কথিত মানবিক নিকাহ ও মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ নিয়ে আলাপ
৭ এপ্রিল ২০২১ ২২:০০
পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তখন ফাতেমা জিন্নাহ নির্বাচন করবেন। কিন্তু ইসলামে তো নারী নেতৃত্ব হারাম। আর যে পাকিস্তানে নির্বাচন হচ্ছে সেটি সদ্য জন্মানো আধুনিক বিশ্বের প্রথম ইসলামিক রিপাবলিক।
কিন্তু মজার বিষয় হলো, ওই প্রথমবারের মতো ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ১২ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম সম্মিলিত ফতোয়া দিলেন—নারী নেতৃত্ব এই নির্বাচনে হারাম হবে না।
উনাদের যুক্তির পেছনে কারণ কী ছিল? কারণ ছিল, বছর কয়েক আগে আইয়ুব খান যেহেতু কোরআন বিরোধী মুসলিম পারিবারিক আইন পাস করেছেন,
কাজেই এই নির্বাচনে আইয়ুব খানকে সমর্থন না দিয়ে, মিস ফাতেমা জিন্নাহকে ভোট দেওয়া যেতে পারে।
অর্থাৎ এই নির্বাচনে আইয়ুব খান অধিকতর হারামি, তাই এই ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব হালাল হবে। এবং ১২ জন আলেম আলাদা আলাদাভাবে ১৫ দিন ধরে, এই ১২ পৃষ্ঠার বিবৃতি দিলেন। [ তথ্যসূত্র-১]
এই বিখ্যাত আলেমদের মধ্যে মাওলানা মওদুদী, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী থেকে শুরু করে তৎকালীন কম বয়স্ক আল্লামা আহমদ শফীও ছিলেন। ওই সময়ে প্রয়াত প্রখ্যাত আলেম মাওলানা আশারাফ আলী থানভী ও সাইয়েদ নদভীর বইয়ের রেফারন্সও ব্যবহার করা হয় উনাদের বিবৃতিতে।
অর্থাৎ এই ফতোয়া ছিল উপমহাদেশের মোটামুটি সব ঘরানার হুজুরদের সম্মিলিত ফতোয়া। একজন নারীর সর্বোচ্চ ক্ষমতায় যাওয়ার পক্ষে। মিস ফাতেমা জিন্নাহর পাশে তখন শেখ মুজিব, মনি সিং, মোজাফফর আহমদের মতো প্রগতিশীল রাজনীতিকরাও। তো ওই প্রগতিশীল নারী প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ মুচলেকা দিলেন এই বলে, ক্ষমতায় গেলে হুজুরদের আপত্তি আছে এমন কোরআন বিরোধী ধারাগুলো তিনি একদম বাদ দেবেন।
এবার সংক্ষেপে বলি, কোন কোন ধারায় হুজুরদের আপত্তি ছিল:
১) হুজুরদের কথা ছিল— দ্বিতীয় বিবাহ করতে হলে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হয়; এটা ইসলামের কোনো বিধান নয়। এটা মূলত প্রথম স্ত্রীর ক্ষমতায়নের নামে, রাষ্ট্রের চাপানো একটা শরিয়ত বিরোধী আইন।
আইয়ুব খানের বানানো ‘মুসলিম পারিবারিক আইন-১৯৬১’ আজও বহাল আছে বাংলাদেশে। আমাদের ওই আইনে আছে—প্রথম স্ত্রীর অনুমতি তো নিতে হবেই সালিশি বোর্ডের ইউনিয়ন/ওয়ার্ড কাউন্সিলর বরাবর দরখাস্ত করে, প্রথম স্ত্রীর আপত্তি নেই এই মর্মে সত্যায়িত করে বিয়ে করতে হবে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিয়ের লিগ্যাল এটাচমেন্ট পাওয়ার থাকবে প্রথম স্ত্রীর হাতে।
হুজুরদের আপত্তি ছিল, কোরআন হাদিসে এরকম কোনো প্রথম স্ত্রীর ক্ষমতা নেই। সালাফ ও সাহাবায়ে কেরাম প্রথম স্ত্রীদের অনুমতি না নিয়েই বিয়ে করেছেন, এমন বহু নজির আছে; এখন কেন অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হবে? [তথ্যসূত্র-২]।
হুজুরদের দ্বিতীয় আপত্তি ছিল— মুসলিম পারিবারিক আইনে বিয়ের ন্যূনতম বয়স ঠিক করা হয়েছিল। হুজুররা বললেন, ইসলামে এরকম কোনো সংখ্যা তাত্ত্বিক হিসাব নেই। কারণ তাদের যুক্তি ছিল, ইসলাম প্রাপ্তবয়স্ক হিসাব করে, পুরুষের দাড়ি গজানো আর মেয়েদের তিনটি পিরিয়ড হওয়াকে। কাজেই এই যে ছেলেদের ১৮ বছর আর মেয়েদের ১৫ বছর করেছেন আইয়ুব খান, এই ধারাটিও ইসলাম বিরোধী।
হুজুরদের তৃতীয় আপত্তি ছিল— মুসলিম পারিবারিক আইনে তিন তালাক বিষয়ে। সেখানে হুজুরদের দাবি ছিল— ইসলামের বিধান হচ্ছে কেবল পুরুষ তালাক দিতে পারবেন। নারীকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। নারী ইচ্ছা পোষণ করতে পারবেন, কিন্তু তালাক দেওয়ার ক্ষমতা স্বামীর হাতে। কিন্তু আইয়ুব খানের বানানো এই আইন বলছে, বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে নারীও ডিভোর্স লেটার দিতে পারবেন।
তো উনাদের কথা ছিল, আইয়ুব খানের আমলারা যেসব হাদিসের টেক্সট ব্যবহার করেছেন, সেগুলো জয়িফ বা দুর্বল হাদিস। আইয়ুব খানের এই আইন স্বামীর উপর জুলুম করছে। প্রথমত: মৌখিকভাবে তিন তালাকের কার্যকারিতা বাতিল হলো। দ্বিতীয়ত: যে ডকুমেন্টেশন ও তিন মাস মেয়াদী লম্বা ডিভোর্স সিস্টেম চালু হলো, সেটিতে নারীদেরও এক্সক্লুসিভলি ডিভোর্স দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হলো। উল্লেখিত হুজুরদের আপত্তি ছিল, এটি কোরআনের আইনের উপর খবরদারী।
একদিকে হুজুরদের আপত্তি। অপরদিকে সুফিয়া কামাল, শামসুন্নাহার মাহমুদ, আসমা জাহাংগীরদের মতো নারী অধিকার কর্মীদের অনড় অবস্থান। সুফিয়া কামালের মেয়ে অ্যাডভোকেট সুলতানা কামালের স্মৃতিচারণে পাই—তখন আইয়ুব খানের আমলারা মধ্যপন্থা অবলম্বন করল। ইসলামী বিধানে, ‘তালাকে আহসান’ এবং ‘তালাকে ইহসান’ বলে দু’টো পদ্ধতি আছে। সে দু’টো মিলিয়ে ‘তালাকে তৌফিজ’ পদ্ধতি আনা হলো।
পদ্ধতির বলে স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ তাদের বিবাহ বিচ্ছেদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন। এবং তিন তালাকের স্থলে, তিন মাসের মেয়াদ আনা হলো। তারা যদি মত পরিবর্তন করে ফেলে তাহলে সে তালাক কার্যকর হবে না। উল্লেখ্য, ভারত এই তিন তালাক আইন বাতিল করল মাত্র গত বছর। আমাদের ৬০ বছর পরে।
অনেকেই বলে থাকেন, হিন্দু আইন নিয়ে নারী নেত্রীরা সেদিন জোরালো আন্দোলন করেন নাই বলে, হিন্দু নারীরা এরকম এই তালাক ও উত্তরাধিকার ক্ষমতায়ন পাননি। উল্লেখ্য, এই আইন পাসের জন্য আইয়ুব খান যে স্বৈরশাসক থেকে রসগোল্লা হয়ে গেল, তাও না। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিলেন ওই সময়ের নারী অধিকার কর্মীরা। ওই সময়ের এক উত্তপ্ত মিটিং-এ বেগম সুফিয়া কামাল আইয়ুব খানকে ‘হাইওয়ান কা প্রেসিডেন্ট (আপনি জানোয়ারদের প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন)’।
ওই আইনের পক্ষে নারী নেত্রীদের আন্দোলনের সময় অন্যতম প্রধান নেত্রী কবি সুফিয়া কামালের পুত্র আহমেদ কামাল মর্মান্তিকভাবে খুন হন। এই স্মৃতিচারণ লিখছি এমন বাস্তবতায়, যখন আজকে ৬০ বছর পর এক হুজুর সেই বিপুল ত্যাগ তিতিক্ষার মুসলিম পারিবারিক আইন অমান্য করে রেজিস্ট্রিবিহীন দ্বিতীয় বিয়ে করছেন।
আর সেই নারী নেত্রীদের উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ওই আইন অমান্যকারীর ব্যাপারে আইনের জেল জরিমানাগুলো প্রয়োগ করতে পারছেন না। এদিকে আমার পরিচিত মানুষেরা ওই আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে রেজিস্ট্রিবিহীন একটি বিয়েকে কত স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন, এটিও অবাক করেছে আমাকে।
অথচ এরকম একটি রেজিস্ট্রিবিহীন বিয়ের ব্যাপারে সোচ্চার হওয়া উচিত সবারই। কেননা এভাবে রেজিস্ট্রিবিহীন বিয়ে আলেমদের ক্ষেত্রে জায়েজ ঘোষণা করলে, সমাজের অন্যত্র এরকম আইনের বরখেলাপপূর্ণ বিয়ের প্রচলন জনপ্রিয় হবে।
দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে অর্জিত, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে বাংলাদেশের আদালতে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, সন্তানদের উত্তরাধিকার, খোরপোষ ও মোহরানার অধিকার থেকে ওই নারীকে বঞ্চিত হতে হয়।
১৯৭৪ সালের মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনে (সংশোধিত ৮ মার্চ, ২০০৫) বলা হয়েছে ‘যদি কেউ বিবাহ রেজিস্ট্রি না করেন তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবে এবং এ অপরাধের জন্য আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড অথবা আর্থিক জরিমানা, যা তিন হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে, অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে।’ কাজেই কেউ রেজিস্ট্রিবিহীন বিয়ে করে, আইনের আওতায় আসছেন না, এই ঘটনা আইনের শাসনের যে নাগরিক আকাঙ্ক্ষা, এটিরও বিরোধী।
যে সমস্ত মানুষ আইনের শাসনের জিগির তোলে সরকারের সমালোচনা করেন, তারাও এক্ষেত্রে আইনের আওতায় আনার দাবী জানাচ্ছেন না। এটি একটি দুঃখজনক নোকতা হয়ে রইল।
তথ্যসূত্র:
১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড); হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত
২) পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তাকী উসমানী রচিত স্মৃতিগ্রন্থ ‘আমার জীবন’
লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট
সারাবাংলা/আইই