করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত হলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই
১৮ এপ্রিল ২০২১ ১৪:০১
গতকাল থেকে বাংলাদেশ এবং ভারতের মিডিয়ায় সম্প্রতি ল্যান্সেটে প্রকাশিত একটি গবেষণা নিয়ে যেসব প্রতিবেদন হচ্ছে তা জনমনে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এই বিষয়ে একজন জনস্বাস্থ্য বিশ্লেষক হিসেবে মানুষকে কিছু কথা বলা জরুরি বলে মনে করছি। গবেষণায় কী বলা হয়েছে, কেন এখনই এই ফলাফলকে চূড়ান্ত মেনে নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার দরকার নেই। এবং করোনা বায়ুবাহিত হলেও কেন আমরা আতঙ্কিত হবো না এই বিষয়ে আলোকপাত করেছি। প্রথমেই দেখা যাক এই গবেষণায় কী বলা হয়েছে।
কেন মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত?
১. এই গবেষকরা বলছেন এমন কিছু পরিবেশ আছে যেখানে হাঁচি, কাশির জলকণার মাধ্যমে কোনোভাবেই একজন থেকে আরেকজনের কাছে করোনাভাইরাস পৌঁছানোর কথা নয়, সেখানেও একজন থেকে আরেকজন সংক্রমিত হয়েছে, এমন প্রমাণ মিলেছে। উদাহরণ হিসেবে তারা প্রমোদতরী, কসাইখানা, বৃদ্ধাশ্রম, সংশোধনাগার বা জেলখানার উদাহরণ দিয়েছেন যেখানে মানুষ আলাদা কক্ষে বা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল। একজন আরেকজনকে হাঁচি কাশির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর কোনোই সুযোগ ছিল না। তবুও অনেকেই সংক্রমিত হয়েছে। সুতরাং তারা ধারণা করছেন শুধুমাত্র বাতাসে প্রবাহিত হয়েই পুরো জায়গায় করোনা ছড়িয়েছে।
২. তারা বলছেন কোয়ারেনটাইনে হোটেলগুলোতে পাশাপাশি থাকা রুমের মানুষ একজন আরেকজন যাদের কখনও দেখা হয়নি, অর্থাৎ একজনের হাঁচি কাশি আরেকজনের কাছে পৌঁছানোর কোনোই সম্ভাবনা নেই, তারাও পরস্পরকে সংক্রমিত করেছেন এমন প্রমাণ আছে। সুতরাং তারা মনে করছেন বাতাসের মাধ্যমেই একজনের কাছ থেকে আরেকজনে এই ভাইরাস ছড়িয়েছে।
৩. তারা বলছেন পৃথিবীতে সর্বমোট আক্রান্ত করোনা রোগীদের প্রায় ৫৯ শতাংশ উপসর্গবিহীন ছিলেন। অর্থাৎ তারা হাঁচি কাশি দিয়েছেন, বা হাঁচি কাশি থেকে আক্রান্ত হয়েছেন এমন প্রমাণ নেই। তাহলে কিভাবে এত মানুষের মধ্যে করোনা ছড়াল? তাদের ধারণা বাতাসের মাধ্যমে।
৪. গবেষকরা বলছেন করোনাভাইরাস ঘরের ভেতরে বেশি ছড়ায়, বাইরে নয়। ঘর বলতে তারা বোঝাচ্ছেন বদ্ধ জায়গা—যেমন বাসা, অফিস, গোডাউন, হোটেল ইত্যাদি। পার্ক, উন্মুক্ত জায়গা, মাঠ-ময়দান থেকে করোনা কম ছড়িয়েছে এমন প্রমাণ দেখা গেছে।
৫. তারা চার নম্বরের পক্ষে উদাহরণ দিয়ে বলেছেন করোনাভাইরাস nosocomial infections এর মাধ্যমে বেশি ছড়ায়, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট জায়গায়, যেমন হাসপাতালে। তারা বলছেন দেখা গেছে হাসপাতালে সমস্ত সুরক্ষা যেমন পিপিই পরেও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনা থেকে রক্ষা পাননি। এর কারণ, পিপিইসহ সকল প্রতিরক্ষাই মূলত জলকণাবাহিত সংক্রমণ ঠেকানোয় অধিক কার্যকরী, বায়ুবাহিততে ততটা নয়।
৬. ল্যাবরেটরির পরীক্ষায় বাতাসে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত করোনাভাইরাস থাকতে দেখা গেছে। করোনা রোগীর গাড়ির বাতাসেও এই ভাইরাস পাওয়া গেছে। অর্থাৎ হাসপাতাল কক্ষ বা গাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যাওয়ার পরও ৩ ঘণ্টা এই ভাইরাস বাতাসে থাকতে পারে, যা প্রমাণ করে বায়ুবাহিত হয়ে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে।
৭. করোনা রোগী ছিল এমন হাসপাতাল কক্ষের ভেন্টিলেটরে, বাতাস পরিষ্কার করার ফিল্টারে এই ভাইরাস পাওয়া গেছে।
৮. আলাদা বা ভিন্ন খাঁচায় রাখা করোনায় আক্রান্ত প্রাণী থেকে অনাক্রান্ত প্রাণীর মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়ানোর প্রমাণ দেখা গেছে, যা বায়ুপ্রবাহিত না হলে সম্ভব হতো না।
৯. এমন কোনো গবেষণা পাওয়া যায়নি যেটি সুনির্দিষ্ট করে বলতে পেরেছে যে করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না।
১০. করোনাভাইরাস হাঁচি কাশির জলকণার মাধ্যমে ছড়ায় এমন কোনো শক্তিশালী তথ্যপ্রমাণও কোনো গবেষণায় পাওয়া যায়নি।
তারা এই দশটি কারণ উল্লেখ করে বলেছেন যে করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত।
কেন গবেষণাটি নিয়ে আমাদের আরও জানতে হবে, ভাবতে হবে?
১. ল্যান্সেটে প্রকাশিত গবেষণাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সম্পূর্ণ মৌলিক নয়। এই গবেষণার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নির্ধারণ করে নতুন করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়নি। মূলত এর আগেই প্রকাশিত নানা গবেষণাপত্রে প্রাপ্ত তথ্যাদি থেকে একটি উপসংহার টানা হয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বলি— দু’ভাবে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করা যায়।
প্রথমত, আপনি জানতে চান যে করোনাভাইরাস কি বাতাসে ছড়ায় কিনা এবং তা জানার জন্য আপনি মাঠ পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট গবেষণা করে তথ্য প্রমাণ যোগাড় করবেন।
দ্বিতীয়ত, আপনি জানতে চান যে করোনাভাইরাস বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় কিনা, কিন্তু নানা কারণে আপনার পক্ষে এই জন্য নতুন কোনো গবেষণা করা সম্ভব নয়, কিন্তু করোনা নিয়ে প্রকাশিত নানা গবেষণাপত্র পড়ে আপনি বোঝার চেষ্টা করবেন যে এই ধারণা সত্য কিনা এবং সেটির উপর ভিত্তি করে একটি গবেষণাপত্র লিখবেন। এই গবেষণাটি দ্বিতীয় ধরণের। এ ধরণের গবেষণাকে ইংরেজিতে বলে সিস্টেমেটিক রিভিউ।
২. করোনাভাইরাস শুধুমাত্র বাতাসে ছড়ায় কিনা তা জানার জন্য আলাদা কোনো গবেষণা করা হয়নি। করোনা সংক্রান্ত অন্যান্য গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হয়েছে যে, করোনাভাইরাস সম্ভবত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। হাঁচি কাশি থেকে বের হওয়া জলকণার মাধ্যমে নয়। অন্যান্য গবেষণাপত্রের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই গবেষণাপত্রটি যারা লিখেছেন তারা মনে করছেন, করোনাভাইরাস সম্ভবত বায়ুবাহিত।
৩. এই গবেষণাটি যে পদ্ধতিতে করা হয়েছে, এবং যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে সেটি একটি ধারণার বৈজ্ঞানিক বহিঃপ্রকাশ মাত্র, এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে এমনটি বলা যায় না, এবং গবেষকরাও তা নিশ্চিতভাবে দাবি করেননি। তাদের মতে— করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত এবং তাদের এই গবেষণার ফলশ্রুতিতে এই বিষয়ে এখন নতুন এবং সুনির্দিষ্ট গবেষণা করা যেতে পারে।
৪. যদি এই গবেষণার ধারণাটি চূড়ান্ত হয়, তবুও সেটি সবকিছু আমূল পরিবর্তন করে দেবে না, কারণ করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত এটি অনেক আগে থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, আমার গতবছরের লেখাগুলোতেও আমি সেটিই উল্লেখ করেছিলাম। তবে হাঁচি কাশির মাধ্যমে না ছড়িয়ে বাতাসের মাধ্যমে ছড়ালে কিছু বিষয়ে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেটি নিচে উল্লেখ করব।
বার বার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত নয় এমন দাবি কখনই করা হয়নি। শুরু থেকেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলে আসছিলেন বাতাসের মাধ্যমে করোনা ছড়াতে পারে, তবে মূলত বাতাসে ভেসে বেড়ানো ড্রপলেটের মাধ্যমে, অর্থাৎ হাঁচি, কাশির সময় বের হওয়া জলকণার মাধ্যমে এই জীবাণু একজন থেকে আরেকজনে যায়। কিন্তু নতুন এই গবেষণাপত্রে বলা হচ্ছে ‘ড্রপলেট’ এর মাধ্যমে অর্থাৎ হাঁচি কাশি থেকে বের হওয়া জলকণায় ভেসে করোনাভাইরাস একজন থেকে আরেকজনে পৌঁছায় সেটি তারা মনে করেন না। তারা মনে করছেন এই ভাইরাস ছড়ানোর জন্য জলকণার দরকার নেই, শুধুমাত্র বাতাসের মাধ্যমেই এটি ছড়াতে পারে।
এই গবেষণায় ড্রপলেটের গুরুত্ব কমিয়ে এরোসলের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে। সহজ বাংলা বললে বলা হচ্ছে হাঁচি কাশি থেকে সতর্ক থাকলেই শুধু হবে না, বরং শুধুমাত্র দু’জন মানুষের কথা বলার সময়ে বাতাসে ছড়ানো ভাইরাসই কোভিড-১৯ সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট।
করোনা বায়ুবাহিত হলে নতুন কী কী সতর্কতা অবলম্বন করা দরকার হতে পারে?
১. অন্যের শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে দূরে থাকতে হবে। শুধু ৬ ফুট দূরত্বে থাকলেই হবে না, ঘরে বাইরে যে কোনো জায়গায় যেখানে পরিবারের সদস্যের বাইরে মানুষের আনাগোনা আছে সেখানে উন্নত মানের মাস্ক পরে থাকতে হবে। কেননা কেউ যদি ওই মুহূর্তে ওই জায়গায় নাও থাকে, তার ছড়ানো ভাইরাস বাতাসে থেকে যেতে পারে ৩ ঘণ্টা পর্যন্ত।
২. হাঁচি কাশির সাথে সাথে কারও সাথে কথা বলার দূরত্ব বাড়াতে হবে, গান গাইলে সেখান থেকে দূরে থাকতে হবে, চিৎকার করে কথা বলা মানুষ থেকে বা বক্তৃতা থেকে দূরে থাকতে হবে।
৩. বদ্ধ জায়গায় থাকা কমাতে হবে। নিজের বাসা নয়, এমন বদ্ধ জায়গায় পারলে না থাকার চেষ্টা করতে হবে।
৪. ঘরে থাকলে বা বদ্ধ জায়গায় থাকলে সেখানকার দরজা জানালা খোলা রাখতে হবে, পারলে নিরাপদ দূরত্বে বাইরে থেকে ঘুরে আসতে হবে। বদ্ধ জায়গায় বা ঘরে ভেন্টিলেশনের ভালো ব্যবস্থা রাখতে হবে।
৫. যেনতেন মাস্ক পরলে হবে না। মোটামুটি মানের মাস্ক হাঁচি কাশির জলকণা থেকে প্রতিরক্ষা দিলেও বায়ুবাহিত ভাইরাস থেকে প্রতিরক্ষা দিতে পারে না, তাই মাস্কের মান বাড়াতে হবে।
আমাকে যদি বলেন, আমি মনে করি মানুষের জীবনযাত্রায় বর্তমানের চেয়ে বেশি পরিবর্তন আনা প্রায় অসম্ভব। ধরুন আপনার স্বামী বা স্ত্রী ব্যাংকে কাজ করেন। তিনি যদি সাধারণ মানের মাস্ক পরেন, তবে কর্মক্ষেত্র থেকে তিনি ভাইরাস এনে বাসায় ছড়িয়ে দিতে পারেন। এখন স্বামী বা স্ত্রীর মাধ্যমে ভাইরাস থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আপনি কি বাসাতেও ২৪ ঘণ্টা মাস্ক পরবেন? এটি অসম্ভব একটি ব্যাপার। খাতাকলমে আমি আপনাকে এই পরামর্শ দিতে পারি, কিন্তু আমার নিজের পক্ষেও সেটি মানা সম্ভব নয়।
করোনাভাইরাস যে মাধ্যমেই ছড়াক না কেন, আমাদের করণীয় প্রধান কাজ হচ্ছে
১. সুযোগ পেলেই ভ্যাকসিন নিয়ে নেওয়া।
২. যতদূর সম্ভব পরিবারের সদস্য নয়, এমন মানুষের সাথে শারীরিক দেখা সাক্ষাৎ এড়িয়ে চলা।
৩. বাইরে গেলে যতটা সম্ভব উন্নত মাস্ক ব্যবহার করা।
৪. মানসিক অবস্থা মানুষের শারীরিক সক্ষমতাকেও প্রভাবিত করে। সুতরাং মনকে চাঙ্গা রাখা, নাহলে ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীর ভাইরাসকে ঠেকাতে যথেষ্ট সক্ষম নাও হতে পারে।
আমার অনুরোধ থাকবে, করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত এটি নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা না করা। এই গবেষণাই চূড়ান্ত নয়, এবং বায়ুবাহিত হলেও গত দেড় বছরে এটি পৃথিবীর একশভাগের একভাগেরও অনেক কম মানুষকে মারতে পেরেছে, সুতরাং আমাদের সবকিছু আমূল পালটে ফেলতে হবে এমন না। আপনার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে সুস্থ থাকুন।
লেখক: সোশ্যাল এন্ড বিহেভিয়ারাল হেলথ সায়েন্টিস্ট, ডক্টরাল রিসার্চার, ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো