করোনায়ও অর্জন; সুখেও ভূতে কিলায়?
১ মে ২০২১ ২০:৪৭
জাতিসংঘের তিন তিনটি সংস্থার সদস্য নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ২০ এপ্রিল ইকোসকের ব্যবস্থাপনা সভায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রত্যক্ষ ভোটে বাংলাদেশ মাদকদ্রব্য বিষয়ক কমিশন-সিএনডির সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। একই দিন আলাদা ভোটে ইউনিসেফ এবং ইউএন উইমেনের নির্বাহী বোর্ডের সদস্যও পুনর্নির্বাচিত হয়েছে বাংলাদেশ। এসব অর্জন বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই সুসংবাদ। অতিমারি করোনার মধ্যেই একের পর এক এ ধরনের আন্তর্জাতিক অর্জন যোগ হচ্ছে বাংলাদেশের। সরকার অপছন্দের বলে কি এসব অর্জনকেও অপছন্দ করতে হবে? অস্বীকার করতে হবে? নানান তবে, কিন্তু, যদি খুঁজে বের করতে হবে?
দায়িত্ববান, জ্ঞানমান হয়েও ভালোকে ভালো বলতে না পারার ব্যারামটি ভাইরাসের মতো বেগবান। খুঁত বের করা, একের বিরুদ্ধে আরেককে লাগিয়ে দেয়ার মতো নোংরামিতে পদে-পোদে ল্যাঠা বাধানোর নষ্টামিতে অর্জনগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ঘেরাটোপে আর কতো? এই করোনা মহামারির মাঝেই স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হবার পথে আরেক ধাপ এগোনোর স্বীকৃতি পাওয়া কি যা-তা বিষয়? এই আনন্দের খবরটাকেও নিরানন্দের মোড়ক দেয়া জরুরি হয়ে গেল? কী বার্তা দিতে চান এরা?
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে দেশের গার্মেন্টস রপ্তানি জিএসপি সুবিধা হারাবে বলে ধ্যানের মতো কড়া যুক্তি প্রচারের মানে কী? বলা হচ্ছে, স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে ইইউভুক্ত দেশগুলো পণ্যের ওপর ৮/৯ শতাংশ ট্যারিফ রেয়াত দেয়। আমেরিকার ক্ষেত্রে এই সুবিধা নেই। এই সুবিধা দেয়া-নেয়ার পেছনেও ফ্যারকা আছে। এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দেশিয় কাঁচামাল ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আছে। সম্পূর্ণ দেশিয় কাঁচামাল ব্যবহার না করে অন্যদেশ থেকে বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা তা আমদানি করলে উৎপাদন খরচ ৬/৭ শতাংশ কম হবে। কী হয়েছে তাতে? উন্নয়নশীল দেশ হয়ে গেলে বাংলাদেশ ইইউতে জিএসপি হারালে বা উদ্যোক্তারা বিশ্ব মার্কেট থেকে কম দামে কাঁচামাল আমদানি করলে মোটের উপর কী বা কতো ক্ষতি হবে? এসব হিসাব না দেখিয়ে জিএসপি নানা কুসংবাদ প্রচারের মানে কী? বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হলে এক সুযোগ রহিত হলেও আরও দশ সুযোগ যে তৈরি হবে তা আড়াল করছেন কেন? কিভাবে উন্নয়নশীল দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো, সেবাখাত, কৃষিখাত, অর্থখাত, শিক্ষাখাত, প্রযুক্তিখাত তৈরি করা যায়- সেদিকে যাচ্ছেন না কেন?
কঠিন এ সময়েই কাকতালীয়ভাবে ধরা দেয়া অর্জনগুলো সহ্য হয় না? এই মহামারির মধ্যেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর জোট ডি-৮-এর দশম শীর্ষ সম্মেলনে সংস্থার সভাপতি হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল ৮টি মুসলিম-প্রধান দেশ- মিশর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান ও তুরস্কের সমন্বয়ে গঠিত জোটের ৮ এপ্রিলের বৈঠকে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও সংস্থার বর্তমান সভাপতি রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ানের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী দু’বছর এ পদে থাকবেন তিনি। আবার এমন দিনেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ স্বীকৃতি পেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২২-২৩ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ‘লিডার্স সামিট অন ক্লাইমেটে বক্তৃতা করলেন তিনি। এর আগে বাইডেনের উপদেষ্টা সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি কয়েক ঘন্টার সফরে ঢাকা ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক ওপেনসিক্রেট গুরুত্বে একটুও ভাগ্যবান মনে হয় না নিজেদের? ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে কৌশল বাস্তবায়নে বাংলাদেশের ভ্যালু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অমূল্য সম্পদের মতো। গত কয়েক বছর ধরে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে যারপরনাই সচেষ্ট ওয়াশিংটন। একইসঙ্গে ভারত, জাপান, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্দেশীয় সামরিক জোটে বাংলাদেশকে শামিল করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এতে একাট্টা তার প্রধান উন্নয়ন অংশীদার জাপানও। চীনের সঙ্গে পাল্লা দিতে প্রতিবেশী ভারতের কাছেও বাংলাদেশ অমূল্য রতন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক এই গুরুত্বের সঙ্গে নিজের ভাগ্যের ভবিষ্যত অন্য কেউ বুঝিয়ে দিতে হবে?
বিশ্বরাজনীতির অন্যতম শক্তি চীন ও আঞ্চলিক শক্তি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নৈকট্য এবং দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলে এ দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ বিষয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। ক্ষমতার হাতবদল এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও গত দেড় দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক উচ্চতা আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন কেবল ভারতবেষ্টিত এবং ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে অবস্থিত ক্ষুদ্র এক বদ্বীপ ভাবার সুযোগ নেই। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্বিপাক, জলাবদ্ধতা, নদীর নাব্য হ্রাস, পানির স্তর নেমে যাওয়া, ফসলি জমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে মানুষের জীবন-জীবিকা প্রতিনিয়ত হুমকিতে পড়লেও দেশটির ঘুরে দাঁড়ানো কারো কারো কাছে কেন গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠলো? তা বুঝতে কী বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে?
‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র তকমা লাগানো পশ্চিমাদের কাছে বাংলাদেশের ঘুরে দাঁড়ানো কেন তাক লাগানোর চেয়েও বেশি ম্যাজিকেল । সেই পশ্চিমারাই এখন বাংলাদেশকে তোয়াজ করে। প্রশংসায় ধন্য করে। পাশে থাকার অঙ্গীকার শোনায়। সাকসেস স্টোরিও রচনা করে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসে খ্যাতিমান কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টফ মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে পরামর্শ দিয়েছেন, দারিদ্র্য কাটাতে কী কী করা উচিত, তার শিক্ষা বাংলাদেশের কাছ থেকে নিতে। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে, বিশেষ করে দারিদ্র্য দূরীকরণ, নিম্ন শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার, স্যানিটেশন ও নারীশিক্ষায় উন্নতি উন্নত বিশ্বকেও ঈর্ষান্বিত করছে। ত্রুটিপূর্ণ শাসনব্যবস্থা, জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্ব, প্রাকৃতিক সম্পদ ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার একটি দেশের এমন ‘প্যারাডক্স’ উন্নয়ন তাদের কারো কারো কাছে গবেষণার বিষয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশকে তাদের উন্নয়নের পোস্টার চাইল্ড হিসেবে উদাহরণ দেয়। প্রাণঘাতী করোনা মহামারির মধ্যেও বিশ্বের নানা প্রান্তে নতুন মেরুকরণ। নানা ঘটনার ঘনঘটা। সব অস্ত্র বা সমরে নয়, কৌশলের প্রতিযোগিতায় যে দেশ যেভাবে পারছে নিজেদের শক্তিমান করছে। অন্যকে ঘায়েল করছে। নইলে পাওনা বুঝে নিচ্ছে। পুরনো ঘটনাও নিচ্ছে নতুন অবয়ব। দীর্ঘদিনের ধারনাও পাল্টে যাচ্ছে। বসে থাকছে না বাংলাদেশও। এই হিম্মতে মনে মনেও শুকরিয়া আসে না? অতৃপ্তিটা কোথায়?
লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন