অটিজমে আক্রান্ত শিশুর প্রতি আমাদের দায়িত্ব
২ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৪৩
অটিজম মস্তিষ্কের বিকাশগত একটি সমস্যা। অন্য আর দশটা স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় এই রোগে আক্রান্ত শিশুর আচরণ আলাদা হয়। আমাদের দেশে অসচেতনতার কারণে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ তা প্রতিবন্ধক হয়ে উঠছে। আমাদের সমাজের বহু স্থানে অটিজমে আক্রান্ত শিশু দেখতে পাই। তাদের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তাদের বিকাশের সুযোগ প্রদানের জন্য কেমন পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন আমাদের সমাজে অনেকেরই তা জানা নেই। বিশেষ করে সমাজের একটি অংশ যারা শিক্ষিত নয়, আবার অল্প শিক্ষিত হলেও কারও অটিজম বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা নাও থাকতে পারে। অতীতে কিছু ভ্রান্ত ধারণা ছিল এবং সেগুলো আজও রয়েই গেছে। এর ফলে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা তাদের বিকাশে যথাযথ পরিবেশ পায় না। অথচ অটিজমে আক্রান্ত হওয়া তাদের দোষ নয়। তারা আর দশটা শিশুর মতোই বড় হয়ে ওঠার পরিবেশ পাওয়ার অধিকার রাখে। অটিজমে শিশুর একটি অবস্থা যখন তার বড় হয়ে ওঠা অন্য স্বাভাবিক শিশুর তুলনায় ধীর গতির হয়। শিশুটির সামাজিক বিকাশ ঠিকমতো হয় না। অন্য শিশুর সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মেশা বা খেলাধুলা অটিজমে আক্রান্ত শিশু করতে পারে না।
একটি শিশু অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার বা অটিজমে আক্রান্ত কি না তা শিশুর জন্মের পর বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে তার আচরণ এবং বিভিন্ন লক্ষণে বোঝা যায়। তবে সবার ক্ষেত্রে অটিজমের লক্ষণ একই রকম হয় না। এরা একই কাজ বারবার করতে চায়। একটি নির্দিষ্ট জিনিসের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে। আজও আমাদের সমাজ যে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সেখানে অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে অবহেলা আর অনাদর জোটে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর মা বাবাকে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে অসম্মানজনক কথা শুনতে হয়। সংসারে নেমে আসে অশান্তি। পরিবারের অন্য সদস্যদের সমর্থন থাকে না। এর ফলে যা ঘটে তা হলো সেই শিশুটির ভেতর যে মেধা রয়েছে তা বিকশিত হতে পারে না। কারণ অটিজমে আক্রান্ত শিশুর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যা দরকার তা হলো পারিবারিক সমর্থন। পরিবারের সমর্থনের পর সামাজিকভাবে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি এবং বিদ্যালয়ে তার বিকাশের পরিবেশ তৈরি করতে হয়। সেই পারিবারিক সমর্থন আমাদের দেশে বিশেষভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে খুব কম। যদিও এদের জন্য ক্রমেই মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অটিজম সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা ছিল সেসব ক্রমেই দূরীভূত হচ্ছে। একসময় মনে করা হতো এই শিশুরা সমাজের জন্য কোনো অবদান রাখতে পারবে না। কিন্তু এখন শিক্ষা প্রসারের সাথে সাথে আমরা জানি যে, এসব শিশুর মধ্যে মেধা রয়েছে এবং বিকাশে উপযুক্ত পরিবেশ পেলে তা বিকাশ ঘটে।
প্রতি বছর এপ্রিলের ২ তারিখ আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস প্রস্তাবটি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয় এবং সেটি গৃহীত হয় একই বছরের ১৮ ডিসেম্বর। গত বছরেও যখন এই দিনটি পালিত হয় তখন ছিল করোনাভাইরাসের তীব্রতার মধ্যে। এবং এবছরেও যখন এই দিনটি এসেছে তখনও করোনাভাইরাস মহামারির তাণ্ডব চলছে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের জীবনই যেখানে দুরূহ হয়ে উঠেছে সেখানে এসব অটিজমে আক্রান্তদের জীবন আরও নাকাল হয়ে উঠেছে।
অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশুকে তার মেধার সঙ্গে পরিচয় করাতে হলে তার সঙ্গে আচরণ সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ করতে হবে। তাকে সময় দিতে হবে। তার পছন্দ, অপছন্দ, ভয় পাওয়া, উত্তেজিত হওয়া এসব বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে হবে। এ ধরনের শিশু কিছু কিছু বিষয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে আবার কোনো জিনিস সে খুব পছন্দ করে। এসবের সঙ্গে পরিচিত হলে তার সাথে মিশতে পারার কাজটি সহজ হয়ে ওঠে। কেউ ভালো ছবি আঁকতে পারে, কেউ বা অন্য কোনো কাজে দক্ষ হতে পারে। এই দক্ষতার বিষয়টি তাকে উৎসাহিত করে। সে আরও বেশি মনোযোগী হয়। একসময় দেখা যায় সে অনেক বড় কোনো কাজে অবদান রাখতে পেরেছে। একসময় আমাদের দেশে শারীরিক প্রতিবন্ধী, অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রতি সমাজের সর্বত্রই ছিল অবহেলা। খুব বেশি হলে তাদের জন্য ছিল করুণা। সেই ধারণার যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়েছে তা নয়। তবে মানুষ শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে এবং অটিজম সম্পর্কে জানার কারণে সেই ধারণার পরিবর্তন হচ্ছে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর প্রতি আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা উচিত সেটা বুঝতে পারছি আমরা সবাই। বাড়িতে এবং বিদ্যালয়ে অটিজমে আক্রান্ত শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশ দিলে তার মেধা বিকশিত হবে এবং সমাজে সেও অবদান রাখতে পারবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক