টিকার ঠিকায় নতুন বিশ্ব
৫ জুলাই ২০২১ ২১:২৫
মহামারি বা মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে রাজনীতি-কূটনীতি ঘৃণিত-অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে এ নিয়ে কেবল চর্চা নয়, রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলে। করোনা, কিট, টিকা, অ্যান্টিবডি টেস্টে যে যত সক্ষম, তার শিনা-ই বিশ্বে তত বেশি টান। যার যত টিকা বা ভ্যাকসিনের ঠিকাদারি-খবরদারি, সেই তত শক্তিমান। শক্তির এই জানান দেওয়ার দৌড় এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।
ভ্যাকসিনের ভালো-মন্দ, আসল-নকল নিয়েও তাই। বণ্টন-প্রয়োগ নিয়েও দেশে দেশে চলছে নাটকীয়তা-উত্তেজনা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ। গুজবও বেশুমার। কারা গুজব রটিয়েছে, কাদের দিয়ে তা বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করানো হয়েছে, কাদের দিয়ে প্রচার করা হয়েছে— সেসব তথ্যও ভয়ানক। সামনের দিনগুলোতে তা আরও খোলাসা হওয়া বা করার আয়োজনেও কমতি নেই। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ও নিকটবর্তী দুই দেশ ভারত-চীনও এই রেসে বেশ আগুয়ান। সক্ষমতায় তারা কেউ কারও চেয়ে কম নয়। করোনা মহামারির মাঝেও যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা দুই দেশে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস আগামী বছর এই সময়ের মধ্যে যেন প্রত্যেক দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে ভ্যাকসিন দেওয়া নিশ্চিত করা হয়, সেই আহ্বান জানিয়েছেন। আহ্বান হলেও এটি নির্দেশেরই মতো। এ ক্ষেত্রে বিশ্বের সব দেশে ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রক্রিয়া বা অন্তত ভ্যাকসিন পৌঁছানো সুনিশ্চিত করতে হবে। এখানে উৎপাদক বা নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলো ‘ফর্মে’ থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এর বিপরীত হলে কেবল বিশ্বে নয়, নিজ নিজ দেশেও সরকারগুলোর গুরুচরণ দশা হবে। সেই নমুনা শুরু হয়েও গেছে। মার্কিন নির্বাচনে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হারের পেছনে অন্যতম কারণ করোনা মোকাবিলা এবং ভ্যাকসিন কার্যক্রমে অবহেলার অভিযোগ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও এ নিয়ে আচ্ছা রকমের ছিদ্দত পোহাচ্ছেন। এর বিপরীতে করোনা মোকাবিলা এবং সঠিক ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমের সক্ষমতায় উল্লাসে আছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। নিজ দেশে এবং বিশ্বে তার হিম্মতের প্রকাশ ঘটছে। পহেলা জুলাই কমিউনিস্ট পার্টির জন্মদিনে লাখ-লাখ লোক মাস্ক না পরে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সমবেত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মৌজ-মাস্তি করেছেন। বিজয় উল্লাস রাশিয়ায়ও। ভ্যাকসিন উৎপাদন করে রাশিয়ায় আগামী নির্বাচনেও প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম করেছেন পুতিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতিগতি আরেক মাত্রায়। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে-দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহ করে উপহারের কথা প্রচার করছে তারা। কূটনীতিতে একরত্তিও কমতি করছে না যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে তাইওয়ানে ২৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন পাঠিয়েছে, আরেকদিকে ভারতে ভ্যাকসিন তৈরির কাঁচামাল রফতানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রমে কঠোরতার মধ্য দিয়ে আন্তঃরাজনীতিতে হিরো বনে গেছেন ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে। ফিলিপাইনে যারা করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নেবে না, তাদের জেলে ঢুকানোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে ভিন্ন ধাঁচের শিরোনাম হয়েছেন।
কেবল যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বা ভারতের সিরাম নয়, আবিষ্কার ও সরবরাহের খবরদারিতে ভ্যাকসিন উৎপাদক ও নিয়ন্ত্রণকারীরা গোটা বিশ্বেই ‘ফ্যাক্টর’। ভ্যাকসিন কেনাবেচা-উপহার নিয়ে ক্যারিকেচার কেউ কম করছে না। চুক্তি করে অগ্রিম টাকা নিয়েও ভারত তার ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী বাংলাদেশের সঙ্গে যা করেছে, এর বিহিতের সুযোগ নেই। বলারও তেমন কিছু নেই। চুক্তির ভ্যাকসিন না দিলে ভারত টাকা ফেরত দেবে বলে কিছুদিন আগে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সত্যিই টাকা ফেরত দেবে কি না— জানতে চাইলে সম্প্রতি বলেছেন, ‘এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানে।’ পরিস্থিতির অনিবার্যতায় শেষমেষ বাংলাদেশ বাধ্য হয়েছে বিকল্প দেশ খুঁজতে। সেটা আবার ভারতের প্রতিপক্ষ চীন। চীনারা সঠিক সময়ে লকডাউন, মেডিসিন, নার্সিং, সার্ভিসিং এবং ভ্যাকসিন দিয়ে করোনা বিদায় করেছে। ভারত সেখানে হোঁচট খেয়েছে চরম আঘাতে।
২০১৪ সালে বিশাল বিজয়ে গোটা বিশ্বে তোলপাড় তুলেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় মার খেয়ে বাজে অবস্থা তার। ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করেও পরিকল্পনা প্রণয়ন কার্যক্রমে লেজেগোবরে করে ফেলেছেন। চীনকে টপকাতে গিয়ে বিশ্ব ভ্যাকসিন রাজনীতিতে হিরো হওয়ার জায়গায় ‘জিরো’ দশায় পড়ে যান। ভারতের এমন নাকানি-চুবানি যেন চীনের জন্য পরম আনন্দের। করোনা টেস্ট, চিকিৎসা এবং ভ্যাকসিনের বাইরেও তাদের রমরমা শোআপ। মাত্র এক দিনে ১০ তলা বাড়ি বানিয়ে চমক দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চীনা নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোর্ড গ্রুপ। সম্প্রতি চীনের হুনান প্রদেশের চ্যাংশায় মাত্র ২৮ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে ১০ তলা একটি ভবন তৈরি করেছে তারা। করোনাকাল ও ভ্যাকসিন নিয়ে এমন বাহাদুরির জানান দেওয়া এবং ভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের কূটনীতি-রাজনীতি একেবারে আকস্মিক নয়। এমন ধারণা আগেই ছিল। এখন চলছে তারই বাস্তব রিহার্সেল।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/টিআর