স্বাধীনতার কালপঞ্জি
২৫ মার্চ ২০১৮ ১৬:০৬
।। ডা. রাজিবুল বারী পলাশ ।।
১
তাকে বলতে পারেন শ্যামলা বরণের ছিপছিপে গড়নের দর্জি! সকাল থেকে সে শুধু ছুটছে আর ছুটছে। কোথা থেকে কাপড় ম্যানেজ হবে কে জানে? ভোরে অল্প একটু পান্তা আর লবণের সাথে কাঁচা মরিচ পিষে কোন মতে পেট ঠাণ্ডা করেই বেরিয়ে পড়েছে। আর সেলাই মেশিনের কী অবস্থা কে জানে। বেশ কিছুদিন হলো তেল দেয়া হয়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসব এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই হয়তো দিন শুরু হয়েছিলো ছেলেটার। সে বুনেছিলো স্বাধীন দেশের পতাকা। হয়তো তাঁর হাত কাঁপছিলো। কত মানুষ দেখবে। না জানি কী বলবে।
একটু তাড়াও ছিলো। সময় পেলে হয়ত আরেকটু সুন্দর করা যেতো। সে সময় সে পায়নি। কিন্তু পতাকা একটা হয়েছিলো। আমাদের প্রথম পতাকা। স্বাধীন বাংলার পতাকা। হয়তো তাঁর নাম ঠাই পায়নি রেকর্ড বুকে। হয়তো সেই পতাকা উত্তোলন করেছে অন্য কেউ। হয়তো সে পতাকা তৈরি করে দিয়েছে আন্দোলনের শক্ত ভিত। পতাকায় তাকিয়ে হাজারো কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো ‘জয় বাংলা’!
২
বন্দরনগরী করাচী। সময়- সকাল সাড়ে ৯টা। রাষ্ট্রীয় আদেশ দ্রুত অস্ত্রগুলো প্লেনে ভরতে হবে। বেশ কয়েকজন মিলে সেগুলো খুলে খুলে চেক করছে। অস্ত্রের আওয়াজ হচ্ছে ঝনঝন। হাজারে হাজারে অস্ত্র। আধুনিক সব অস্ত্র। চকচকে, ভার্জিন, মেটালিক, ফ্রেশ আর স্টেইনলেস সব অস্ত্র। আমেরিকা দিয়েছে সবচেয়ে বেশি। খোলাখুলি অস্ত্র না দেয়ার চুক্তি থাকলেও পাকিস্তানকে গোপনে দেয়া হয়েছে এসব অত্যাধুনিক অস্ত্র। কিসিঞ্জার, নিক্সনের সঙ্গে পাকিস্তানি জেনারেলদের কী দফারফা হয়েছে কে জানে।
ওদিকে সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে পূর্ব বাংলায় আসছে। কিন্তু কেন? নির্বাচনের ফল মেনে না নেয়ায় একটু শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে বটে। হয়তো আলোচনা হবে মুজিবের সাথে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভাবছেন পূর্ব-পাকিস্তান যাওয়া দরকার। কে জানতো এইসব অস্ত্রে ভরা বুলেটগুলো বিদীর্ণ করবে রহমত, নিখিল, সবুজ আর আমেনাদের বুক। ওরা তো এসবের কিছুই জানতো না। ভোর হলে কুয়াশা ভেঙ্গে মাঠে গিয়ে জমি নিড়াতো। কোনোদিন রাজনীতির মারপ্যাঁচ বোঝেনি। বুঝতেও চায়নি।
দুপুরে বাসনে করে গরম ভাত, একটু ডাল আর একটু সবজি। কাজ শেষে গুনগুনিয়ে গান। ক্ষেতের আইল দিয়ে চকের মধ্যে দিয়ে সোজা বাড়ী। দূরে ঐ যে জোড়া তাল গাছ দেখা যায়। সেখানেই ওদের জন্মভিটা।
বিকেলের মিষ্টি রোদে শ্যামলা বরণের মানুষগুলো কেমন যেন সোনার মত উজ্জ্বল হয়ে যায়। পুকুরে গোসল সেরে, গরুগুলোকে গোয়ালে রেখে গ্রামের বাজারে যেতো। আসতে আসতে রাত। হারিকেন হাতে পাশের বাড়ীর অসুস্থ চাচীকে দেখে বাড়ী এসে ক্লান্ত ঘুম। ঢাকায় কেন মিলিটারি আসলো, এই গ্রামের মানুষের সাথে তাদের কিসের শত্রুতা তা ওরা জানতো না।
তবু একদিন মিলিটারি এসেছিলো। এই মাঠে, খালের পাড়ে…। আর সবুজ মাঠে পড়ে ছিলো রহমত, নিখিল, সবুজ আর আমেনাদের বুলেটে ঝাঁঝরা বুক। আমেরিকা থেকে করাচী ঘুরে কেন এই বালিয়াডাঙ্গির গ্রামের মানুষগুলোকে বিদ্ধ করতে এসেছিলো বুলেটগুলো তা আমরা বুঝতে পারিনি। হায় ইতিহাস। তোমাকে ঋদ্ধ করতে একদা বাংলায় লেখা হয়েছিলো রক্তের গল্প।
৩
এভাবে কতোদিন? উত্তাল মার্চে ফেটে পড়েছিলো বাঙালি। শোনা যাচ্ছিলো বঙ্গবন্ধু ৭ তারিখে রেসকোর্সে আসবেন। ছাত্ররা রাত জেগে ফেস্টুন বানাল। শিল্পীরা তৈরি করল নানা উপস্থাপনা। শিক্ষক তুলে ধরলেন আমাদের বঞ্চনা।
সাধারণ মানুষ বুঝতে পেরেছিল, এভাবে ঠিক চলতে পারেনা। তাইতো ৭ মার্চ ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হল রাজপথ।
এতোদিনের নিপীড়িত বাঙালি এত শক্তি-সাহস কোথা থেকে পেল? হেঁটেই চলে যাচ্ছে মাইলের পর মাইল। কড়া রোদ, খালি পেট। হাতে লাঠি। আকাশে বাতাসে কম্পমান ধ্বনি ‘জয় বাংলা।’ ঢাকার বাইরে লাখো মানুষ রেডিও হাতে অপেক্ষায়। সরাসরি শুনবেন তারা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। কিন্তু না। সে ভাগ্য তাদের হয়নি।
দুপর আড়াইটায় হঠাৎ পাকিস্তান সরকার জোর করে দেশের সব রেডিও স্টেশন বন্ধ করে দেয়। মুহূর্তেই ক্ষোভে বেরিয়ে পড়ে রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা। আর সব বাধা পেরিয়ে মুজিব ঘোষণা দেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
লাখো বাঙালীর ধমনীতে বেজে ওঠে হাজার বছরের শোষণ থেকে মুক্তির বাসনা। আসে এক তীব্র আবেগের ঢল। তখন বাঙালির চোখে বিচ্ছুরিত একটি পতাকা। একটি মানচিত্র। স্বাধীন বাংলার মানচিত্র। ক্লান্তি নেই, রোগ-শোক নেই, বর্ষা, শীত, বুলেটের ক্ষত, স্বজন হারানোর বেদনা… কোন কিছুই টলাতে পারেনি মুক্তিকামী বাঙালিকে।
অবশেষে সব হারিয়ে অভাবনীয় সমৃদ্ধিশালী এক স্বাধীন বাংলার জন্ম হয়েছিলো একদিন। পুরো পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে গর্জে উঠেছিলো বীর বাঙালি। সে হুংকার মুহূর্মুহু প্রতিধ্বনিত হয়েছিলো পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। হাসতে হাসতে জীবন দিতে জানা সেই বাঙালীর গল্প মুহূর্তেই শেষ হবার নয়।
এখনো বাঙালী স্মরণ করে সেই সব মহান বীরত্বগাঁথা। শিশুরা ছবি আঁকে। নরম তুলিতে, রঙিন আর আকাশ সমান ভালোবাসামাখা ছবি। শিল্পীরা বাঁধেন নতুন গান। সাংবাদিক তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় সব গল্প। শিক্ষক বিলান মোহময় প্রেরণা। কৃষক করেন জমি চাষ। গ্রামের ছোট্ট কিশোরী ছুটে চলে অবাধ্য অবুঝ স্বাধীনতায়। ভর দুপুরে দৌড়াতে দৌড়াতে মাঠের কোণে শিরিষ গাছের ছায়ায় দাঁড়ায় সে। তার নিঃশ্বাস খুব দ্রুত, কলমির ঘ্রাণ মেশা, মিষ্টি বাতাসের নিঃশ্বাস, বড্ড শক্তিশালী, বড্ড সুখের। এ নিঃশ্বাস স্বাধীনতার, বিজয়ের।
লেখক- ডা. রাজিবুল বারী পলাশ, সহকারী অধ্যাপক ও পিএইচডি গবেষক- ইউনিভার্সিটি অব টোকিও
সারাবাংলা/ এসবি