মামুনুল হকের ব্যাখ্যা শরিয়তসম্মত নয়
৫ এপ্রিল ২০২১ ১৬:২০
হেফাজতে ইসলামের নেতা মাওলানা মামুনুল হক সাহেবের ঘটনা যে কোনো মুসলিমকে আহত করবে এটা খুবই স্বাভাবিক। কেউ আহত হয়েছেন, এটি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এই বিশ্বাস থেকে। আবার কেউ আহত হয়েছেন, তার আচরণ মুসলিমদের তথা ইসলামের মূল্যবোধকে অপমানিত করেছে এই বিশ্বাস থেকে। গত দুই দিন ষড়যন্ত্রের পক্ষে-বিপক্ষে বিপুল প্রমাণ উপস্থাপনা করেছে দুই পক্ষই। নির্মোহভাবে এসব প্রমাণ বিশ্লেষণ না করে উভয় পক্ষ নিজ নিজ বিশ্বাসের জায়গা থেকে অপর পক্ষের প্রমাণ অস্বীকার করেছেন। এই বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত মত খুব পরিষ্কার।
১. রাজনৈতিক দলের বা কোনো গোষ্ঠীর মোর্যাল পুলিশিং করার, মানুষের প্রাইভেসি ভায়োলেট করার কোনো অধিকার নেই। দেশের আইন বা ইসলামের অনুশাসন কোনোটাই এমন আচরণ সমর্থন করে না।
২. মাওলানা সাহেব ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছেন। ইসলামের অনুশাসনের সুস্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট লঙ্ঘন করেছেন। শুধু তাই নয়, সেই লঙ্ঘনকে আবার ইসলাম দিয়ে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন।
অনেকে বলবেন, ফোন কল, ভিডিও সব বানোয়াট। মাওলানা সাহেব যা দাবী করেছেন তাই সত্য। আমি এই যুক্তি মেনেই কিছু প্রশ্ন করছি। মাওলানা সাহেবের নিজের বক্তব্য ছাড়া আমি আর কোনো বক্তব্য বা প্রমাণের রেফারেন্স ব্যাবহার করবো না। ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র বিচার্য বিষয়, তিনি যাকে নিজের স্ত্রী বলে দাবী করেছেন তিনি তার বৈধ স্ত্রী কি-না।
মাওলানা সাহেব তার নিজস্ব ফেসবুক পেইজে একটি দীর্ঘ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আমি তার থেকে রেলিভেন্ট একটা অংশ তুলে ধরছি।
“অপরদিকে হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রী হয়ে যায় অনেকটা অসহায় । এক রকমের কূলকিনারাহীন। রাগের মাথায় সংসার ভেঙে গভীর সংকটে পড়ে যান তিনি । ওই পরিস্থিতিতে তার জীবিকা নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই তিনি আমার শরণাপন্ন হন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে করণীয় বিষয়ে পরামর্শ নেন। আর সেই দুঃসময়ে সহযোগিতা করার মত আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না তার। ইসলামী দৃষ্টিকোণ এবং অভিভাবকত্বের জায়গা থেকে আমি তার অর্থনৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ করি। জীবনের করণীয় বিষয়ে দিক নির্দেশনার জন্য নিয়মিতই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় তাকে। এমতাবস্থায় একজন বেগানা নারীর সাথে এভাবে সম্পর্ক রাখাকে শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে আমার কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই, যত দিন তার অভিভাবকত্বের প্রয়োজন হবে আমার, তাকে বেগানা হিসেবে রেখে অভিভাবকত্ব করব না ,বরং ইসলামী শরীয়তের আলোকে বৈধ একটা সম্পর্ক তৈরি করে নেব। বিষয়টি নিয়ে ঘনিষ্ঠজনদের সাথে কথা বলি এবং এ বিষয়ে তাদেরকে জানিয়ে শরীয়তের বিধান অনুযায়ী বিবাহের কালেমা পড়ে বিবাহ করে নেই”।
১. হাফেজ শহীদ ভাইয়ের স্ত্রীর দুইটি ছেলে সন্তান এবং মা-বাবা বেঁচে আছেন। এই অবস্থায় ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী তিনি অসহায় কুলকিনারাহীন নন। তার বৈধ অভিভাবক আছেন। তারপরেও কেন তিনি মাওলানা সাহেবের শরণাপন্ন হবেন?
২. যখন স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মতভিন্নতা হয় তবে স্বামীর পক্ষ থেকে একজন এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে একজন অভিভাবক নিযুক্ত করে নিষ্পত্তির চেষ্টা করা আল্লাহতালার হুকুম।
وَ اِنۡ خِفۡتُمۡ شِقَاقَ بَیۡنِہِمَا فَابۡعَثُوۡا حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہٖ وَ حَکَمًا مِّنۡ اَہۡلِہَا ۚ اِنۡ یُّرِیۡدَاۤ اِصۡلَاحًا یُّوَفِّقِ اللّٰہُ بَیۡنَہُمَا ؕ اِنَّ اللّٰہَ کَانَ عَلِیۡمًا خَبِیۡرًا ﴿۳۵﴾
যদি তোমরা তাদের মধ্যে অনৈক্যের আশঙ্কা কর, তবে স্বামীর আত্মীয়-স্বজন হতে একজন এবং স্ত্রীর আত্মীয়-স্বজন হতে একজন সালিস নিযুক্ত কর। যদি উভয়ে মীমাংসা করিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে করে, তবে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করবেন, নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছু জানেন, সকল কিছুর খবর রাখেন।
[সুরা আন-নিসা, আয়াত ৩৫]
এমন পরিস্থিতিতে মাওলানা সাহেব কোন পক্ষে ছিলেন? তিনি যদি হাফেজ সাহেবের বন্ধু হিসেবে তার ওয়ালি হয়ে থাকেন তবে হাফেজ সাহেবের স্ত্রীর ওয়ালি কে ছিলেন? নাকি তিনি স্ত্রীর ওয়ালি ছিলেন? তিনি অনাত্মীয়া মহিলার ওয়ালি কিভাবে হলেন মহিলার বাবা বা ছেলেরা বেঁচে থাকতে?
৩. উনি কার ঘনিষ্ঠজনদের সাথে কথা বলেছেন? এই বিয়ের ব্যাপারে ওনার নিজের এবং তার অনুসারী ছাড়া আর কারও বক্তব্য নেই কেন? মেয়েটির বাবার বক্তব্য কোথায়?
৪. মাওলানা সাহেব নিজে ফতোয়া দিয়েছেন বাবার অনুমতি ছাড়া মুসলিম মেয়ের বিয়ে বৈধ নয়। সেই অনুমতির প্রমাণ এখনও অনুপস্থিত কেন?
৫. তিনি দাবী করেছেন তিনি কলেমা পড়ে বিয়ে করেছেন। সেই বিয়ের ওয়ালিমায় কারা উপস্থিত ছিলেন? ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা, উমর ইবন আল খাত্তাব বলেছেন, যে বিয়ের কথা পাড়া প্রতিবেশী জানে না, সেটা বিয়ে না, সেটা জিনা। এই বিয়ের কথা কেউ জানে না কেন? মাওলানা সাহেবের বায়োগ্রাফির কোথাও দ্বিতীয় স্ত্রীর উল্লেখ নেই কেন? মাওলানা সাহেব স্ত্রীর নাম জিজ্ঞাসা করাতে যেই নাম বলেছেন, তা পত্রিকান্তরে জানা গেল তার প্রথম স্ত্রীর নাম। কেন এই মিথ্যাচার?
৬. এই বিয়ের নিকাহনামা কোথায়? যেই বিয়ে গোপন করা হয়েছে, যেই বিয়ের কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই, ইসলামের দৃষ্টিতে সেই বিয়ে কিভাবে বৈধ?
৭. তিনি গতকাল একটি চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন। বলেছেন তিনি আল্লাহ্র নামে শপথ করছেন যে, তিনি কলেমা পড়ে বিয়ে করেছেন। অপর পক্ষও যেন এমনি শপথ করে। যে মিথ্যা বলেছে, তার উপর আল্লাহ্র গজব পড়বে। এখানেও উনি বাঁকা ভাবে কুরআন ব্যাবহার করেছেন। এই শপথ নেয়ার নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট আছে। স্বামী যখন স্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যভিচারের সাক্ষী হাজির করতে না পারেন তখন তিনি এমন শপথ করবেন এবং স্ত্রীও এমন শপথ করবেন। একই আইন স্ত্রীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই ব্যবস্থা তৃতীয় পক্ষের কারও জন্য নয়। আল্লাহ্ পবিত্র কুরআনে বলেন,
وَ الَّذِیۡنَ یَرۡمُوۡنَ اَزۡوَاجَہُمۡ وَ لَمۡ یَکُنۡ لَّہُمۡ شُہَدَآءُ اِلَّاۤ اَنۡفُسُہُمۡ فَشَہَادَۃُ اَحَدِہِمۡ اَرۡبَعُ شَہٰدٰتٍۭ بِاللّٰہِ ۙ اِنَّہٗ لَمِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۶﴾
আর যারা নিজেদের স্ত্রীদের উপর অপবাদ দেয়, কিন্তু নিজেদের ছাড়া তাদের অন্য কোন সাক্ষী না থাকে, এ রকম প্রত্যেক লোকের সাক্ষ্য এভাবে হবে যে, সে চারবার আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী।
وَ الۡخَامِسَۃُ اَنَّ لَعۡنَتَ اللّٰہِ عَلَیۡہِ اِنۡ کَانَ مِنَ الۡکٰذِبِیۡنَ ﴿۷﴾
আর পঞ্চমবারে বলবে যে, সে যদি মিথ্যেবাদী হয় তবে তার উপর আল্লাহর লা’নত পতিত হবে।
وَ یَدۡرَؤُا عَنۡہَا الۡعَذَابَ اَنۡ تَشۡہَدَ اَرۡبَعَ شَہٰدٰتٍۭ بِاللّٰہِ ۙ اِنَّہٗ لَمِنَ الۡکٰذِبِیۡنَ ۙ﴿۸﴾
আর স্ত্রীর শাস্তি রহিত হবে যদি সে আল্লাহর নামে চারবার শপথ ক’রে বলে যে, সে (তার স্বামী) অবশ্যই মিথ্যেবাদী।
وَ الۡخَامِسَۃَ اَنَّ غَضَبَ اللّٰہِ عَلَیۡہَاۤ اِنۡ کَانَ مِنَ الصّٰدِقِیۡنَ ﴿۹﴾
এবং পঞ্চমবারে বলে যে, তার স্বামী সত্যবাদী হলে তার নিজের উপর আল্লাহর গযব পতিত হবে।
[সূরা আন-নূর, আয়াত ৬-৯]
এভাবে কেন তিনি কুরআনকে বাঁকা ভাবে ব্যাবহার করলেন? শুধু কলেমা পড়লেই বিয়ে বৈধ হয়? বিয়ের আর বিধানের কী হবে?
অনেকে বলছেন, আমার উপরের রেফারেন্সটি সঠিক নয়। মাওলানা সাহেব মুবাহালা করেছেন। কুরআনে মুবাহালার দলিল নীচের আয়াতটি:
(فَمَنْ حَاجَّكَ فِيهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَعْنَتَ اللَّهِ عَلَى الْكَاذِبِينَ)
হে নবী আপনার কাছে যে জ্ঞান এসেছে, তা নিয়ে যারা আপনার সঙ্গে ঝগড়া করে তাদেরকে বলুন এসো, আমরা আমাদের ও তোমাদের পুত্রদের, আমাদের ও তোমাদের নারীদের এবং স্বয়ং আমাদের ও স্বয়ং তোমাদের মুবাহালার জন্য আহ্বান করি। তারপর প্রার্থনা করি যে, মিথ্যাবাদীদের ওপর আল্লাহর অভিশাপ বর্ষিত হোক।
[সুরা আলে ইমরান, ৬১]
এই ব্যবস্থা মূলত শরিয়াহ সংক্রান্ত বিতর্কে ব্যাবহার করার নজির আছে। ইমাম ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, ‘অকাট্যভাবে সত্য প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরেও বিরোধীরা যখন গোঁড়ামি করে তখন মুবাহালার ডাক দেওয়া শরিয়তসম্মত। এভাবে মুবাহালার ডাক দিয়েছিলেন ইবনু আব্বাস, এরপর ইমাম আওযাঈ’।
মাওলানা সাহেব যদি নিকাহনামা, মেয়ের সাক্ষ্য, মেয়ের ওয়ালীর সাক্ষ্য, বিয়ের ওয়ালিমাতে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সাক্ষ্য, তার এবং মেয়েটির পরিবারের সদস্যদের সাক্ষী সাবুদ হাজির করার পরও কেউ তাকে অবিশ্বাস করতো, তবেই তিনি মুবাহালার সাহায্য নিতে পারতেন। শরিয়াহ যথেচ্ছ ভাবে ব্যাবহার করা কতটা শারিয়াহ সম্মত মাওলানা সাহেবই ভালো বলতে পারবেন। এভাবে মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে বিভ্রান্ত করা খুবই দুঃখজনক।
অত্যন্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে লেখাটা লিখতে হলো। গত দুই দিন ধরে এদেশের আলেম সমাজ এবং অনেক ধর্মভীরু মুসলিম ইসলামকে ডিফেন্ড না করে মাওলানা সাহেবের আচরণকে জাস্টিফাই করছেন। অথচ আল্লাহ্ বলেছেন,
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُوۡنُوۡا قَوّٰمِیۡنَ بِالۡقِسۡطِ شُہَدَآءَ لِلّٰہِ وَ لَوۡ عَلٰۤی اَنۡفُسِکُمۡ اَوِ الۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ ۚ اِنۡ یَّکُنۡ غَنِیًّا اَوۡ فَقِیۡرًا فَاللّٰہُ اَوۡلٰی بِہِمَا ۟ فَلَا تَتَّبِعُوا الۡہَوٰۤی اَنۡ تَعۡدِلُوۡا ۚ وَ اِنۡ تَلۡوٗۤا اَوۡ تُعۡرِضُوۡا فَاِنَّ اللّٰہَ کَانَ بِمَا تَعۡمَلُوۡنَ خَبِیۡرًا ﴿۱۳۵﴾
হে ঈমানদারগণ! ন্যায়ের প্রতি সুপ্রতিষ্ঠ ও আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদাতা হও যদিও তা তোমাদের নিজেদের কিংবা মাতা-পিতা এবং আত্মীয়গণের বিরুদ্ধে হয়, কেউ ধনী হোক বা দরিদ্র হোক, আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। অতএব প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না যাতে তোমরা ন্যায়বিচার করতে পার এবং যদি তোমরা বক্রভাবে কথা বল কিংবা সত্যকে এড়িয়ে যাও তবে নিশ্চয় তোমরা যা করছ, আল্লাহ সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত।
আল্লাহ্ আমাদের এই সীমাহীন এ্যারোগেন্সকে ক্ষমা করুন।