Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারাভিযান ও রাজনৈতিক বক্তৃতা


২৪ এপ্রিল ২০২১ ২১:১৪

করোনার সংক্রমণ যখন আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে ঠিক সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধান সভার নির্বাচনী প্রচারে ব্যবহৃত বিভিন্ন স্লোগান ও ভাষার প্রতি সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী প্রচারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যবহৃত স্লোগান, বক্তব্য এবং আচরণের প্রভাবও কোন কোন ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেমন নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের বক্তব্য থেকে ‘খেলা হবে’, এবং বাংলাদেশের তথা আওয়ামী লীগের ‘জয় বাংলা’ প্রভৃতি পশ্চিমবঙ্গের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের মূল স্লোগান হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতায় ব্যবহৃত ভাষার মধ্য দিয়ে কোন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রকাশ পাচ্ছে, সে সম্পর্কেও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ব্যবহৃত ‘ভাষা’ ও ‘শব্দ প্রয়োগ’ এর সাথে বাংলাদেশের বর্তমানে ক্রিয়াশীল রাজনীতিকদের কারও মিল খুঁজে পাওয়া যাবে কী না তা বড় ধরনের অনুসন্ধানের বিষয়। একদিকে প্রাদেশিক ‘রাজনৈতিক/সরকারি ক্ষমতা’ ধরে রাখা, এবং অন্যদিকে ‘ক্ষমতা’য় অধিষ্ঠিত হওয়ার উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনী প্রচারণা পর্যবেক্ষক মহলে বেশ আগ্রহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে।

বিজ্ঞাপন

মমতা ব্যানার্জির উদ্দেশ্যে নরেন্দ্র মোদী তাঁর এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘দিদি, ও দিদি’। জনসভার বক্তৃতায় এভাবে সম্বোধন করাকে তৃণমূল কংগ্রেস অপমানজনক মনে করেছে। এজন্য, তৃণমূল কংগ্রেস দলের পক্ষে অভিনেত্রী জুন মালিয়া, অনন্যা চক্রবর্তী, এবং শশী পাঁজা সাংবাদিক সম্মেলন করে এর প্রতিবাদ করেছেন। তাঁদের মতে এই স্টাইলে ‘দিদি, ও দিদি’ বলাটা খুবই অপমানজনক। প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিশেষত তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী সমর্থকগণ নিজেদের পক্ষের সমর্থনে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী সমর্থকদের বিপক্ষে মৌখিকভাবে আক্রমণাত্মক ভাষা প্রয়োগ করছেন। শুধু তাই নয়, এই আক্রমণ প্রায়ই শারীরিক আক্রমণের দিকে পর্যবসিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে, প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচনের প্রচারের সময় নেত্রী-নেতাদের ব্যবহৃত ভাষা কোন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বা রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিচয় বহন করছে ? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের পক্ষে প্রচারণা সভার বক্তৃতায় নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে এমনসব ‘শব্দ’ প্রয়োগ করছেন যা’ ভারতীয় গণতন্ত্র ও বাঙালি সংস্কৃতির সৌজন্য ও শিষ্টাচার বহির্ভূত বলে পর্যবেক্ষকগণ মনে করছেন। যদিও তৃণমূল কংগ্রেস বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার কথা এবং ঘরের মেয়েকে ভোট দেয়ার কথা বলছে।

বিজ্ঞাপন

‘দিদি’ কীভাবে তাঁকে অপমান করছেন, সেই হিসাব দিয়েছেন মোদী। নির্বাচনী প্রচার সভা শুরু অর্থাৎ ১৯ মার্চ থেকে মমতা ব্যানার্জী লাগাতার অপমান করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদীকে । যে ভাষা মমতা ব্যবহার করছেন তা অপমানের। জনসভায় দাঁড়িয়ে এমনটিই বলেছেন মোদী। ‘বাংলার মানুষের স্বার্থে অপমান সইতে রাজি’, বলেছেন মোদী। ‘দিদি’ (মমতা) তাঁকে (নরেন্দ্র মোদীকে) কতবার কী বলে অপমান করেছেন, বাংলা তথা সমগ্র ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তার হিসাব তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, দীর্ঘ ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পরেও দিদির মুখে এই ‘ভাষা’ অভাবনীয়! বাংলার মহান ব্যক্তিরা ভারতের গৌরব হিসাবে আখ্যায়িত করে তিনি সেই অঞ্চলের একজন নেতার মুখে এমন ধরনের কথা ঠিক নয় বলে মন্তব্য করেছেন। ভারতীয় সংবাদ বিশ্লেষকগণ বলছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভাষার সন্ত্রাস চলছে।’ শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক নেতা-কর্মীরা বিজেপি-র নেতা কর্মীদের ওপর শারীরিকভাবে আক্রমণ চালাচ্ছেন। কোলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের বর্তমান মেয়র, তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতা ফিরহাদ হাকিমের বিরুদ্ধে বিজেপি-কে আক্রমণের হুকুম দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এভাবে, ভারতীয় গণতন্ত্র ও বাঙালির সৌজন্য ও শিষ্টাচারের সংস্কৃতির পাশাপাশি এগুলো কোন ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

নিদেনপক্ষে প্লেটোর সময় থেকে রাজনৈতিক ধারণা বা পলিটিক্যাল আইডিয়া রাজনীতি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট গুরুত্ব সংযোজন ঘটিয়েছে। এটা বলা হয়ে থাকে যে, ‘ধারণা’ বা ‘আইডিয়া’ বিশ^টাকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। ‘আইডিয়া’ বা ‘ধারণা’ পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে পারা সম্পর্কীয় পর্যবেক্ষণটি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে কী এবারের নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে ? যা হোক, এই ‘আইডিয়া’ বা ‘ধারণা’ থেকেই উৎপত্তি লাভ করেছে ‘আইডিওলোজি’ প্রত্যয় বা শব্দটি, বাংলায় যাকে বলে ‘আদর্শ’ বা ‘মতাদর্শ’ । রাজনীতি অধ্যয়নের ক্ষেত্রে আমরা বলে থাকি ‘পলিটিক্যাল আইডিওলোজি’ বা ‘রাজনৈতিক আদর্শ বা মতাদর্শ’। বলা বাহুল্য, বক্তৃতা, বিবৃতি বা কথার মধ্যে ব্যবহৃত ‘ভাষা’ ও ‘শব্দ’ একজন মানুষের ‘মূল্যবোধ ও বিশ^াস’-এর বহি:প্রকাশ।

আট দফায় (মার্চ ২৭, এপ্রিল ১, এপ্রিল ৬, এপ্রিল ১০, এপ্রিল ১৭, এপ্রিল ২২, এপ্রিল ২৬, ও এপ্রিল ২৯) অনুষ্ঠিত হচ্ছে ২৯৪ আসন বিশিষ্ট পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভার এবারের নির্বাচন। ২মে প্রকাশিত হবে নির্বাচনের ফলাফল। ভারতের অন্যকোন বিধান সভার নির্বাচন এত বেশী দফা ওয়ারীভাবে অনুষ্ঠিত হয় নাই। এই নির্বাচনের ফলাফল কী হবে (?), এনিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বেশ কৌতূহল আছে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরসূচী নিয়ে বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছিল যে বাংলাদেশের এই রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব কে করবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব তাদেরই !! অপরদিকে, মতুয়া সম্প্রদায়ের পীঠ স্থান বাংলাদেশের গোপালগঞ্জের ওড়াকান্দিতে হরিচাঁদ ঠাকুর ও গুরুচাঁদ ঠাকুরের আশ্রমে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পরিদর্শন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও যথেষ্ট আপত্তি ছিল, যা তিনি প্রকাশ্য জনসভার বক্তৃতায় জানিয়েছেন। অতএব, বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে, প্রকাশ্যে মতামত ব্যক্ত না করলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য স্তরের ক্ষমতায় কোন দলের আসা উচিত এনিয়ে ভিতরে ভিতরে বাংলাদেশের মানুষের মন পছন্দ অপছন্দের দোলনায় দুলছে তো দুলছেই! সেদিন মধ্যস্বত্তভোগী একজন রাজনৈতিক কর্মীর কণ্ঠে বিজেপি না তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসছে এনিয়ে বেশ ঔৎসুক্য লক্ষ্য করলাম। অনেক সময়েই দেখা যায় বাংলাদেশে মামুনুল হক-এর সমর্থকগণ পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের নিঃশর্ত সমর্থক। তবে, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে আমার কৌতূহল নেতা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতার ধরনের মধ্য থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোন ধরনের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে তার দিকে।

পশ্চিমবঙ্গের এই বিধান সভা নির্বাচনের প্রচারণার কাজে ভারতের প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘন ঘন পশ্চিমবঙ্গে আসছেন। গুজরাট বা ভারতের জাতীয় নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদী যতটা সংযুক্ত হয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের এই নির্বাচনে তার চেয়ে অনেক বেশী সংযুক্ত হয়েছেন। এথেকেই সহজেই অনুধাবন করা যাচ্ছে যে এই নির্বাচন নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর দল বিজেপি-র নিকট কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া, অনেক প্রেক্ষাপট থেকে, পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচন সেদেশের দীর্ঘকালস্থায়ী রাজনৈতিক সংস্কৃতি তথা নিয়মকানুন থেকে স্খলনের ইঙ্গিত করছে। নির্বাচনী প্রচার প্রচারণার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী ও তৃণমূল কংগ্রেসের সভাপতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতার ভাষা এবং এসবের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের বিশেষত: প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ, ভারতীয় জনতা পার্টির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানী, কৈলাশ বিজয়বর্গীয়, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজিপির সভাপতি দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিন্হা, শুভেন্দু অধিকারীসহ বিজিপি-র নেতাদের বক্তব্য এক্ষেত্রে বিবেচনাযোগ্য। উল্লেখ্য, প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস ছাড়াও এই নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, সিপিআইএম, ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ), অল্ ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম) এবং নির্দলীয় প্রার্থীরাও অংশগ্রহণ করছেন। যা হোক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তৃতায় যে শব্দ বা ভাষা ব্যবহার করছেন, তা’র দ্বারা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে তিনি ব্যতিক্রমভাবে ইনফরমাল বা অনানুষ্ঠানিক, এবং একই সাথে তিনি খুবই নিশ্চয়তার সাথে কথা বলেন। বস্তুত, তিনি বিশ্লেষণী চিন্তার দিক দিয়ে নিচু মানের হলেও, তাঁর কথা বলার ধরন, পশ্চিমবঙ্গের বিগত মুখ্যমন্ত্রীদের চেয়ে আস্থা বা কনফিডেন্সের দিক দিয়ে মাত্রাতিরিক্তভাবে উঁচু। অর্থাৎ বক্তব্যে ব্যবহৃত ভাষা অশ্লীল হলেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেলফ কনফিডেন্স বা আত্মবিশ্বাস দৃশ্যত খুবই উঁচু বলেই মনে হচ্ছে!

এপ্রিলের ৩ তারিখ কোচবিহার জেলার শীতলকুচিতে জনসভা করে ফিরে আসার পথে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিজেপি-র সভাপতি দিলীপ ঘোষের গাড়ীতে আক্রমণ করা হয়। এতে দিলীপ ঘোষ নিজে আহত হন এবং তাঁকে বহনকারী গাড়ীটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এভাবে, আগে থেকেই উত্তপ্ত শীতলকুচিতে গত ৭ এপ্রিল নির্বাচনী জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নেতৃত্বাধীন তৃণমূলের নেতাকর্মীদের এক দল কেন্দ্রীয় বাহিনী সিআরপিএফ-কে ‘ঘেরাও’ করে রেখে আরেক দলকে ‘ভোট’ দিতে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। বিরোধী দল বিশেষত বিজেপি, স্পষ্টত এটিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর সরাসরি আক্রমণের হুকুম দেয়া হিসাবে বিবেচনা করছে। এরপর ১০এপ্রিল ২০২১তারিখে যখন ওই আসনে ভোট গ্রহণ শুরু হয় তখন প্রথমে ভোট দেয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা এক রাজবংশী যুবককে অজ্ঞাত দুষ্কৃতিকারীরা গুলি করে হত্যা করে।

বিজেপি এবং নিহত যুবকের নিকটজনেরা তাকে বিজেপি-র সমর্থক হিসাবে দাবী করেছে। এসময় বিশাল সংখ্যক উশৃংখল জনতা শীতলকুচির ১২৬ নম্বর পোলিং বুথ ঘেরাও করে। তৃণমূলের কর্মী সমর্থকদের ঘেরাওয়ের ফলে, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে প্রিজাইডিং অফিসার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় সেখানে অবস্থানরত কেন্দ্রীয় বাহিনী উন্মত্ত জনতার ওপর গুলি বর্ষণ করতে বাধ্য হয়। ফলে, চারজন যুবক নিহত হয়।

শীতলকুচির ঘটনা কেন্দ্রিক নাটকীয়তায় ভিন্ন মাত্র পায় যখন শীতলকুচির মৃত্যু নিয়ে সেখানকার তৃণমূল প্রার্থী পার্থপ্রতীম রায় এবং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যয়ের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিয়োক্লিপ প্রকাশিত হয়ে পড়ে। এনিয়ে বিজেপি নির্বাচন কমিশনের নিকট অভিযোগ দায়ের করেছে। অপর দিকে, তৃণমূল কংগ্রেসও এই অডিয়োক্লিপ প্রকাশের বিরোধিতা করে অভিযোগ দায়ের করেছে।

এখন থেকে বছর দু’য়েক আগের কথা। একবার নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন যে মমতা তাঁকে প্রতি বছর কুর্তা পাজামা উপহার দেন। খাওয়ান বাংলার মিষ্টি। এই দাবী নিয়ে বিস্তর জল ঘোলা হয়েছিল তখন। এখনো তেমনটি আছে কী না জানা যায়নি। তবে এবারের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মমতা যেসব অসৌজন্যমূলক কথা বলেছেন সেসবের একটা খতিয়ান তুলে ধরেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। গত ১৭ এপ্রিল দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুরে অনুষ্ঠিত জনসভায় নরেন্দ্র মোদী দিন তারিখ উল্লেখ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক তাঁর (মোদীর) বিরুদ্ধে বলা বিভিন্ন অশালীন বক্তব্য জনগণের সামনে তুলে ধরেন। মোদী বলেন, ‘দিদি কি সুভা অর সাম মোদীকো গালি দিয়ে বিনা না শুরু হোতি হ্যায়, অর নাহি খতম হোতি হ্যায়’। (২০২১)-এর ১৯ মার্চ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘মুখ দেখব না’ (১৯ মার্চ কো দিদি নে কাহা ও মোদী কো চেহেরা দেখ না চাতি’) কারণ মোদী লুটেরা, দাঙ্গাবাজ, দুষ্টবুদ্ধি, মিথ্যাবাদী; ২০মার্চ এক জনসভায় মমতা নরেন্দ্র মোদীকে বলেছিলেন ‘শ্রমিকদের ঘাতক’; ২৪ মার্চ বলেছিলেন ‘মিথ্যাবাদী’; ২৫ মার্চ মমতা নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘তুমি শালা খুনিদের রাজা’ (২৫ মার্চ মে দিদি নে বোলা তুম শালা খুনি কা রাজা, খুনি কা জমিনদার, তুমনে ছারে পয়সে লুঠ লিয়া); ২৬ মার্চ বলেছিলেন, ‘মোদীর দাড়ি বেড়েছে, আর কিছু বাড়েনি’ (দেশকো ¯্রফি মোদী জাবতি দাড়ি বাড়তি রাহি হ্যায়, মোদী ক্যা স্ক্রু ঢিলা হো গ্যায়া হ্যায়); ৪ এপ্রিল মমতা বলেছিলেন, ‘মোদী ভগবান না কি?’; ১২ এপ্রিল মমতা বলেছিলেন, ‘( মোদী) দাঙ্গা করেন’; ১৩ এপ্রিল নরেন্দ্র মোদী-কে আবারও ‘মিথ্যাবাদী’ বলে সম্বোধন করেন। এভাবে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিপক্ষকে অশালীন বক্তব্য দিয়ে অপমান করা নি¤œমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে। যা তাঁর ঘোষিত ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাজনীতির সংরক্ষণের জন্য সহায়ক নয়।

অপরদিকে, অল্ ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম)-র ৭ জন প্রার্থী এই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দলীয় প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশগ্রহণের জন্য অল্ ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম)-এর সভাপতি আসাদউদ্দিন ওয়াইসি সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সফর করেছেন। একটি নির্বাচনী প্রচার সভায় প্রদত্ত ভাষণে ওয়াইসি বলেন নরেন্দ্র মোদীর উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিরোধিতা করতে মমতা ব্যানার্জী যদি রাজনৈতিক মঞ্চে চন্ডী পাঠ করতে পারেন। অরবিন্দ কেজরিওয়াল যদি হনুমান চল্লিশা পাঠ করতে পারে। রাহুল গান্ধী যদি মন্দিরে মন্দিরে ঘুরতে পারে। মোদীর উগ্র হিন্দুত্ববাদীর মোকাবিলা বাবা সাহেব আম্বেদকরের রচনা করা ভারতীয় সংবিধানকে সামনে রেখেই করা যেতে পারে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা প্রত্যেক ধর্মকেই মান্যতা দেয়। এবং এই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রমাণ সুরা ফাতিহা পাঠ করেই করবো। ভারতীয় সংস্কৃতির প্রবক্তা বিজেপি, মমতা ব্যানার্জীর ব্যাখ্যানুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তা তৃণমূল কংগ্রেস, প্রগতিবাদী বাম ও ভারতীয় কংগ্রেস, পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত ইন্ডিয়ান সেক্যুলার ফ্রন্ট, আসাউদ্দিন ওয়াইসির নেতৃত্বাধীন অল্ ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন, এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার প্রচারণা মুখর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অশ্লীলতা থাকলেও তা বহুত্ববাদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করে।

লেখক: অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী, ‘ইনস্টিটিউশনালাইজেশন অব ডেমোক্র্যাসি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থের লেখক; পরিচালক, সাউথ এশিয়ান স্টাডি সার্কেল এবং অধ্যাপক ও সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।

বিজ্ঞাপন

সাইফুলের জানাজায় মানুষের ঢল
২৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৫৫

আরো

সম্পর্কিত খবর