে? রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক সিদ্ধান্তগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন কি ইসলাম সম্মত?
মানবাধিকার ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারের সর্বোচ্চ নিদর্শন স্থাপন করেছেন আল্লাহ’র রসুল হযরত মুহাম্মদ (স.)। তার নীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট রাখার বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
মুহাম্মদ রসুল (স.) বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানদেরও ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে অসম্মানজনক কোনো আচরণ তিনি দেখাননি। ইসলাম প্রচারের শুরুতে তিনি বিভিন্ন গোত্র ও দেশের রাজা বা সম্রাটের কাছে দূতের মাধ্যমে ইসলাম প্রচারের জন্য অথবা রাজনৈতিক কারণে দূত পাঠিয়েছিলেন। সে সময় বাইজেন্টাইন, মিসর, পারস্য ও ইথিওপিয়ার সম্রাটরা এই দূতদের সম্মান দিয়েই গ্রহণ করেছেন। এই দূতরা যে বার্তা নিয়ে যেতেন তা তারা শুনতেন।
রোমের বাদশা হেরাক্লিয়াসকে হযরত মুহাম্মদের (স.) পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ ছিল, ‘বরাবর হেরাক্লিয়াস, গ্র্যান্ড চিফ অব রোম (বাইজেন্টাইন); আল্লাহর প্রেরিত ধর্মপ্রচারক মুহাম্মদের (স.) পক্ষ থেকে যারা সত্যকে অনুসরণ করে তাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। মহান আল্লাহর নামে আমি আপনাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আপনি মুসলিম হন। নিরাপদে থাকুন। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কৃত করবেন। আমাদের মধ্যে আপনি এবং ধর্মগ্রন্থে বিশ্বাসীরা আল্লাহর একই কথা শুনতে পাবেন। আসুন, আমরা একই আল্লাহর ইবাদত করি। অন্য কাউকে নয়; অথবা অন্য কাউকে তার সাথে শরিক না করি। যদি আপনি বিশ্বাস করেন, তাহলে বলুন- আমরা মুসলিম এবং যদি তা না হয়, তাহলে জনগণের পাপের ভাগীদার আপনি হবেন’। কিছু ইতিহাসবিদদের মতে, ইথিওপিয়ার সম্রাট ও মিসরের মুকাওকাস হজরত মুহাম্মদের (স.) আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন।
এই কথাগুলো লেখার কারণ, ইসলামে বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতিনিধির সঙ্গে আচরণ কী হবে সে বিষয়ে ধারণা দেওয়া। বন্ধু রাষ্ট্রের প্রধানকে দাওয়াত দিয়ে এনে অসম্মানিত করা, দেশজুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মতো নীতি শান্তির ধর্ম ইসলামের হতে পারে না। যার প্রমাণ হযরত মোহাম্মদের (স.) বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের নানা দিকগুলো।
৬২২ খ্রিস্টাব্দে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পর হযরত মোহাম্মদের (স.) নেতৃত্বে যে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় সে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল তাকে বলা হয় মদিনার সনদ। এর মাধ্যমে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ভিত তৈরি হয়েছিল। এই নীতিতে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে আচরণ কী হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ ছিল।
এই নীতির কোথাও কোনো পর্যায়েই বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ রাখা হয়নি। বরং যুদ্ধবন্দীদের সাথেও সুন্দর আচরণের নীতি রাখা হয় মদিনা সনদে। এমনকি সেখানে আপাতদৃষ্টিতে পরাজয় মনে হলেও রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিদেশি রাষ্ট্রের সাথে সন্ধি স্থাপন করার নীতি রাখা হয়েছিল।
ইতিহাসবিদরা দাবি করেছেন, পৃথিবীতে বৈদেশিক বা পররাষ্ট্রবিষয়ক কোনো নীতির মধ্যে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নীতি হলো এই মদিনার সনদ। যেখানে দেশের অভ্যন্তরীণ কিংবা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ইস্যুতে কোথাও অশান্তি বা নৈরাজ্যের বার্তা ছিল না। মুহাম্মদ (স.) পর খোলাফায়ে রাশেদিনরাও এই নীতিকেই ইসলামি রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আজকে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষকরা রসুলুল্লাহ (স.) বৈদেশিক নীতিগুলো কি বেমালুম ভুলে গিয়েছেন? নাকি তারা ক্ষমতার মসনদে যাওয়ার অভিপ্রায়ে দেশীয় কিছু রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার অংশ হিসেবে ইসলামের সার্বজনীন এই নীতিকে আড়ালে রেখে রাজপথে নেমেছেন? কওমি আলেমদের সম্মানের চোখে দেখা এই দেশের জনগণের কাছে আজ কি স্পষ্ট নয় যে কওমি মানেই এখন কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের এজেন্ডার অংশ?
অথচ দ্বীন ইসলামের সঠিক ধারণা অর্থাৎ শিরক, বেদাআতমুক্ত ইসলামকেই দারুল উলুম দেওবন্দের উত্তরসূরিরা চর্চা করে এই উপমহাদেশে আলোচিত ছিল যুগে যুগে। আজকে বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদলোভী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে তারা তাদের সুনামকে পদদলিত করছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডার হাতিয়ার হয়ে কওমি মাদরাসা পরিচালনায় যুক্ত শীর্ষ স্থানীয় আলেমরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। একে অপরের বিরুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন কাদা ছোঁড়াছুড়িতে।
কেউ কেউ বলছে, হেফাজতে ইসলামের কারণে তারা শুধু ব্যবহারই হচ্ছেন এই দেশের ধুলোমাখা রাজনৈতিক দলের মারপ্যাঁচে পড়ে। হেফাজতের নেতাদের কাছে প্রশ্ন, নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অতিথি হয়ে ঢাকায় আসার সঙ্গে ঢাকার বায়তুল মোকাররমের সামনে থাকা মোটরসাইকেলগুলোর কী সম্পর্ক? মাথায় টুপি দিয়ে জুমার নামাজ আদায় করে কেন জনগণের এই সম্পদে আগুন দিলেন আপনারা? ইসলাম তার কোন নীতিতে এ ধরণের আচরণকে সমর্থন করে? কিছুদিন পরপর কোমলপ্রাণ শিশুদের রাস্তায় নামিয়ে সহিংসতায় যুক্ত হতে বাধ্য করা কি ইসলামি সংগঠনের কাজ হতে পারে? সড়কের উপর চাটাইয়ে শিশুদের বসিয়ে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতে দিয়ে সড়কে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা কি ইসলামের শিক্ষা হতে পারে? রাষ্ট্রীয় দফতরগুলোতে ভাঙচুর করে, নথিতে অগ্নিসংযোগ করা কি নরেন্দ্র মোদির উপর ক্ষোভ ঝাড়ার ইসলামিক পন্থা হতে পারে?
মূলত এদেশের ইসলাম প্রিয় মানুষ কওমি মাদ্রাসা থেকে যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় তার জন্য দায়ী হবে এই হেফাজতে ইসলাম এবং তা এসব কারণেই। কারণ তাদের আধিপত্যবাদী সহিংস মনোভাবের কারণেই কওমি মাদরাসাগুলো তাদের মুল যে চেতনা, তা হারাতে বসেছে। যদিও কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা ও হেফাজতে ইসলাম দুইটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা এমনভাবেই তাদের উপস্থাপন করেছেন যেন তারাই কওমি আলেম। তাদের কর্মকাণ্ডগুলোই কওমি মাদরাসার স্বতঃসিদ্ধ কর্মকাণ্ড।
এ কারণেই হেফাজতে ইসলামের নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়ছে কওমি মাদরাসার উপর। এর ফলে এই মাদরাসাগুলো তাদের ঐতিহাসিক আবেদন হারাতে বসেছে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত জঘন্য ও নিন্দিত শিরক ও বেদআতের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেই কওমি মাদরাসাগুলো ইসলামি জ্ঞানের চর্চা ও এই জ্ঞানের প্রসার ঘটিয়ে আসছে এই জনপদে যুগের পর যুগ ধরে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাবেক সহ সভাপতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি